মুম রহমানের ‘সেরা দশ গল্প’ : বাস্তব, কুহক ও প্রেমের গরিমা
Published: 12th, March 2025 GMT
অনার্সে একশ নম্বরের একটা কোর্স ছিল চলচ্চিত্রের। পড়াশোনা ব্যাপক, কিন্তু চলচ্চিত্র সমালোচনা সম্পর্কিত ভালো বাংলা বই খুঁজতে গলদঘর্ম অবস্থা। তখন পরিচয় হয় ‘মুম রহমান’ নামটার সঙ্গে। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে তার ছোটগল্প পড়েছি। গল্পগুলোর সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো- আন্দাজ করা যায় না শেষটা! আমার চতুর পাঠকসত্তা তাতে রোমাঞ্চ অনুভব করেছে। লেখকের দশটি সেরা গল্প নিয়ে অন্যপ্রকাশ এবার বইমেলায় প্রকাশ করেছে ‘সেরা দশ গল্প’ সিরিজের মুম রহমান পর্ব।
বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক লিখেছেন ‘একজীবনে সেরা দশটি গল্প লিখতে পারলে জীবনের কাছে আর কীই-বা চাইবার থাকতে পারে।’ সত্যিই! দশটি সেরা গল্প লেখার জন্য হয়ত জীবন অনেকটাই ছোট, কিন্তু নিঃসন্দেহে এই দশটি গল্প লেখকের জীবনের পরিধিতে মাপার মতো নয়। গল্পের গড়ন, গঠন, ভাষা আর শৈলী যেন চোখের তারায় বিশ্ব ধরে রাখার মতো। লেখকের এক জীবনের লেখালেখির একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও যেন তার ধাঁচ বোঝার পক্ষে এই বইটি যথেষ্ট।
বইয়ের নামে বোঝা যায়, বইটিতে রয়েছে দশটি গল্প। উর্মিমালা, সবুজ, দুর্ঘটনা, সেই সব পুরনো দিনের প্রেম, অন্ধ পাঠক, কবিতা ভাইরাস, সর্বংসহা, শূন্যে ভাসা, এক বৃষ্টির সন্ধ্যায়, নীল শাড়ি।
উর্মিমালা গল্পটিতে উঠে এসেছে রন্ধনের শৈল্পিক বর্ণন। যৌনতার সঙ্গে রান্নাকে পাশাপাশি রেখে দেখানো হয়েছে ইন্দ্রিয়ের বিলাসী চরিত্র। গল্পটি পড়তে পড়তে হয়ত কিছু সময়ের জন্য পাঠকের মনে হবে- একটা ভীষণ উত্তেজনাকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হয়ত ঘটবেও, কিন্তু আসলেও কি তাই? গল্পে দেখা যায় এক শেফকে যে কিনা প্রস্তুত করছে তেলাপিয়া মাছের একটি পদ। কিন্তু তার মনে হয়- পৃথিবীর সব তেলাপিয়া মাছের নামই তেলাপিয়া, ঠিক যেমন পৃথিবীর সব মানুষের নামই মানুষ। এটি তো কেবল প্রজাতির নাম। তাই পৃথিবীর মানুষদের যেমন আলাদা আলাদা নাম রয়েছে, তেমনি তার হাতে থাকা তেলাপিয়ারও একটা নাম দরকার। তাই মাছটির নাম দেয়া হয় উর্মিমালা। শেফ উর্মিমালাকে ট্যাপের পানিতে ধোয়, আঁশ ছাড়ায়, হালকা কিছু মশলা যোগ করে। মাছটাকে মূলত সে বেক করবে, বেকড তেলাপিয়া। সাথে থাকবে পাম্পকিন স্যুপ আর আরও কিছু পদ, কিন্তু মূল আকর্ষণ বেকড ফিশ, তথা উর্মিমালা।
উর্মিমালার আয়োজন মূলত এক নারীর কারণে। মিথিয়া নামের সেই নারী আঘাত করেছে শেফের অহং-এ। তাকে একবেলা খাওয়াতে চায় সে। দেখাতে চায় খাবারের মধ্য দিয়ে তার শৈল্পিক সৃষ্টি। অপর দিকে মিথিয়া বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের সাথে হোটেলে যায়, খায় এবং শোয়। তাই খাবার তার কাছে শুধু খাবার নয়, শারীরিক আহ্বানের ওয়ার্ম আপ।
