মাগুরার শিশুটিকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো গেল না। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মারা গেল সে। আশা করি, এই ধর্ষণ আর হত্যার বিচার দ্রুত হবে। কারণ, এ ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যম সরব ছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভও হয়েছে। কিন্তু এটাও বলতে হয়, আরও অগণিত ঘটনা চাপা পড়ে থাকবে সমাজের অন্ধকার রন্ধ্রে। প্রতিদিন এমন কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে যাবে আমরা জানবও না। আরও কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের নিচে চাপা পড়বে শিশুর প্রতি নির্মমতার আরও খবর। কেন ধর্ষণের শিকার হয় এত ছোট শিশু? কেন যাঁদের আদরে-স্নেহে বেড়ে ওঠার কথা, তাঁদের হাতে সর্বনাশ ঘটে শিশুর?

উন্নয়নশীল দেশে যৌন সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ ও প্রতিকার

উন্নয়নশীল দেশে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়া একটি জটিল সামাজিক সমস্যা, যার পেছনে বহু কারণ কাজ করে। জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের গবেষণায় এই সমস্যার নানা দিক উঠে এসেছে। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ তুলে ধরা হলো—

১.

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ: ক. পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা: অনেক অনুন্নত সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এতটাই গভীরে প্রোথিত যে নারীর ওপর সহিংসতা স্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হয় এবং প্রায়ই ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করা হয়। খ. ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ: যুদ্ধ বা সামাজিক অস্থিরতার সময় ধর্ষণকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ. ভুক্তভোগীর নীরবতা ও বিচারহীনতা: সামাজিক লজ্জা, প্রতিশোধের ভয় এবং বিচার না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই অভিযোগ করে না।

২. আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা: ক. দুর্বল আইন ও প্রয়োগের অভাব: অনেক দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন দুর্বল এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয় দুর্নীতিগ্রস্ত, নয়তো অপরাধ দমনে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। খ. বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা: মামলার নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগে, অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রভাব বা দুর্নীতির কারণে শাস্তি এড়িয়ে যায়।

৩. অর্থনৈতিক কারণ: ক. দারিদ্র্য ও বেকারত্ব: অর্থনৈতিক সংকট ও হতাশা পারিবারিক সহিংসতা এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে তোলে। খ. মানব পাচার ও যৌন শোষণ: দরিদ্র নারী ও শিশুরা পাচার ও যৌন শোষণের শিকার হয়, যা অপরাধের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।

আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুটি কী বলে গেল১৬ ঘণ্টা আগে

৪. গণমাধ্যম ও প্রযুক্তির প্রভাব: ক. পর্নোগ্রাফি ও নারীবিদ্বেষী কনটেন্ট: অবাধে সহিংস ও অসম্মতিসূচক যৌন কনটেন্টের প্রসার মানুষকে বাস্তব জীবনে নিষ্ঠুর করে তুলতে পারে। খ. সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্ল্যাকমেল: প্রযুক্তি ব্যবহার করে হুমকি, প্রতারণা, ব্ল্যাকমেল ও সাইবার নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে।

কীভাবে এটি প্রতিরোধ করা যায়? গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। আজকের দিনে প্রতিটি কিশোর ও যুবকের হাতে মোবাইল, যেখানে সহজেই পাওয়া যায় অশ্লীল কনটেন্ট। পর্নোগ্রাফির বিস্তার কেবলই একটি বিনোদনমাধ্যম নয় বরং এটি অপরাধপ্রবণতা উসকে দিচ্ছে। নানা ধরনের পর্নোসাইট, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের রিল, টিকটক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের সমাজে যৌন প্রবৃত্তিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে, যেখানে নারীদের শুধু ভোগের বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সরকার পর্নোসাইটগুলোর ওপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অশ্লীল কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণে পৃথক টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে। প্রযুক্তিগতভাবে ফিল্টারিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

কী করণীয়

১. আইনি ও নীতিগত পদক্ষেপ: ক. কঠোর আইন ও দ্রুত বিচার: দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করা ও শাস্তি কার্যকর করা। খ. ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা ও সহায়তা: নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, পুনর্বাসন ও বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা। গ. বিচার ও পুলিশ প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে লিঙ্গ-সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ দেওয়া।

২. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন: ক. শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, পরিবার ও সমাজে লিঙ্গসমতা ও যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা। খ. কমিউনিটি নজরদারি: স্থানীয় পর্যায়ে অপরাধ ঠেকাতে সক্রিয় সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

৩. অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: ক. নারীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি: অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীদের সহিংসতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে পারে। খ. সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: ভুক্তভোগী ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান।

৪. প্রযুক্তি ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ: ক. ডিজিটাল নীতিমালা শক্তিশালীকরণ: অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে নারীবিদ্বেষী ও সহিংস কনটেন্টের বিস্তার রোধ করা। খ. নিরাপদ অভিযোগ ব্যবস্থা: ভুক্তভোগীরা যাতে সহজে ও গোপনে অভিযোগ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা।

অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা

১. ভারতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট ও নির্ভয়া ফান্ড: ২০১২ দিল্লি গণধর্ষণ-কাণ্ডের (নির্ভয়া কেস) পর ভারত দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু করে। নারীদের সুরক্ষায় নির্ভয়া ফান্ড গঠন করা হয়, যার মাধ্যমে জরুরি সহায়তা ব্যবস্থা, আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ ও ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার তৈরি করা হয়। এখন অনেক মামলার নিষ্পত্তি কয়েক মাসের মধ্যেই হচ্ছে, যা আগে বছরের পর বছর লেগে যেত। মানুষ আগের চেয়ে বেশি অভিযোগ দায়ের করছে, কারণ সচেতনতা বেড়েছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, বিশেষ করে নির্বিচার দোষীদের শাস্তি না হওয়া বড় সমস্যা।

২. রুয়ান্ডার গণহত্যার পর নারীবান্ধব সংস্কার: ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর, রুয়ান্ডা নারী নির্যাতন ঠেকাতে কঠোর আইন ও জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা (জিবিভি) কমিটি গঠন করে। নারীদের সংসদে ৬০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়, যা নীতি নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। কঠোর আইন ও লিঙ্গসচেতন নীতি থাকায় ধর্ষণের হার অনেক কমেছে। রুয়ান্ডা এখন নারীর ক্ষমতায়নের মডেল হিসেবে পরিচিত।

৩. সুইডেনের সম্মতিভিত্তিক ধর্ষণ আইন: ২০১৮ সালে সুইডেন একটি নতুন আইন পাস করে, যেখানে বলা হয় স্পষ্ট সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে। সরকার জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন চালায়, যাতে সবাই বুঝতে পারে সম্মতি কাকে বলে। ধর্ষণের মামলা আগের চেয়ে বেশি দায়ের করা হচ্ছে, কারণ ভুক্তভোগীদের আর প্রমাণ করতে হচ্ছে না যে তারা বাধা দিয়েছিল। এই নীতিটি শাস্তির চেয়ে প্রতিরোধের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়।

৪. দক্ষিণ আফ্রিকার থুথুজেলা কেয়ার সেন্টার (টিসিসি): দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ষণের হার বিশ্বের অন্যতম বেশি, তাই সরকার থুথুজেলা কেয়ার সেন্টার চালু করে। এই কেন্দ্রগুলোয় মেডিকেল, আইনি ও মানসিক সহায়তা একসঙ্গে পাওয়া যায়, ফলে ভুক্তভোগীদের আলাদা জায়গায় যেতে হয় না। ধর্ষণের শিকার মানুষ দ্রুত চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা পাচ্ছে। শাস্তির হার ৪ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশ হয়েছে, কারণ ভুক্তভোগীরা সহজেই ন্যায়বিচার পাচ্ছে।

শুধু কঠোর শাস্তি দিলেই হবে না

বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড ও কমিউনিটি পুলিশিং রয়েছে। ২০২০ সালে দেশে ধর্ষণের ঘটনা বাড়তে থাকায় সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সংশোধন এনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে।

কমিউনিটি পুলিশিং চালু করা হয়, যাতে স্থানীয় মানুষ সহজেই অভিযোগ করতে পারে। কঠোর শাস্তির কারণে কিছুটা ভীতি তৈরি হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাস্তির চেয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বেশি দরকার। নারীবাদী সংগঠনগুলো বলছে, শুধু কঠোর শাস্তি দিলেই হবে না, বরং পুলিশের প্রশিক্ষণ ও ভুক্তভোগীদের সহায়তাব্যবস্থাও উন্নত করতে হবে।

আমাদের এ বিষয়ে কঠোর আইন ও দ্রুত বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণের শাস্তি দ্রুত কার্যকর করতে হবে। পরিবার থেকে স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান—সর্বত্র সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে, যেন অপরাধী বুঝতে পারে, সে সমাজে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। এ সমস্যার সমাধান শুধু কঠোর শাস্তি দিয়ে হবে না, বরং সামাজিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, আইনের কার্যকর প্রয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমন্বিত প্রচেষ্টায় একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। সময় এসেছে সবাই মিলে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার।

আমিমুল এহসান স্থপতি-নগরবিদ

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর ব যবস থ ক র যকর কনট ন ট সহ য ত সমস য সরক র অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

করের চাপ কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে করের চাপ কমানোর দাবি জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, করজাল বৃদ্ধি না পাওয়ায় যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপরই করের চাপ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি করহারের চেয়েও প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি কর দিতে হয় তাঁদের। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের যে হয়রানি করেন, তা বন্ধ করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় এ দাবিগুলো জানান বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। এনবিআর এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল বুধবার এই সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

পরামর্শক সভায় বিভিন্ন খাতের প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী নেতা বাজেটে বাস্তবায়নের জন্য নানা দাবি তুলে ধরেন। শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতাদের জন্য এই সীমা পাঁচ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো জরুরি। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষদের নিত্যপণ্য কিনতে আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এই বাস্তবতায় বিদ্যমান করকাঠামো তাঁদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

