মেয়েদের মাসিকের সময় প্রচণ্ড ব্যথা বা যন্ত্রণার পেছনে একটি কারণ বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যমান, তা হলো এন্ডোমেট্রিওসিস। এতে জরায়ুর অভ্যন্তরীণ আস্তরণের মতো টিস্যু (এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু) জরায়ু ছাড়াও অন্যত্র—যেমন ডিম্বাশয়, জরায়ু বা তলপেটে (পেলভিক অঞ্চলে) বিকশিত হতে থাকে। মাসিকের সময় জরায়ুর পাশাপাশি এসব জায়গায়ও রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ধীরে ধীরে এসব জায়গার টিস্যু বা কলাগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে লেগে যায়। পরে দেখা দেয় নানা জটিলতা। 

এন্ডোমেট্রিওসিসের সঠিক কারণ এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।

এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে সচেতনতা

এন্ডোমেট্রিওসিসের উপসর্গ সম্পর্কে অনেক নারী জানেন না, জানলেও কী করতে হবে, কীভাবে এটি নির্ণয় বা চিকিৎসা করা হয়, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। এন্ডোমেট্রিওসিসের কিছু সাধারণ উপসর্গ রয়েছে, যেমন—

মাসিকের সময় বা তার আগে ও পরে পেটে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।

মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত বা অনিয়মিত মাসিক হওয়া।

যৌনমিলনের সময় ব্যথা অনুভূত হওয়া।

গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া।

পেটে চাপ অনুভূত হওয়া, পিঠে ব্যথা বা শৌচকর্মের সময় ব্যথা হওয়া।

ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য বা মূত্রাশয়ের সমস্যা। এ ধরনের সমস্যা দেখলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণ

এন্ডোমেট্রিওসিসের সঠিক কারণ এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি। তবে কিছু কারণ বা ঝুঁকি–ফ্যাক্টর পাওয়া গেছে, যেগুলো এই রোগের জন্য দায়ী হতে পারে—

পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে, পরবর্তী প্রজন্মেও এটি হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

যদি জরায়ুর ভেতরের স্তর সঠিকভাবে মেনস্ট্রুয়াল ফ্লো হতে না পারে, তবে তা শরীরের বাইরে গিয়ে বৃদ্ধি পেতে পারে।

দুর্বল ইমিউন সিস্টেমে শরীরের অন্যান্য অংশে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, যা এন্ডোমেট্রিওসিস সৃষ্টি করে।

চিকিৎসা

এন্ডোমেট্রিওসিসের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তবে এর বিভিন্ন উপসর্গ কমাতে এবং রোগীর জীবনযাত্রা সহজ করতে কয়েকটি চিকিৎসাপদ্ধতি রয়েছে। যেমন—

ব্যথা কমাতে ব্যথানাশক, যেমন প্যারাসিটামল বা ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া হরমোন থেরাপিও সাহায্য করতে পারে।

ওষুধের মাধ্যমে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সার্জারি করা হতে পারে। এ ধরনের সার্জারিতে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যুগুলো সরিয়ে ফেলা হয়, যা ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ কমাতে সাহায্য করে।

পেটের ব্যথা কমাতে কিছু ফিজিওথেরাপি–পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া মানসিক সমর্থন এবং কাউন্সেলিংও রোগীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে।

ডা.

শারমিন আব্বাসি বন্ধ্যত্ববিশেষজ্ঞ ও গাইনোকোলজিস্ট

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স ক র সময় উপসর গ

এছাড়াও পড়ুন:

গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন

অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।

অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।

আরো পড়ুন:

১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের

দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের

সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।

সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।

গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।

অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। 

অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা। 

তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”

অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।

ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।

সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।

অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”

রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।

তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”

ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পিসিওএস এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা
  • গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
  • প্রোস্টেট ক্যানসারের উপসর্গগুলো আপনার জানা আছে কি