‘তাহলে কী দাঁড়ালো, ছোঁয়া, দেখা, শোকা, চাখা, শোনা একদম পাঁচ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার। এখন বলুন, রান্নার মতো আর কোন কাজে পাঁচ ইন্দ্রিয় এতো গভীর করে ব্যবহার করা যায়? - সেক্সে।’
আমরা এখানে মূলত দুটি পক্ষ দেখতে পাই। পক্ষের একদিকে থাকে শিল্প, অন্যদিকে শরীর; একদিকে ভাব, অপরদিকে বস্তু; একদিকে আধ্যাত্ম, অপরদিকে দেহ। তাই, উর্মিমালা গল্পটি শুধু একটা খাবারের বর্ণন নয়, একটা মাছ পাকানোর পদ্ধতির রূপায়ণ নয়, আবার একইসাথে নয় কোনো প্রেমের গল্প। এখানে একইসাথে একঘেয়ে-আনুপুঙ্খিক চিরায়ত কামের হাতছানি আছে, আবার আছে টানাপোড়েন। কারণ গল্পের শেষ অব্দি আমরা জানতে পারি না শেফ মহাশয় আসলে মিথিয়ার ডাকে সাড়া দিয়েছেন কি দেননি, দেবেন কি দেবেন না।
আবার সবুজ গল্পটিকে আপাতদৃষ্টিতে শুধু এক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত স্কুল শিক্ষকের বীক্ষণ বা ক্ষণচারী এক চিত্রকরের ট্রমাটিক অতীতের চিত্রায়ণ মনে হলেও গল্পের অগস্ত্য যাত্রা ঢুকে যায় শিল্পের গহীন ভুবনে। একই স্কুলে পড়া দুই বন্ধু, একজন হয়ে ওঠেন ভুবনবিখ্যাত চিত্রকর, আরেকজন স্কুল শিক্ষক। সময়ের আবর্তে তাদের দেখা হয়, দেখা যায় বন্ধুত্বের বলয় সেই আগের মতই আছে। তাদের কথায় আমরা জানতে পারি অতীতের তলহীন দৃশ্যকাব্যের বিস্মৃত আখ্যান যা উঠে আসে যেন কোনো গভীর থেকে। জানা যায় দেশভাগের কথা, ধর্মীয় বিভেদের সুর। কিন্তু সব যেন গায়েব হয়ে যায় আর্টের তীব্র ঝাপটায়। চিত্রকরের চিত্রকর্মগুলো বিক্রি হয় বহুমূল্যে, সেগুলোর ক্রেতা সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা। তাদেরই একজন সায়েরা, তার সাথে প্রদর্শনীতেই পরিচয় ঘটে চিত্রকরের। তাদের মধ্যে আলোচনা হয় শিল্প জগতের নানা কথাবার্তা, বিভিন্ন চিত্রকর্ম নিয়ে কথা যা সবই আমরা জানতে পারি স্কুল শিক্ষকের বয়ানে। অতীতের বেদনার অংশ মিশে থাকলেও চিত্রকর রাজি হন নিজের মাটিতে একবার হলেও গিয়ে পা রাখতে। হেলিকপ্টারে নিজ এলাকায় যান চিত্রকর, সাথে নারী, আর বন্ধু স্কুল শিক্ষক। বন্ধুকে বাইরে রেখে চিত্রকর সায়েরাকে নিয়ে ঢুকে যান জঙ্গুলে পৈতৃক ভিটায়। কাজ শেষে তারা যখন ফিরে আসেন তখন আমরা বুঝি ওই সময়টুকুর মধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে এক এমন শিল্পকর্ম যা অমরত্ব পাবে। যার সৃষ্টির অংশ হয়ে গেলো ওই স্কুল শিক্ষক নিজেও। যখন তারা ফিরে যাচ্ছিল তখন তার মনে হচ্ছিল হেলিকপ্টারটা যেন অমরত্বের দিকে, অসীমের দিকে চলে যাচ্ছে।
দুর্ঘটনা গল্পটি আমাদের দেখায় শ্রেণীবৈষম্যের চিরায়ত চিত্র, কীভাবে শোক, সুখ এবং প্রয়োজনের বিভাজন ঘটে। গল্পের প্রধান চরিত্র বুবুন, বুবুনকে পাহারা দেয়ার জন্য তার মা সঙ্গে দিয়ে দেয় কাজের ছেলে তোতাকে। ঢাকা শহরে সড়ক দুর্ঘটনা তেমন নতুন কিছু না হলেও এই ঘটনাটা একটু ব্যতিক্রম। প্রথমত, শহরের প্রাণকেন্দ্রে এমন ঘটনা একটু কম; দ্বিতীয়ত, বুবুন বেশ প্রভাবশালী বাবার মেয়ে। তাই, খুব বেশি চোট না পাওয়া বুবুনকে নিয়ে তার বাবার যে তৎপরতা আমরা দেখতে পাই, তোতাকে নিয়ে তেমন নয়। তোতা যদিও মারা