স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য কমিশন সংবিধান ও আইন সংস্কারের পাশাপাশি কোনো কোনো আইনের বিভিন্ন ধারা বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে সাংবাদিকতার সুরক্ষায় আলাদা আইন করতে বলেছে কমিশন।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের প্রধান জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদসহ কমিশনের সদস্যরা প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন।

সাংবাদিকতার স্বাধীনতার পাশাপাশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, সাংবাদিকদের বেতন ও শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিটিভি, বেতার ও বাসসকে একীভূত করে একটি সংস্থার অধীনে আনা, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন’ করা, সাংবাদিকতা সুরক্ষায় আইন করাসহ ২১ ধরনের সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো অনতিবিলম্বে কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

গত বছরের ১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনের কার্যপরিধি ছিল গণমাধ্যমকে স্বাধীন, শক্তিশালী ও বস্তুনিষ্ঠ করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করা। কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সভাপতি অঞ্জন চৌধুরী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপরিচালক কামরুন নেসা হাসান, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস–এর সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক জাহিদ, সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সচিব আখতার হোসেন খান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি ফাহিম আহমেদ, মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির, দ্য ডেইলি স্টার–এর বগুড়া প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর উপসম্পাদক টিটু দত্ত গুপ্ত এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন।

প্রায় চার মাস কাজ করে কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর আগে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ইতিমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন।

প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। পরে কমিশনের প্রতিবেদনের কপি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়।

সাংবাদিকতার স্বাধীনতায় জোর

বাক্‌স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। এতে বাক্‌স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের বিষয়টি শুধু যুদ্ধাবস্থায় প্রযোজ্য হবে।

কমিশন বলেছে, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার বিষয়ে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের সংবিধানে আলাদা ও সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও সুইজারল্যান্ডের সংবিধানের মতো সাংবাদিকতার স্বাধীনতার গ্যারান্টির (নিশ্চয়তা) প্রশ্নটি সুনির্দিষ্টভাবে ও বিশদে লিপিবদ্ধ করা সমীচীন।

কমিশন বলেছে, ফৌজদারি মানহানির সব আইনের বিভিন্ন ধারা যেমন ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৯, ৫০০ এবং ৫০২ ধারা এবং ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারা বাতিল করা উচিত। সেই সঙ্গে সাংবাদিকদের মানহানিসংক্রান্ত অপরাধের বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে বলেছে কমিশন। এ ছাড়া অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৫ নম্বর ধারা সংশোধনসহ আরও কিছু আইনি সংস্কারের সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা বলেছে, বিদ্বেষমূলক বক্তব্যসংক্রান্ত দণ্ডবিধির ২৯৫ ক এবং ২৯৮ ধারা ও সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা বাতিল করা উচিত।

তথ্য অধিকার আইনের ৭ নম্বর ধারা সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতি রেখে বিধান যুক্ত করা উচিত বলে মনে করে কমিশন।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা সাংবাদিকতা সুরক্ষায় আইন করার সুপারিশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সুরক্ষা অধ্যাদেশের একটি খসড়াও করে দিয়েছেন।

সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বেতন

সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়েও সুপারিশ করেছে কমিশন। এ বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে শুরুর পদ, অর্থাৎ নবম গ্রেডের বেতন স্কেলের সঙ্গে সংগতি রেখে সাংবাদিকদের শুরুর পদের বেতন হতে পারে। সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য এটি হতে পারে। তবে ঢাকায় যেহেতু জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি, সে ক্ষেত্রে এখানকার সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ‘ঢাকা ভাতা’ যোগ করা যেতে পারে। এই ভাতা ঠিক করবে সরকার ও সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন পক্ষ মিলে।

প্রসঙ্গত, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ অনুযায়ী নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মূল বেতন শুরু হয় ২২ হাজার টাকা দিয়ে। এর সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা যোগ হয়। সব মিলিয়ে এই বেতন হয় ৩৫ হাজার টাকার বেশি।

সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হবে, তা জানতে চাইলে কামাল আহমেদ বলেন, শুধু সাংবাদিক নন, সম্পাদক ও প্রকাশকের যোগ্যতা কী হবে, সেগুলোও কমিশন বলেছে। কমিশন বলেছে, সাংবাদিকদের ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা একটি শর্তও যুক্ত করেছেন। সেটি হলো, এক বছর শিক্ষানবিশ থাকার পর পূর্ণ সাংবাদিকের মর্যাদা পাবেন।

কমিশন বলেছে, কোনো গণমাধ্যম নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র ছাড়া এবং বিনা বেতনে কোনো সাংবাদিককে অস্থায়ী, স্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে পারবে না। এক বছরের শিক্ষানবিশকালেও সম্মানজনক ভাতা দিতে হবে। তিন বছর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার পর ঢাকার বাইরের সাংবাদিকেরা নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে পদোন্নতি পাবেন।

মূল বেতনের বাইরে সাংবাদিকেরা বাড়িভাড়া, যাতায়াত ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, মূল বেতনের সমপরিমাণ উৎসব ভাতা, ঝুঁকি ভাতা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে), ফোন বিল, ইন্টারনেট বিল, প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং অবসর ভাতা কিংবা গ্র্যাচুইটি পাবেন। আর প্রতিবছরের শুরুতে আগের বছরের গড় মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাংবাদিকদের বেতন বৃদ্ধি পাবে। অন্যান্য ভাতার ক্ষেত্রে অন্তত দুই বছর পরপর মূল্যস্ফীতি সামঞ্জস্য করে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আর ক্যাম্পাস (বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি) সাংবাদিকদের জন্য একটি নিয়োগবিধি ও ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করার কথা বলেছে কমিশন। এ ছাড়া কোনো গণমাধ্যমে সাংবাদিককে সার্কুলেশন তদারকি ও বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা যাবে না বলে সুপারিশ করা হয়েছে।

‘ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া’

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একই কোম্পানি, গোষ্ঠী, ব্যক্তি, পরিবার বা উদ্যোক্তা যাতে একই সঙ্গে একাধিক গণমাধ্যমের মালিক হতে না পারে, সে জন্য বিশ্বের বহু দেশে ‘ক্রস-ওনারশিপ’ (টেলিভিশনের মালিক সংবাদপত্রের মালিক হতে পারেন না বা সংবাদপত্রের মালিক টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক হতে পারেন না) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও অচিরেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করে কমিশন। ক্রস-ওনারশিপ নিষিদ্ধ করে অধ্যাদেশ করা যায়।

এ বিষয়ে কমিশন মনে করে, যেসব ক্ষেত্রে এটি বিদ্যমান, সেগুলোয় পরিবর্তন আনার নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তাদের ব্যবসা পুনর্গঠনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া প্রয়োজন। এগুলো নানা পদ্ধতিতে হতে পারে। যেসব কোম্পানি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, পরিবার একই সঙ্গে টেলিভিশন ও পত্রিকার মালিক, তারা যেকোনো একটি গণমাধ্যম রেখে অন্যগুলোর মালিকানা বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর করে দিতে পারে। অথবা দুটি গণমাধ্যমের (টেলিভিশন ও পত্রিকা) সাংবাদিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একত্র করে আরও শক্তিশালী ও বড় আকারে একটি গণমাধ্যম (টেলিভিশন অথবা পত্রিকা) পরিচালনা করতে পারে।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একক মালিকানায় একই ভাষায় একাধিক দৈনিক পত্রিকা বা একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট করে। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের যে প্রভাবক ক্ষমতা, তা নিজ স্বার্থে কেন্দ্রীভূত করে। সে কারণে এই ব্যবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এ জন্য ‘এক উদ্যোক্তার একটি গণমাধ্যম’ (ওয়ান হাউস, ওয়ান মিডিয়া) নীতি কার্যকর করা গণমাধ্যমের কেন্দ্রীকরণ প্রতিরোধের সেরা উপায় বলে মনে করে কমিশন।

