বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বার্ন ইউনিট নির্মাণের দাবিতে রাস্তায় নেমে একাধিকবার বিক্ষোভ করেন নগরবাসী।  তবে অর্থ সংকটসহ নানা জটিলতায় এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি বার্ন ইউনিটের নির্মাণকাজ। বিশেষায়িত একটি শিশু হাসপাতাল স্থাপনে প্রকল্প অনুমোদন হলেও ভূমি জটিলতায় বছরের পর বছর সেটিও আটকা। শুধু বার্ন ইউনিট কিংবা শিশু হাসপাতালই নয়, স্বাধীনতার ৫৪ বছরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই নগরীতে গড়ে ওঠেনি বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল। 
এই অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের ‘সবেধন নীলমণি’ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল! সদর হাসপাতাল থাকলেও সেখানকার চিকিৎসাসেবা বেশ নাজুক। চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অবস্থাও করুণ। এখানে জ্বর-সর্দি ছাড়া অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন বাস্তবতায় জটিল রোগীকে চিকিৎসার জন্য এখনও ছুটতে হয় রাজধানী ঢাকায়। এতে একদিকে যেমন মানুষের চিকৎসা খরচ বাড়ছে, তেমনি রোগীর স্বজনকে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। এ পটভূমিতে আজ সোমবার নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। 
স্বাধীনতার এত বছর পরও চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাতে এমন ভঙ্গুর অবস্থার পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকদের দুষছেন অনেকেই। এ জন্য কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় কাঠামোও দায়ী বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। 
চট্টগ্রামে রয়েছে দেশের বেশির ভাগ ভারী শিল্প। জাহাজভাঙা, পোশাক কারখানা, কেমিক্যাল ডিপোর সংখ্যাও অনেক। আছে সমুদ্রবন্দর। ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামে জনসংখ্যাও বেড়েছে বহু গুণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও। তবে বাড়ছে না চিকিৎসার সহজলভ্যতা। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পোড়া রোগীদের একমাত্র ভরসা চমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে শয্যা আছে মাত্র ২৬টি। অথচ শয্যার বিপরীতে এখানে প্রতিদিন কয়েক গুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকে। এখানে একটু বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীর চিকিৎসা, আইসিইউ ও ইনফেকশন কন্ট্রোলের কোনো ব্যবস্থাও নেই। যে কারণে বেশি পোড়া রোগীকে ঢাকায় পাঠাতে হয়। 
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরও একই হাল। কয়েক বছর ধরে এই অঞ্চলে স্তন, জরায়ুমুখ, ফুসফুস, মুখগহ্বর, গলাসহ কয়েকটি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এখানে চিকিৎসার সুযোগ নেই। চমেক হাসপাতালে পুরুষ ও নারী রোগীর জন্য শয্যা রয়েছে মাত্র ৩০টি। ক্যান্সার শনাক্তে নেই প্যাট-সিটি স্ক্যানের ব্যবস্থা। রোগ শনাক্তে নেই মলিকুলার ল্যাবও। অথচ চিকিৎসকরা বলছেন, মলিকুলার ল্যাবের মাধ্যমে যে ফল পাওয়া যায়, তার ভিত্তিতেই নির্দিষ্ট থেরাপি দিতে হয় রোগীকে। সংকট রয়েছে চিকিৎসক-নার্সেরও।
চমেক হাসপাতালের কিডনি ওয়ার্ডও এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। ডায়ালাইসিস মেশিনের চেয়ে এখানে প্রতিদিন সেবা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা ১০ গুণ। পর্যাপ্ত মেশিনের অভাবে নির্দিষ্ট সময়ে ডায়ালাইসিস পরীক্ষা করাতে না পেরে অনেকের জীবন পড়ে হুমকিতে। 
এখনও বিশেষায়িত শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় এই অঞ্চলে শিশু স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও নাজুক। ১৫ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোনোটিতে নেই এনআইসিইউ ব্যবস্থা। বেসরকারিভাবে শহরের কিছু হাসপাতালে এই সেবা চালু হলেও শুধু এনআইসিইউ শয্যা বাবদ এক দিনে ভাড়া গুনতে হয় ২০ হাজার টাকার বেশি। 
এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সভাপতি ডা.

মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার পর চট্টগ্রামের অবস্থান হলেও স্বাস্থ্যসেবায় বন্দরনগরী এখনও অনেক পিছিয়ে। অথচ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের অবদান অনেক বেশি। এই অঞ্চলে এখনও একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি, এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য হতাশার। অনেক বছর ধরে শুনছি, একটি বিশেষায়িত বার্ন ইউনিট হচ্ছে। বাস্তবে কিছুই হয়নি। উল্টো এর নামে অনেক টাকা নষ্ট হয়েছে।’ 
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পার্থকের বাস্তব চিত্র বৈষম্যের বড় প্রমাণ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। অনেকে মুখে চট্টগ্রামকে দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিও বলেন। অথচ এখানকার স্বাস্থ্যসেবার মান এখনও রুগ্‌ণ। স্বাস্থ্য খাতের এমন ভঙ্গুর অবস্থার দায়ভার বিগত সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকরা এড়াতে পারেন না।’ 
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘চট্টগ্রামে বড় কোনো বিস্ফোরণ বা আগুনজনিত দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। সে কারণে একটু বেশি পুড়ে যাওয়া রোগীকে নিয়ে ছুটতে হয় ঢাকায়। আর যাদের ঢাকায় যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তারা চিকিৎসার অভাবেই মারা যান।’ 
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘পুরো অঞ্চলের কয়েক লাখ রোগীকে  চমেক হাসপাতালের ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ কারণে হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রোগীর চাপ।’
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব র ন ইউন ট র অবস থ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও

রংপুরের গংগাচড়ায় ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ঘিরে সহিংসতার শিকার হিন্দু পরিবারের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। তবে ঘটনার তিন দিন পরেও এলাকায় ফেরেনি অনেক পরিবার। আতঙ্কে এখনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে।

গত ২৭ জুলাই রাতে ওই গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলার আগে এলাকায় মাইকিং করে লোকজন জড়ো করা হয়।

পুলিশ, প্রশাসন ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, যারা হামলা করেছেন, তাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন ‘বহিরাগত’। পাশের নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন এসে হামলা চালিয়ে চলে যায়। হামলার সময় ২২টি ঘরবাড়ি তছনছ ও লুটপাট করা হয়। 

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প বসানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পুলিশ টহল। প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ঢেউটিন, কাঠ, চাল-ডাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করেছে এবং ঘরবাড়ি মেরামতের কাজও শুরু হয়েছে। তবু আতঙ্কিত পরিবারগুলো। 

ক্ষতিগ্রস্তদের একজন অশ্বিনী চন্দ্র মোহান্ত বলেন, “সেদিনের ঘটনা ছিল এক ভয়াবহ। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননাকারী কিশোরকে থানা হেফাজতে দিয়েছি। কিন্তু তারপরও ঘরবাড়ি রক্ষা হয়নি। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি এবং কিছু মুরুব্বি আমাদেরকে অভয় দিয়েছিলেন, কিন্তু রক্ষা হয়নি।” 

তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরাই অভিযুক্ত কিশোরকে থানায় সোপর্দ করেছি। তারপরও মিছিল নিয়ে এসে দুই দফায় আমাদের ২০ থেকে ২৫টি ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে লুটপাট করেছে তারা। এদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই অপরিচিত।” 

আরেক ভুক্তভোগী দেবেন্দ্র চন্দ্র বর্মন জানান, “প্রথমে অল্পসংখ্যক কম বয়সী কিছু ছেলে আসে। পরে হাজারো লোকজন এসে আমাদের বাড়িঘরে তাণ্ডব চালায়। অনেকেই এখনো আত্মীয়দের বাড়িতে। আমরা চরম আতঙ্কে আছি।”

রবীন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী রুহিলা রানী বলেন, “ছোট ছেলেটা যদি ভুল করে থাকে, আমরা তাকে থানায় দিয়েছি। কিন্তু তারপরও এমন ধ্বংসযজ্ঞ কেন? আমাদের গরু, সোনা-টাকা সব লুটে নিয়েছে। শুধু চাল-ডাল আর টিনে কি জীবন চলে?”

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম ও সদস্য সচিব আনিসুর রহমান লাকুসহ একটি প্রতিনিধি দল। তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণ করেন এবং পাশে থাকার আশ্বাস দেন।

গংগাচড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আল এমরান বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে কিশোরটিকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনা হয় এবং পরে আদালতের মাধ্যমে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখন পর্যন্ত কেউ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তারপরও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক নিরাপত্তায় নিয়োজিত।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহামুদ হাসান মৃধা বলেন, “অপরাধীদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হচ্ছে সহায়তা। পুলিশ ও সেনাবাহিনী পুরো এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করেছে।” 

উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের তথ্যমতে, হামলায় ১৫টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাতে ২২টি পরিবার বসবাস করতেন। ঘর মেরামতের পর কিছু পরিবার ফিরলেও অভিযুক্ত কিশোর ও তার চাচার পরিবারের কেউ এখনো ফিরে আসেনি।

ঢাকা/আমিরুল/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের
  • মেসি বনাম ইয়ামাল: ফিনালিসিমার সময়-সূচি ঘোষণা
  • গংগাচড়ায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি মেরামতের উদ্যোগ, আতঙ্ক কাটেনি এখনও