যায়, সেই খবরটা অব্দি বুবুন পর্যন্ত এসে পৌঁছে না। তোতার চিকিৎসা, মৃত্যু, সৎকার- কোনো কিছুই যেন ওপরতলার মানুষগুলোর মধ্যে কোনো বিশেষ অনুভবের সৃষ্টি করে না। এমনকি তোতার চাচারও তোতার তুলনায় তার বড়লোক মনিবের জন্যই প্রাণটা বেশি করেই কাঁদতে দেখা যায়। সমস্যাটা তাই শুধু শ্রেণীর নয়, এখানে এমনকি উত্তর উপনিবেশিক আলোয়ও গল্পটি দেখা যেতে পারে। বুবুনের বাবাকে যদি আমরা উপনিবেশিক প্রভুদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখি, আর তোতা বা তোতার চাচাকে উপনিবেশায়িত শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে, তবে যেন গল্পটি নতুন প্রাণ পায়। তোতার চাচা যেমন এত বড় ঘটনার পরেও বুবুনের বাবাকে প্রভুরূপে জ্ঞান করতে থাকে, ঠিক তেমনটাই ছিলো ঔপনিবেশিক সময়ের চিত্র।
আবার সেইসব পুরনো দিনের প্রেম কিংবা এক বৃষ্টির সন্ধ্যা আমাদের শিহরিত করে আলুলায়িত চিরন্তন অনুভূতির জায়গা থেকে। তবে আমার সবচেয়ে পছন্দের গল্পটি হলো অন্ধ পাঠক। হোসে সারামাগোর ব্লাইন্ডনেসের কথা মনে পড়ে গেলেও গল্পের রূপায়ণ একেবারেই আলাদা যে তা বুঝলাম কিছুদূর পড়ার পরেই। অন্ধ পাঠক যেভাবে পাঠকে উপাসনা করে তোলার কথা বলেন তা যেন আমার মধ্যে থাকা পাঠকটিকে আরও উৎসাহী করে তোলে।
‘: কিছু মনে করবেন না, আমি তো কোন পুরুষকে চাচ্ছি না।
: কেলাইগ্গা, পুরুষ মানুষ কাম পারে না?
: না তা নয়, আমি চাই খুব সুন্দর, মিষ্টি কেউ আমাকে বই পড়ে
শোনাবে। জানেন তো, সবাই পড়তে জানে না। সবার পড়া
শুনতেও ভালো লাগে না।
: আরে, আমি তো নিউজ রিডিংয়ের কোর্স করছি।
: আপনি হয়তো যোগ্য, কিন্তু আমি একজন নারীকে চাইছি, তরুণী, সুন্দরী কেউ। সে যখন পড়বে তখন বইয়ের গন্ধের সঙ্গে তার ব্যবহৃত সুগন্ধী, কাজল, টিপ, চুলের হাওয়া সব কিছু আমাকে ঘিরে থাকবে। পাঠ হয়ে উঠবে সুন্দরতর এক উপাসনা।’
অন্ধ পাঠক চায় তাকে বই পড়ে শোনানোর মত কাউকে, কেউ বলতে কোনো সুন্দরী, তরুণী নারী। অন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে বই পড়তে পারে না- রাতে তাই তার ঘুম হয় না- আবার সকালও তার দেখা হয় না- এ সকল রোগ তার সেড়ে উঠতে পারে যদি তাকে কেউ বই পড়ে শোনায়। সে চোখ ফিরে চায়, তবে চোখ তো আর চাইলেই মেলে না, তাই ধীরে ধীরে তার মেজাজও খারাপ হতে থাকে।
পাঠক তাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে হয়ে পড়ে পাঠভিক্ষু। সে ভিখারি হয়, স্টেশনের এক কোণে সে বসে পড়ে ভিক্ষা করে, কেউ যদি দয়াপরবশ হয়ে দুটি পাতা তার জন্য পড়ে শোনায়। কেউ উপহাস করে, আবার কেউ কেউ সত্যিই দু’এক পাতা তাকে পড়ে শোনায়। এভাবেই পাঠক বেঁচে থাকে। অন্ধ পাঠক যেন আমাদের সাহিত্যলোভী হৃদয়েরই একটি রূপ। পাঠক যত দিন যাচ্ছে যেন পাঠ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পাঠ থেকে দূরে থাকলেই তার মধ্যে বাসা বাঁধবে রোগ, বালাই, অন্ধত্ব- আর এগুলোর উপশমও তাই পাঠ।