এ ছাড়া পণ্য রপ্তানিতে পাঁচ বছরের জন্য উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ করা, আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা, স্থানীয় পর্যায়ে সব পণ্য সরবরাহে মূসক ২ শতাংশ নির্ধারণ, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এইচএস কোডে ভুলের জন্য জরিমানার যে বিধান আছে, সেটি বাতিলের সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই।

অন্যদিকে বাজেটে করহার না কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, করহার আর কমানো সম্ভব নয়। তবে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা থাকবে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সব কথা হয়তো শুনতে পারব না। কারণ, সরকারের রাজস্ব আয় কমানো যাবে না। সরকার চালাতে রাজস্বের প্রয়োজন।’

করজাল বাড়ানোর ওপর জোর

করজাল বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, করজাল বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। দেশে ১ কোটি ১৪ লাখ করদাতা রয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ লাখ রিটার্ন দেন, যাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেন। ফলে এখানে গুণগত পরিবর্তন দরকার। করজাল না বাড়িয়ে বর্তমান করদাতার ওপর বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এতে রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে করদাতাদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হয়।

সরকারের মোট রাজস্ব আহরণের ৮৪ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসে—এমন তথ্য দিয়ে ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি রাজীব চৌধুরী বলেন, অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে কর আহরণ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ দেশের অর্থনীতিতে ৬০-৭০ শতাংশ অবদানই এই খাতের।

তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি কর অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান রাঙামাটি চেম্বারের প্রতিনিধি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মানুষের মন থেকে করভীতি দূর করতে হবে। তাহলে স্বচ্ছন্দে কর দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

গ্যাস-বিদ্যুৎ চান ব্যবসায়ীরা

কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেও গ্যাস–বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরাসহ অনেকেই কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করেছেন। আমরা ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছি। তবে দুই বছরেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। আমরা বিদেশিদের বিনিয়োগের জন্য ডাকছি। অথচ নিজের দেশের উদ্যোক্তারা জ্বালানিসংকটে ভুগছেন। এটা অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।’

মোস্তফা কামাল আরও বলেন, সবাই করজাল বাড়ানোর কথা বলেছেন। বাস্তবতা হলো, যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপর আরও বেশি করের চাপ আসে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকের ব্যাংক হিসাব ও করনথি তল্লাশি করা হচ্ছে। এ ছাড়া তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ঢালাওভাবে তল্লাশি করে ব্যবসায়ীদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে জন্য এনবিআরকে অনুরোধ জানান।

সিরামিকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে সিরামিক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সিরামিক পণ্যের মূল কাঁচামাল হিসেবে যে মাটি আমদানি করা হয়, তার মধ্যে ২০-৩০ শতাংশ পানি থাকে। এটি বাদ দিয়ে শুল্কায়ন করা হলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।’

ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমানোর দাবি

ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমিয়ে ৯ শতাংশ করার দাবি জানান আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের পরিচালক আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি সর্বমোট ১৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি কমানো গেলে গ্রাহকেরা ফ্ল্যাট নিবন্ধনে আগ্রহী হবেন।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘নিবন্ধন ফি কমানোর ক্ষেত্রে জমি বা ফ্ল্যাটের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে বড় সমস্যা। এটা ঠিক করা গেলে নিবন্ধন ফি ৯ শতাংশ করা হলেও সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। এটার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। হয়তো একদিন সফল হব।’

নির্মাণ খাতের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান ইস্পাতশিল্পে সরকারের বিশেষ নজর দাবি করেন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম। তিনি বলেন, ‘কাস্টমসের অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। এক টন স্ক্র্যাপ আনতে ১ হাজার ২০০ টাকা কর দিই। কিন্তু চালানে কোনো স্ক্র্যাপ ৫-৭ ফুট দীর্ঘ হলেও হয়রানি করা হয়। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হয়। এখান থেকে বের হতে হবে।’

শুল্ক কমান, রপ্তানি বাড়বে

প্লাস্টিকের খেলনা তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে রপ্তানি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, খেলনাশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। দেশে কারখানা গড়ে ওঠায় খেলনা আমদানি কমে গেছে। রপ্তানিও হচ্ছে অনেক দেশে।

সিলেট চেম্বারের প্রতিনিধি হিসকিল গুলজার বলেন, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে। সেখান থেকে দিনে ১২-১৪টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট যাচ্ছে। হ্যান্ডলিং চার্জসহ অন্যান্য মাশুল কমানো গেলে পণ্য রপ্তানি বাড়বে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ। তিনি বলেন, ‘একসময় যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে বিটিএমএ ছাড়পত্র দিত। কোনো বিতর্ক হয়নি। এনবিআর পুরো বিষয়টি নিজের হাতে নেওয়ার পর জটিলতা বেড়েছে। দেখা যায়, ৩০ হাজার টাকা শুল্ক–কর জমা দিতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।’

ভারত থেকে বেনাপোল দিয়ে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন।

নিট পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান প্রশাসন বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সেবা মসৃণ হয়েছে। তবে বন্ড কমিশনারেট কার্যালয়ের নিচের দিকে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সেখানে নজর দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু।

সম্পর্কিত নিবন্ধ