জ্যাক মা। চীনা ধনকুবের। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আলিবাবা থেকে অবসরে যান চীনের শিক্ষক দিবসে। ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা জ্যাক নিজেই এই দিনটিকে বিদায়ের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। বিদায়বেলা ৬০ হাজার কর্মীর সামনে দেওয়া জ্যাক মার বক্তৃতা থেকে অনুপ্রেরণার কথা তুলে এনেছেন ইমাম হোসেন মানিক

আজকের এই দিন, এই মঞ্চ আমার চেয়ে আলিবাবার সাফল্য এবং প্রতিষ্ঠানটির নিয়ম-শৃঙ্খলার কথা বেশি মনে করিয়ে দিচ্ছে। বদলাচ্ছে পৃথিবী। এই বদলের প্রভাবও পড়ছে আমাদের ওপর। ফলে সামনে আসছে নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রকৃতিও যাচ্ছে খারাপের দিকে। বাড়ছে আমাদের দুশ্চিন্তা। দরজায় দাঁড়িয়ে যেন টোকা দিচ্ছে নতুন দিন। নতুন হাওয়া। নতুন দিনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন ও তার ব্যাপকতা এবং মানবিকতা। এই তিনটি লক্ষ্য যদি প্রযুক্তির হাত ধরে আমরা অর্জন করতে না পারি, তবে পৃথিবীর আলো-বাতাস আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে আমাদের জন্য।
উদারতাই বড় শক্তি
এই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি নিজেকে বড় প্রতিষ্ঠান বা সেরা প্রতিষ্ঠানে দেখতে না পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। যে প্রতিষ্ঠানেই থাকুন না কেন, আপনার উদারতা এখন বড় শক্তি। এই শক্তি বলে আপনি ছোট প্রতিষ্ঠানে থেকেও দুনিয়া জয় করতে পারবেন। কেউ কেউ মনে করে বড় প্রতিষ্ঠানে তেমন ভুল হয় না। এটি ভুল ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। আশপাশের অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানের মতোই আলিবাবার ভুলের স্তূপ অনেক বড়। তবে আমরা এই ভুল থেকে ফুল ফুটিয়েছি। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করেছি। এই ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত অর্থকেন্দ্রিক ছিল না। প্রতিষ্ঠান এবং মানবিকতাও ছিল আমাদের সিদ্ধান্তের শরীরজুড়ে।
প্রযুক্তি শুধুই ভালোর জন্য
ভালো এবং খারাপ সব কিছুতেই থাকে। আমি বিশ্বাস করি প্রযুক্তি শুধু ভালোর জন্য। এটি মানুষের হতাশা তাড়িয়ে নতুন গতির সঞ্চার করে। স্বপ্ন দেখায় নতুন করে। ভাবতে শেখায় তুমুল গতিতে। আলিবাবার ২০ বছরের যে জার্নি তাতে চোখ রাখলে বলতেই পারি যে, আগামীর দিনগুলোতে এ প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিতে ভর করে তুমুল গতিতে ছুটে চলবে। গতির এই ট্র্যাকে আলিবাবা তুলে আনবে  বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও তাদের কর্মীদের।
কেন করি এত অহংকার!
কত জায়গায় ঘুরেছি ব্যবসার কাজে। একবার গ্রিনিচ মানমন্দির ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে চোখ বড় করে ছায়াপথ ধরে ঘুরছি তো ঘুরছি! একসময় গোটা ছায়াপথ শেষও করে ফেলি। খুঁজে পাইনি সূর্য এবং প্রিয় পৃথিবীটাকে। তখন নিজেকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে যাই। এত বড় ছায়াপথে পৃথিবীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না অথচ আমি এই পৃথিবীর কোনো এক কোণে পড়ে থাকা কোনো নচ্ছাড়! তবু এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে উপভোগ্য। অনেক কিছুই এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা নিয়ে কাজ করা যায় অনায়াসে। আমি আগ্রহ নিয়ে এসবে পড়ে থাকতে চাই।
মানবিকতা জাগিয়ে তোলার কাজে.

..
প্রত্যেকের একটা নিজস্ব জগৎ থাকে। সেই জগৎজুড়ে ছড়িয়ে থাকে রাজ্যের স্বপ্ন। আলিবাবা আমার তেমনি অসংখ্য স্বপ্নের একটি।
মানুষ সেই স্বপ্নের পেছনে ছোটে। আমিও ছুটব। চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দেওয়া মানে হাত-পা গুটিয়ে অবসরে চলে যাওয়া নয়। নতুন করে ব্যস্ততায় ডুব দেওয়া। শিক্ষা, পরিবেশ রক্ষা এবং মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগিয়ে তোলার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাই। এ কাজগুলোর অপেক্ষাই যেন করেছি এতদিন ধরে।
প্রিয় সবুজের কাছে
অপেক্ষার প্রহর গোনা হয়তো শেষ। কাল থেকে জীবন বইয়ের নতুন পৃষ্ঠা উল্টাব। চলে যাব প্রিয় সবুজের কাছে। সবুজই আমার প্রাণ! এই প্রকৃতি আর মানবিকতার কাছ থেকে আমি অবসর চাই না। তাদের জন্য মাঠে নামব কাল থেকে। তাদের সঙ্গে পথচলার নতুন অধ্যায় শুরু করব জীবনের। সেই জীবন পাহাড় ধরে কখনও আকাশপানে ছুটবে, কখনও ঝরনা থেকে গড়িয়ে নদী-সাগর হয়ে বয়ে চলবে অনন্ত পথের দিকে। এই পথে দেখা হবে আমাদের! 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আল ব ব আম দ র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

চিনি-লবণের অনুপম পাঠ

চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।

শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।

সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।

অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।

বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।

ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।

পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।

মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চেন্নাইয়ের বিদায়, অবসরের ইঙ্গিত দিলেন ধোনি!
  • মিষ্টি মেয়ের গল্প
  • ছয় কোটি শ্রমিক রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে
  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • ৩ কর্মকর্তার অবসর ও বরখাস্তের আদেশ আদালতে বহাল
  • ২১ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করলো বিএসইসি
  • বাবার মরদেহ দুই বছর লুকিয়ে রাখেন সন্তান
  • নির্মাতার ঘোষণার অপেক্ষায় চিত্রাঙ্গদা
  • শিশুর মাথা ঘামে কেন
  • কাঠফাটা রোদ্দুরে তপ্ত হাওয়া