ইন্টারনেটে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ২৯৮টি ভুল তথ্য প্রচার
Published: 2nd, April 2025 GMT
চলতি বছরের মার্চে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ২৯৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে রাজনৈতিক বিষয়ে। এ–সংক্রান্ত ১০৫টি ভুল তথ্য ছড়ানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা মোট ভুল তথ্যের ৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া জাতীয় বিষয়ে ১০৩টি, আন্তর্জাতিক বিষয়ে ১২টি, ধর্মীয় বিষয়ে ৩৬টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে ৩টি, শিক্ষা বিষয়ে ৩টি, প্রতারণা বিষয়ে ১২টি এবং খেলাধুলা বিষয়ে ১৬টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে মার্চে।
বুধবার রিউমর স্ক্যানার তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, এর আগে গত জানুয়ারিতে ২৭১টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ২৬৮টি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিডিওকেন্দ্রিক ভুল তথ্য সবচেয়ে বেশি ছড়ানো হয়েছে। ২৯৮টি ভুল তথ্যের মধ্যে ১৪৩টি ভিডিওকেন্দ্রিক। এ ছাড়া তথ্যকেন্দ্রিক ভুল ছিল ১১০টি এবং ছবিকেন্দ্রিক ভুল ছিল ৪৫টি। শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ১৬৮টি, বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৯৭টি এবং বিকৃত হিসেবে ৩১টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গত মাসে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, সংখ্যার হিসাবে যা ২৭৩টি। এ ছাড়া এক্সে ৬২টি, টিকটকে সাতটি, ইউটিউবে ৪৪টি, ইনস্টাগ্রামে ২৬টি, থ্রেডসে অন্তত পাঁচটি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। ১৬টি ঘটনায় দেশের একাধিক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
গত বছর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ভুয়া তথ্য প্রচারের হার বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে রিউমর স্ক্যানার। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, গেল মার্চেও এই ধারাবাহিকতা দেখেছে তারা। গত মাসে ভারতীয় গণমাধ্যমে চারটি ঘটনায় বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে ভুয়া তথ্যের প্রচার করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল কিছু মাস ধরেই আলোচনায় রয়েছে। মার্চে এমন ২৬টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে অর্ধেক ঘটনাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতীয় অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গেল মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ১৫টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ভুল তথ্যগুলোর ধরন বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে সরকারের পক্ষে যায় এমন ভুল তথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব অপতথ্যের সবগুলোই সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টাদের নিয়েও ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে উল্লেখ করে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চে ২২টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে। এর মধ্যে মাত্র ৭৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই এসব অপতথ্য তাঁর বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে।
অন্যদিকে ২৩ শতাংশ ক্ষেত্রে ভুল তথ্যগুলো তাঁর পক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে। সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে জড়িয়ে দুটি (সবগুলোই বিপক্ষে), সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), আসিফ নজরুলকে জড়িয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে), সালেহউদ্দিন আহমেদকে জড়িয়ে দুটি (সবগুলোই বিপক্ষে), মো.
রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে উল্লেখ করে রিউমর স্ক্যানার তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, রিউমর স্ক্যানার গেল মাসের ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণে দেখেছে, এই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে (৭) জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এসব ভুল তথ্যের ৮৬ শতাংশই দলটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করার সুযোগ রেখেছে।
দলটির আমির শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে এই সময়ে দুটি অপতথ্য (সবগুলোই বিপক্ষে) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে এই সময়ে ছয়টি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) জড়িয়ে গত মাসে চারটি (৭৫ শতাংশই বিপক্ষে) ভুল তথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এই সময়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে একটি (পক্ষে) এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে দুটি (সবগুলোই পক্ষে) ভুল তথ্যের প্রচার করা হয়েছে।
দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে জড়িয়ে এই সময়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে ছয়টি অপতথ্য (৮৩ শতাংশই পক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। মার্চে দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে জড়িয়ে প্রচার হওয়া একটি ভুল তথ্য (পক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে এই সময়ে ৩৩টি ভুল তথ্য (৮৫ শতাংশই পক্ষে) প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। দলটিকে জড়িয়ে গত মাসে দুটি অপতথ্য (সবগুলোই বিপক্ষে) শনাক্ত করা হয়েছে। এই দলের শীর্ষ পদ অর্থাৎ আহ্বায়ক পদে রয়েছেন নাহিদ ইসলাম। তাঁকে জড়িয়ে গত মাসে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে গত মাসে। এ ছাড়া দলটির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহকে জড়িয়ে ছয়টি (সবগুলোই বিপক্ষে), সারজিস আলমকে জড়িয়ে তিনটি (সবগুলোই বিপক্ষে), তাসনিম জারাকে জড়িয়ে চারটি (সবগুলোই বিপক্ষে), হুমায়রা নুরকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে), আব্দুল হান্নান মাসউদকে জড়িয়ে একটি (বিপক্ষে) অপতথ্য প্রচার দেখা গেছে।
ভুল তথ্যের রোষানল থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও রক্ষা পায়নি উল্লেখ করে রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গেল মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে সাতটিসহ এই বাহিনীকে জড়িয়ে ২৩টি ভুল তথ্য প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। গত বছরের আগস্ট পরবর্তী সময়ে একক মাস হিসেবে এটিই সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে সর্বোচ্চ শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যের সংখ্যা। এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের বিষয়ে ছড়ানো তিনটি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর বাইরে র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে জড়িয়ে একটি করে ভুয়া তথ্যের প্রচার ছিল মার্চে।
কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতনের সময়টায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ফেব্রুয়ারিতে তিনটি অপতথ্যের শিকার হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে সংগঠনটির মুখপাত্র উমামা ফাতেমাকে জড়িয়ে একটি অপতথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
গেল মাসের ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, বিভিন্ন অঙ্গনের সুপরিচিত ব্যক্তি এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে গত মাসে ১৭টি মৃত্যুর গুজব প্রচার করা হয়েছে। মার্চে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত হয়েছে নয়টি। একই সময়ে ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করা হয়েছে পাঁচটি।
মার্চে ধর্ষণ–সম্পর্কিত খবর এবং এ–সংক্রান্ত তথ্য, ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে প্রচার বেড়ে যাওয়ার ঘটনা লক্ষ করা যায় বলে উল্লেখ করা হয় রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মার্চ মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনেও দাবি করা হচ্ছে, মার্চ মাসে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা গত ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এর ফলে জনমনে শঙ্কার অবকাশের সুযোগ নিয়ে অপতথ্যের প্রচার ছিল গত মাসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানার গেল মাসে ধর্ষণবিষয়ক অন্তত ২৭টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে। এর মধ্যে একক ঘটনা হিসেবে মাগুরায় আট বছরের এক শিশুর ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আটটি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে রিউমর স্ক্যানার।
গেল মাসে রমজান এবং ঈদ উদ্যাপন করেছে এ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এই দুটি বিষয়কে ঘিরে যথাক্রমে ১৬টি ও ছয়টি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।
গত মাসে গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটো কার্ড ব্যবহার করে ৩৮টি ঘটনায় দেশি ও বিদেশি ৩৯টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৪৫টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় রিউমর স্ক্যানারের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারে মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির নাম সবচেয়ে বেশি (১০) ব্যবহার করা হয়েছে। গণমাধ্যমটির পর জনকণ্ঠ (৫) ও আমার দেশ (৪)–এর নাম বেশি ব্যবহার করা হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র উমর স ক য ন র গ ল ম স ব যবহ র কর অপতথ য র র জন ত ক সরক র র উপদ ষ ট গত ম স স গঠন দলট র ইসল ম সবচ য ঘটন য
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।