কবিতা ভাইরাস আমাদের দেখায় কীভাবে সমাজের সকল নীচতা ধুয়ে দিতে পারে কবিতা। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় জায়গাগুলোতে বিজ্ঞাপনের স্থলে ছাপা হতে থাকে কবিতা। এ ছাড়াও নির্দিষ্ট অঞ্চলের পত্রিকায়, দেয়ালে, এমনকি গাড়ির উইন্ডশিল্ডেও পাওয়া গেলো কবিতা। তাও আবার লাইনে লাইনে মিল দেয়া যেমন তেমন কবিতা নয়, রীতিমতো সাহিত্য। যেমন, এক জায়গায় লেখা হয় :
‘রবীন্দ্রনাথ, আপনিই আমাদের মহাকাব্য।’
ঘটনার বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা, অনুসন্ধান চলতে লাগলো। এমনকি সব কবিতা মিলিয়ে সংকলন বের হতে লাগলো। তার আবার বিভিন্ন নামকরণও হলো। একদিন এক পাগল এক পুতুলকে ধর্ষণ করল। পাগলকে আটক করা হলো, আবার ছেড়েও দেয়া হলো। তার পিছু পিছু কিছু মানুষ হাঁটতে লাগলো। দেখা গেলো কবিতা ভাইরাস দূর করতে তারা আগ্রহী, আর ভাইরাস দূর হবার সাথে সমান্তরালভাবে ফিরে আসছে অপরাধ। অর্থাৎ, কবিতার চর্চা সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা দূর করতে পারে। যেমন আবার কবিতা দূর হলে সমাজে একইভাবে অপরাধ ফিরে আসে।
শূন্যে ভাসায় আমরা দেখি অসহায় মানুষ, তার চেয়েও অসহায় যাত্রা, পৃথিবীর পথে। সর্বংসহা সেই নারীর গল্প যে সয়েই যাচ্ছে, গঙ্গা যেমন পাপ ধুয়ে সবাইকে ঠাঁই দেয়, এও যেন সামাজিক নামকরণে পাপে ঠাসা পাপনাশিনী। এক কুকুরের বয়ানে আমরা গল্পের চিত্রায়ণটি দেখতে পাই। গল্পে এক দেহপসারিণীর কাছে একইসঙ্গে যেমন সন্ত্রাসীর আগমন ঘটে, আবার পুলিশেরও চলাচল থাকে। সবাই আসে যার যার শরীরের আড়মোড়া ভাঙতে। সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য যখন পুলিশ নুরানীকে প্রশ্ন করে তখন সে বলে, ‘হুদাই রাগ দেখায়েন না স্যার। আমরা তো কাউরে ফিরায়ে দেই না, আপনে আসলেও হ্যাঁ, উনি আসলেও হ্যাঁ। সবাই আমাগোর ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে।’
কথোপকথনের মাধ্যমে জানা যায় পুলিশ নুরানীর সেবা নিলেও তাকে টাকা দেয় না। অথচ সেই আবার নুরানীকে আইন শেখায়। এই যে পাশ বদল করতে থাকা ক্ষমতার দ্বিচারিতা, তারই যেন অবয়ব গল্পে ধরা পড়ে।
সবশেষে নীল শাড়ি যেন প্রেম আর অপ্রেমের সাংঘর্ষিক এক অবস্থান, যার প্রেক্ষাপট নতুন নয়, যদি নতুন বলা যায় কিছু তা হলো কত্থনটুকু। লিলি ভালোবাসে মজিদকে, অথচ তার বিয়ে হয় শহীদের সঙ্গে। মজিদের দেয়া শাড়ি পরে মজিদের অপেক্ষা করতে করতে চলে আসে শহীদ, প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা কণ্ঠে রেখে সে মিলিত হয় স্বামীর সঙ্গে, এ যেন কত কত নারীর গল্প, একটি গল্পের মধ্যে।
মুম রহমানের গল্পে একটা ব্যাপার রয়েছে। তার গল্পে কথোপকথনের জায়গাটি মুখ্য, বর্ণনায় একটা হুমায়ুনী ঘরানার ছায়া রয়েছে, তবে তা কখনোই লেখকের নিজস্বতাকে খর্ব করতে পারেনি। প্রতিটি গল্পই আলাদা, কোনো গল্পই এমন নয় যা আমরা চারপাশের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গা থেকে দেখতে পারি না। বরং কিছু গল্প, কিছু কথা, কিছু কাহিনি এতটাই বাস্তবিক যেন আমাদেরই জীবনের কথা; হুট করে মনে হয় যেন বলে উঠি, আরে! লেখক আমার এই গুঢ় কথাটি জানলো কি করে!
