ঘুষের টাকা উসুলে বাড়তি কোপ গোলপাতায়
Published: 19th, March 2025 GMT
শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পারে বেড়িবাঁধের গা ঘেঁষে সুন্দরবন থেকে কেটে আনা গোলপাতা স্তূপ করে সাজিয়ে রাখছেন বাওয়ালিরা। তীরে ভেড়ানো আছে গোলপাতা বোঝাই বড় নৌকা। ৫০০ মণের একেকটি নৌকায় বোঝাই করা হয়েছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ পাতা। নৌকার চারপাশে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা। গোলপাতার ঝাঁপির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে সুন্দরী-পশুরসহ মূল্যবান গাছের খণ্ড।
মঙ্গলবারের এই চিত্রটির পেছনে লুকিয়ে আছে বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ঘুষবাণিজ্যের গল্প। চলতি গোলপাতা কাটার মৌসুমে বাওয়ালিদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধার জন্য এসব কর্মকর্তা নৌকাপ্রতি আদায় করেছেন ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। প্রতি নৌকায় সাধারণত সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল বা ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। এ জন্য প্রতি কুইন্টাল গোলপাতায় বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়। কিন্তু ঘুষ দেওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাওয়ালিরা এবার প্রতি নৌকায় চার-পাঁচ গুণ পাতা সংগ্রহ করছেন। পাশাপাশি কেটে আনছেন মূল্যবান গাছও।
১৩ মার্চ সুন্দরবনের মূল্যবান কাঠ বোঝাই কয়েকটি নৌকাসহ ১০ বাওয়ালিকে আটক করেছিল কোস্টগার্ড। এই সূত্রে অনুসন্ধান চালিয়ে বন বিভাগ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনা রেঞ্জে প্রথম দফায় ৮৯টি নৌকাকে গোলপাতা কাটার অনুমতি দিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করেছে বন বিভাগ। তবে এর বিপরীতে বাওয়ালিদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নৌকাপ্রতি ৩০ হাজার টাকা হারে আদায় করা হয়। সব মিলিয়ে এর পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ টাকা।
সুন্দরবনের জেলেরা জানিয়েছেন, এবার বাওয়ালিরা গোলপাতার পাশাপাশি বনের অনেক মূল্যবান গাছ কেটে নিয়ে গেছেন। বনে ঢুকে ইচ্ছামতো ছোট-বড় সুন্দরী, গেওয়া, পশুর গাছ কেটে তছনছ করে ফেলেছেন তারা। অতীতে এমন ক্ষতি ঘটেনি বলেও জেলেদের ভাষ্য।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা রেঞ্জে গোলপাতা কাটার মৌসুম ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে, যা আগামী ৩১ মার্চ শেষ হবে। প্রথম দফায় ২৮ দিনের অনুমতি পেয়ে ৮৯টি নৌকায় গোলপাতা কেটে লোকালয়ে ফিরেছেন বাওয়ালিরা। একেকটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১৮৬ কুইন্টাল বা ৫০০ মণ গোলপাতা বহনের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। আহরণ করা প্রতি কুইন্টাল গোলপাতায় বন বিভাগকে ৬০ টাকা করে রাজস্ব দিতে হয়।
চলতি মৌসুমে বন কর্মকর্তাদের বাড়তি ঘুষ ও ডাকাতদলের চাঁদা দিতে গিয়ে দুই-তিন গুণ খরচ হচ্ছে বাওয়ালিদের। এমন দাবি করেন সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা বাওয়ালি আব্দুস সালাম। এবার তাঁর নৌকায় বাড়তি খরচই হয়েছে ৭০০ হাজার টাকা। সালাম বলেন, ‘এ মৌসুমে ফরেস্টারদের ঘুষ ও ডাকাতের চাঁদার টাকা দিতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়তি হয়েছে। এর আগে কোনো মৌসুমে এত টাকা বাড়তি খরচ করতি হয়নি। নৌকার পাস (অনুমতি) কাটতি সরকারের খাতে ১২ হাজার টাকা জমা দিতি হলিও ফরেস্টারদের ঘুষ দিতি হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এরপরও ডাকাতির চাপ সামলাতে হয়েছে। এ কারণে গোলপাতার সঙ্গে কাঠও আনতি হয়েছে।’
‘বনে ঢুকলি ঘুষ দিতিই হবে। না হলি নানা হয়রানি।’ এমন মন্তব্য করেন আরেক বাওয়ালি খলিলুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, ‘জরিমানা তো গুনতি হবে, আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলি মামলায় ফাঁসায়ে দেবে।’ আগের চাইতে এখন আরও বেশি ঘুষ দিতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ঘুষের টাকা উসুল করতি গেলি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত গোলপাতার সাথে কাঠ কেটে আনা ছাড়া উপায় নেই।’