মাঝারি ও বৃহৎ গণমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে সর্বসাধারণের জন্য শেয়ার ছাড়া ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া এবং উদ্যোক্তা পরিচালক ও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শেয়ার ধারণের সীমা ২৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত করা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে শেয়ার বণ্টন বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

বেসরকারি টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন

কমিশন বলছে, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি হয়নি। এমনকি লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তির কোনো পূর্বযোগ্যতা সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনা এবং কিছুটা ব্যবসায়িক পরিচিতির ভিত্তিতে এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালন নীতিমালায় প্রাথমিক পর্যায়ে পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স প্রদান ও পরবর্তী সময়ে তাদের সুষ্ঠু কার্যক্রম পর্যালোচনা করে নবায়ন করার কথা বলা আছে। এ পটভূমিতে গত দেড় দশকে দেওয়া সব লাইসেন্স পর্যালোচনার দাবি রাখে।

কমিশন এফএম রেডিওর বিষয়ে কিছু অযৌক্তিক বিধান আছে উল্লেখ করে সেগুলো তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া অনলাইন পোর্টাল নিবন্ধন নীতিমালা হালনাগাদ করা, ইতিমধ্যে নিবন্ধন দেওয়া অনলাইন পোর্টালের বিষয়ে পর্যালোচনা করাসহ আরও কিছু সুপারিশ করেছে কমিশন।

বিটিভি, বেতার ও বাসসকে একীভূত করার প্রস্তাব

বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) একীভূত করে একটি প্রতিষ্ঠান করার সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে কমিশন বলছে, স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকিয়ে রাখার চেয়ে বাসসকে বিটিভি ও বেতারের নতুন সম্মিলিত প্রতিষ্ঠানের ‘বার্তা বিভাগ’ হিসেবে একীভূত করাই হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার। বিটিভি, বেতার ও বাসসের সমন্বয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানকে ‘বাংলাদেশ সম্প্রচার সংস্থা বা জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা’ নামকরণ করা যেতে পারে বলে সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এই প্রতিষ্ঠানে তিনটি বিভাগ থাকবে। এগুলো টেলিভিশন, বেতার ও বার্তা বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের প্রধান হিসেবে একজন পরিচালক থাকবেন এবং নতুন একীভূত সম্প্রচার সংস্থার প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল এবং প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের পরিবর্তে বাংলাদেশ গণমাধ্যম কমিশন করার সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবিত গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আইনের খসড়াও করে দিয়েছে সংস্কার কমিশন। এ ছাড়া প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটকে একীভূত করা এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করার সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

করপোরেট কর

কমিশন সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা নিরীক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের সুপারিশ করে বলছে, বর্তমান ব্যবস্থায় দুর্নীতি হচ্ছে। সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত করপোরেট ট্যাক্সের উচ্চহার (২৭ দশমিক ৫ শতাংশ) এই শিল্পকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করে কমিশন। তারা বলছে, তৈরি পোশাকশিল্পে এই হার ১৫ শতাংশ। করপোরেট ট্যাক্সের উচ্চহার ও অগ্রিম কর আদায়ের ধারা অব্যাহত থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। এটি শক্তিশালী গণমাধ্যম গড়ে তোলার পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। এ জন্য তা অচিরেই অপসারণ করা উচিত।

কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা আশা করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচিত সরকার সবাই এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর র স প র শ কর ছ র র স প র শ কর ছ ন কর র স প র শ র স ব ধ নত র স ব দপত র র ক ম ল আহম দ প রস ত ব ত ব যবস থ র সদস য আইন কর র জন য য গ যত সরক র আইন র বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের

এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।

চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।

টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর। 

গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।

দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।

সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত। 

শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।

মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।  

সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