‘সেরা দশ গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে বইমেলায়, প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। দাম ৪৫০ টাকা।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ম রহম ন চ ত রকর র র জন য জ বন র আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস
বাবা সন্তানের ওপর ছায়ার মতো স্নেহময় এক উপস্থিতি। নিঃশর্ত ভরসার প্রতীক। সন্তানের ভবিষ্যৎ গঠনের প্রয়োজনে নিজের বর্তমান, এমনকি নিজের স্বপ্নও নীরবে উৎসর্গ করে দিতে পারেন যিনি– আজ তাদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর দিন। বাবা দিবস উপলক্ষে সমতা’র বিশেষ আয়োজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা বৃহত্তর বরিশালে। এখন সেই জায়গাটা পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভার সমুদয়কাঠি গ্রাম। তখনকার সামাজিক পরিসরে আমাদের পরিবারের অবস্থা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভালো ছিল। আমার বাবা বিজয় কুমার আইচ তখন পিরোজপুরে কাজ করতেন। তাঁর রেশনের দোকান ছিল। প্রতি শনিবার বাড়ি আসতেন। আমরা বাবার আশায় বসে থাকতাম। এটি ছিল আমাদের জন্য একরকম আশীর্বাদের মতো।
বাবার একটি ব্যবসাও ছিল। এ থেকে মূলত আমাদের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্ভবত বাবার জ্ঞান বা বোধ উন্নততর ছিল। তাঁর ব্যক্তিত্বের জন্য দশ গ্রামের লোকজন তাঁকে মানত। গ্রামে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকত। বাবার সঙ্গে কথা না বলে কেউ থানা-পুলিশ করতে যেত না। বাবা সবাইকে খুব বুঝিয়ে বলত– মামলা করলে কে জিতবে, কে হারবে– এটি অনেক পরের কথা। মামলা নিয়ে বরিশাল-পিরোজপুরে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে পড়বে। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরা মিটমাট করে ফেল।
গ্রামের পণ্ডিতরা তখন তালপাতায় অ-আ-ক-খ শেখাতেন হাত ধরে ধরে। আমার সেটি একদম পছন্দ হতো না। বাবা কী করলেন, তিনি একটা স্লেট ও পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। অ-আ-ক-খ দিয়ে যত ছবি আঁকা হয়, তা শেখাতেন। এর মধ্যে আমার যে ছবিটা পছন্দ হতো, সেটি আমি মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। যার ফলে বাবার মাধ্যমে অত্যন্ত আনন্দদায়ক এক শিক্ষা পেয়েছি আমি।
আমার বাবারা ছিলেন ৪ ভাই। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দু’জন পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। আমার বাবা ও এক কাকা বাড়ি ছেড়ে যাননি। আমরা ছিলাম ৬ ভাই ৩ বোন। কাকাতো ভাই ৪ জন, বোন একজন। মোট ১৪ ভাইবোন। কাকা কম বয়সেই গত হন। বিলাসী জীবন আমাদের ছিল না। তবে গ্রামের মানুষের কাছে আমরা ছিলাম বড়লোক। পরিবারে অনেক সদস্য থাকলেও খাবারের অভাব হতো না কখনোই। এমনকি দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থায়ও খাবারের কষ্ট করতে হয়নি। আমাদের একটা গুদামঘর ছিল। সেখানে বাবা পাশের বন্দর কাউখালী থেকে সারা বছরের চাল, ডাল, পাউডার দুধ, চিনি, লবণ, গুড় এনে ড্রামে ভরে রাখতেন। বাইরে যত সংকটই থাকুক না কেন, বছরজুড়ে খাবারের অভাব হতো না। সমস্যা হতো ঝড়ের সময়। উপকূলীয় অঞ্চলে এমন ঝড় মাঝে মাঝেই আসত। কখনও ঘরের চাল উড়ে গেলে আমরা সমস্যায় পড়ে যেতাম।
অন্যদের সামনে বাবা নিজের অবস্থানের জন্যই বেশি হাসি-তামাশা করতেন না। যখন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, তখন তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো হাসি-খুশি থাকতেন। তখনকার বাবাদের আমরা মারধর করতে দেখেছি, এমনকি খড়ম দিয়ে পেটাতে দেখেছি। বাবা আমার গালে জীবনেও একটা চড় মারেনি। কোনো ভাইবোনকেও মারধর করতে দেখিনি। তখন হয়তো আরও এমন বাবা ছিলেন। তবে গ্রামে আমি এমন বাবা আর দেখিনি। সন্তানের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও তিনি কখনও জিজ্ঞেস করতেন না, কেন দেরি করে ঘরে ফিরেছি।