ঠিকাদারের টাকা বাঁচাতে সর্বনাশ কৃষকের জমিতে
Published: 13th, March 2025 GMT
সুনামগঞ্জের শাল্লায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের সময় এক কৃষককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ উঠেছে। এ জন্য বদলানো হয়েছে বাঁধটির পরিকল্পনা ও নকশায়। কৃষকদের অভিযোগ, ঠিকাদারের টাকা বাঁচানোর জন্যই এই কাজ করা হয়েছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা এসব বক্তব্য অস্বীকার করেছেন।
ঘটনার শিকার পিকলু চন্দ্র তালুকদার উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়নের ডুমরা গ্রামের বাসিন্দা। ওই গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের কৃষকরা জানান, শাল্লা উপজেলায় ৫৫৫৩ কিলোমিটার থেকে ৬৭৫৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ছায়ার হাওর সাব-মার্সিবল বাঁধের সিসি ব্লক, বাঁধের কাজ ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর শুরু হয়েছে। বাঁধটি সুলতানপুর সেতুর কাছে এসে নদীর পার থেকে প্রায় ২৩০ মিটার পশ্চিমে বাঁকা করে কৃষক পিকলু তালুকদারের জমির মাঝখান দিয়ে মাটি ফেলা হয়েছে। অথচ জমির পূর্বদিকে জমির পার থেকে প্রায় ২৫০ ফুট খাসজমি ও নদীর পারসংলগ্ন প্রায় ৫০ ফুট প্রশস্ত জায়গা রয়েছে।
জানা গেছে, পিকলুর বাবা প্রবোধ চন্দ্র তালুকদার আট কেয়ার (২৮ শতাংশে কেয়ার, তিন কেয়ারে এক একর) জমি রেখে মারা যান। পরে ওই জমি সমানভাবে ভাগ হয় দুই ছেলে পিকলু ও কল্লোল তালুকদারের মধ্যে। তাদের জমির দুই কেয়ার পড়েছে ছায়ার হাওরের দুর্বিলা অংশে। হাওরের এই অংশে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধের কাজ গেল ৪-৫ বছর ধরেই ঢিমেতালে চলছে।
জমির ওপর বাঁধের মাটি ফেলায় জীবন-জীবিকা নিয়ে সংকটে পড়েছেন বলে জানান পিকলু চন্দ্র তালুকদার। তিনি প্রতিকার চেয়ে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও শাল্লার ইউএনও বরাবর অভিযোগ করেছেন। পিকলু তালুকদার বলেন, বাঁধটি তাঁর জমির কাছে এসেই খোড়ের (প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট গভীর গর্ত) দোহাই দিয়ে সোজা না রেখে, বাঁকা করে তাঁর জমির ওপর দিয়ে নিচ্ছে। তিনি
বাধা দিলেই কর্মকর্তারা কাজ করা হবে না বলেন। তবে তিনি চলে যেতেই ঠিকাদারের লোকজন
কাজ শুরু করে। তিনি লিখিত অভিযোগ দিলেও ঠিকাদার কাজ বন্ধ না করে তাদের মতো করেই করছেন। এই সামান্য জমিটুকুকেই নিজের সম্বল জানিয়ে পিকলু প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এটি নিয়ে নিলে তিনি পরিবার নিয়ে কীভাবে চলবেন?
স্থানীয় কৃষকরাও মনে করেন, বাঁধটি বর্তমান জায়গা থেকে মাত্র ২০-২৫ ফুট পূর্বদিকে সরিয়ে নির্মাণ করলেই পিকলুর জমি ঠিক থাকতো, বাঁধটিও সোজা ও টেকসই হতো। কিছু মাটি ও ব্লক বেশি লাগবে, এতে ঠিকাদারের খরচ বেশি হবে– এ কারণেই প্রান্তিক এই কৃষকের সারাজীবনের ক্ষতি করে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারছেন না তারা।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স এনলাজ ট্রেডার্সের পরিচালককে একাধিকবার কল দিলেও ধরেননি। সুনামগঞ্জ পাউবো’র (পওর বিভাগ-২) নির্বাহী প্রকৌশলী মো.
এর আগে কেউ এমন অভিযোগ করেনি উল্লেখ করে এই প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘বহু পিআইসি হয়েছে এখানে। তখন উনার (কৃষক পিকলু তালুকদার) জীবন-জীবিকা কোথায় ছিল, বাঁধ
তো আমরা আজ জমির ওপর উঠাইনি। তিনি যদি মনে করেন বাধা সৃষ্টি করে ঠিকাদারের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিতে পারবেন, সেটা হবে না। তিনি কাজ করতে না দিলে আমরা করবো না, অন্য জায়গায় কাজ করবো।’
প্রকৌশলী ইমদাদুল হকের বক্তব্য জানিয়ে পিকলু তালুকদারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে আমার জমির ওপর সামান্য মাটি ফেলা হয়েছিল। আমরা বাধা দেওয়ার পর তারা কথা দিয়েছিল, আর মাটি পড়বে না। এখন বাঁধের বরাদ্দের টাকা বাঁচিয়ে লুটপাটের জন্যই নকশা বদলিয়ে আমার জমির ওপর দিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’
ইউএনও পিয়াস চন্দ্র দাস কৃষক পিকলু তালুকদারের অভিযোগ পেয়েছেন। তিনি পাউবোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে সেটি পাঠিয়েছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা
ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”
এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি।
গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।
কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”
ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”
এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”
ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”
এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”
জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”
বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”
ঢাকা/কেয়া/রফিক