চলতি মৌসুমে ১২টি নৌকার পাস সংগ্রহে সহায়তা করেন বাওয়ালি জাহাঙ্গীর আলম। তাঁর ভাষ্য, ‘প্রতিটি নৌকার পাশ নিতি ১৮ হাজার টাকা নিয়েছে বন বিভাগ। এ ছাড়া আলাদাভাবে কুপ (জোন) অফিসারকে খুশি করতি হয়েছে প্রতিটি নৌকার মহাজনকে। বন কর্মকর্তারা খুশি থাকলে বাওয়ালিরাও নানা সুযোগ-সুবিধা পান। এভাবেই মিলেমিশে ব্যবসা করতি হচ্ছে।’
সুন্দরবন বাওয়ালি ফেডারেশনের সভাপতি মীর কামরুজ্জামান বাচ্চুর দাবি, এবার বন বিভাগের ঘুষের সঙ্গে ডাকাতের চাপও বেশি। ডাকাতের চাপ সামলাতে না পারলে আগামীতে কেউ আর রাজস্ব দিয়ে বনে ঢুকতে চাইবেন না।
খুলনা রেঞ্জের গোলপাতা কুপ (জোন) কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘বাওয়ালিদের কাছে আমার কোনো দাবিদাওয়া নেই। তারা কিছু দিলে ভালো কথা, না দিলেও কোনো দাবি নেই।’ গোলপাতার আড়ালে গাছ কাটার বিষয়ে প্রশ্নের জবাব তিনি এভাবে দেন, ‘প্রতিটি নৌকাকে পাহারা দেওয়া আমার একার পক্ষে সম্ভব হয় না।’ তবে এবার অতিরিক্ত গোলপাতা বহনের জন্য লক্ষাধিক টাকা জরিমানা আদায়ের তথ্যও দেন তিনি।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান জানান, গোলপাতার সঙ্গে বন থেকে কোনো গাছ কাটতে পারবেন না বাওয়ালিরা। এমনকি নৌকায় ঝুল হিসেবে কাঠ নেওয়ার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। বাওয়ালিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এমন অনৈতিক সুবিধা কেউ দিয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: য় বন ব ভ গ কর মকর ত স ন দরবন ক ইন ট ল ন র অন
এছাড়াও পড়ুন:
চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগের আহ্বান উপদেষ্টার
বাঘ পাচারকারী ও চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড়াতে হবে। বাঘ সংরক্ষণের সুফল জনগণের সামনে দৃশ্যমান করতে হবে।
বিশ্ব বাঘ দিবস ২০২৫ উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার রাজধানীর বন ভবনে আয়োজিত আলোচনা সভায় সচিবালয় থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেন, ‘‘বাঘ শুধু একটি বন্যপ্রাণী নয়, এটি বাংলাদেশের গর্ব ও জাতিসত্তার প্রতীক। যেমন আমরা সুন্দরবন নিয়ে গর্ব করি, তেমনি গর্ব করি রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়েও। সাহস, ভালোবাসা ও বীরত্বের প্রতীক হিসেবে আমরা বাঘকে দেখি। ক্রিকেটারদের ‘টাইগার’ নামে ডাকাও সেই আবেগের বহিঃপ্রকাশ।’’
সাম্প্রতিক বাঘ শুমারির ফল তুলে ধরে উপদেষ্টা জানান, কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কারণে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। তবে হরিণ শিকারে নিয়ন্ত্রণ, বারবার অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ এবং চোরা শিকার রোধে আরও কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ‘‘বাঘের মৃত্যু ও পাচারের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ-বাঘ দ্বন্দ্বও বেড়েছে। এজন্য সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় সামাজিক সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।’’
পাশাপাশি সুন্দরবনে অপরাধ বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘কারা চোরাকারবারি, আর কারা বিকল্প জীবিকার সুযোগ পেলে সেই পথ পরিহার করবে তাদের তালিকা তৈরি করে জানাতে হবে, যেন আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারি।’’
উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘‘আমাদের ঐতিহ্য রক্ষায়, পরিবেশ সংরক্ষণে এবং বাঘকে টিকিয়ে রাখতে সম্মিলিতভাবে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।’’
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
অনুষ্ঠানে ‘সুন্দরবনে সংঘাতপ্রবণ বাঘ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা’ এবং ‘টাইগারস্ অব দ্য সুন্দরবনস’ শীর্ষক দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। পাশাপাশি, সুন্দরবনভিত্তিক পটের গান পরিবেশন করেন স্থানীয় শিল্পীরা।
ঢাকা/এএএম//