বর্তমান বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি ‘প্যারিয়া’ রাষ্ট্র রয়েছে। অনেকটা একঘরে হয়ে থাকা রাষ্ট্র। এগুলোর মধ্যে শীর্ষে উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, বেলারুশ প্রভৃতি। যুক্তরাষ্ট্রও কি প্যারিয়া রাষ্ট্র হতে চলেছে? মাত্র তিন মাস আগে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালিত করছেন, তাতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটি একঘরে হয়ে পড়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে নানা ইস্যুতে দীর্ঘ দিনের মিত্র এবং প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আটলান্টিকের এপার-ওপারের দেশগুলোর বিশ্বস্ত বন্ধুত্বে চিড় ধরিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল বিশ্বের ১৮৪টি দেশের পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করেছেন, যে পদক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ও মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে সমানভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। 

চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই মেক্সিকো ও কানাডার ওপর খড়্গহস্ত হন ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহণের দিনই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি প্রয়োগের সূত্রপাত ঘটান প্রতিবেশীর নামে থাকা ‘গালফ অব মেক্সিকো’কে ‘গালফ অব আমেরিকা’ নামকরণের মধ্য দিয়ে; যে উপসাগর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পশ্চিমে এবং অ্যালাবামা, মিসিসিপি, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত। শুধু এ পদক্ষেপেই ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প; গত ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর বাড়তি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এ ছাড়া কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে দেশটির নাগরিকদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন ট্রাম্প। 

এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই পানামা খালে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তাঁর অভিযোগ, পানামা যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। ট্রাম্পের এ ঘোষণায় ক্ষোভ জানিয়ে পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো সাফ জানিয়ে দেন– এই খাল ও আশপাশের প্রতিবর্গমিটার জায়গা তাঁর দেশের; যুক্তরাষ্ট্রের নয়। ট্রাম্প দেশের ক্ষমতাভার নেওয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের মালিকানা প্রতিষ্ঠান হংকংভিত্তিক সিকে হাচিসন ২ হাজার ২৮০ কোটি ডলারের বিনিময়ে মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থা ব্ল্যাকরকের কাছে পানামা খালের দুটি বন্দরের সিংহভাগ হিস্যা বিক্রি করতে সম্মত হয়। নতুন করে ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠোর অভিবাসন নীতি গ্রহণ করে। আর্কটিক বা উত্তর মহাসাগর অঞ্চলে অবস্থিত ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়ে এবং ন্যাটো ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। 

এদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ভূখণ্ডটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এবং গাজার প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীকে মিসর ও জর্ডানে স্থানান্তরের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার জন্ম দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর উদ্ভট পরিকল্পনায় ক্ষোভ জানিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা করেন আরব নেতারা। ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরোধিতায় আরব নেতাদের মধ্যে বিরল ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া ইরানের পরমাণু স্থাপনায় বোমা হামলার হুমকিকে কেন্দ্র করেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন প্রশাসনের। গত ৩০ মার্চ ট্রাম্প ইরানে বোমা হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েত যুক্তরাষ্ট্রকে সাফ জানিয়ে দেয়– ইরানে হামলা চালানোর জন্য মার্কিন যুদ্ধবিমানকে নিজেদের আকাশসীমা বা ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এমনকি ইরানে হামলা চালানোর সঙ্গে জড়িত কোনো মার্কিন বিমান এসব দেশ থেকে জ্বালানিও নিতে পারবে না। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর এ সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। 
ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আফ্রিকা মহাদেশের প্রভাবশালী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ফিলিস্তিনকে সমর্থন ও শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের ওপর ‘অন্যায্য বর্ণবাদী বৈষম্যের’ অভিযোগ তুলে দক্ষিণ আফ্রিকায় সহায়তা বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিযোগ ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের নতুন আইনে শ্বেতাঙ্গদের থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার বিধান আছে। গত ১৫ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম রাসুলকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। কথায় আছে, ঢিল ছুড়লে পাটকেল খেতে হয়। ‘আনঅর্থোডক্স’ বা ব্যাকরণ না মেনে যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন ট্রাম্প, তাতে শত্রু-মিত্রের বাছবিচার করছেন না। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ‘গিয়ার’ পরিবর্তন না করলে যুক্তরাষ্ট্র আর উত্তর কোরিয়ার মধ্যে কতটা তফাত থাকবে– সেটাই দেখার বিষয়। 

আহসান হাবিব সম্রাট: সহসম্পাদক, দৈনিক সমকাল 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ষমত য় য় র পর র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

ডলারের সিংহাসন কি কেঁপে উঠছে

গত জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হয়ে ফেরার পর বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান মনে করিয়ে দিয়েছেন চার্লস পি কিন্ডলবার্গারের সেই কথা, ‘আন্তর্জাতিক অর্থনীতি নিয়ে বেশি ভাবলে মানুষ পাগল হয়ে যায়।’ এমন অস্থির সময়েই ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে ডলারের আধিপত্য নিয়ে দুটি বই—পল ব্লুস্টেইনের ‘কিং ডলার’ এবং কেনেথ রগফের ‘আওয়ার ডলার, ইয়োর প্রবলেম’। 

দুটি বই-ই ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর প্রকাশিত। ব্লুস্টেইনের বইটি বেরিয়েছিল ট্রাম্পের বিশ্ব অর্থনীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরুর আগে। রগফ ও আমি ১৯৮৩ সাল থেকে একসঙ্গে গবেষণা করেছি। ব্লুস্টেইন ছিলেন ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ওয়াশিংটন পোস্ট–এর সাংবাদিক। 

এমআইটিতে পড়ার সময় আমরা শিখেছিলাম, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে সবকিছু একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তাই ডলারের আধিপত্য বোঝার জন্য বৈশ্বিক রাজনীতি, প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক চিন্তায় পরিবর্তনের দিকে নজর দিতে হয়। রগফ ও ব্লুস্টেইনের বই এই বিষয়গুলো সহজ করে ব্যাখ্যা করেছে। ডলার ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা ও বাণিজ্যের মাধ্যম হয়ে ওঠে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি ডলারের শীর্ষস্থান নিশ্চিত করেছিল। 

সে সময় অধিকাংশ দেশ নিজেদের মুদ্রাকে ডলারের সহযোগী হিসেবে দাঁড় করায়। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দেয়, চাইলে প্রতি আউন্স সোনার বিনিময়ে তারা ৩৫ ডলার ফেরত দেবে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল অপেক্ষাকৃত স্বাধীন; তবে তাকে বিশ্বব্যবস্থার স্থিতিশীলতার দিকেও খেয়াল রাখতে হতো।

১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধব্যয়, বাজেট–ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তখন ডলারে স্বর্ণ বিনিময় বন্ধ করেন এবং আমদানি শুল্ক বসান। ট্রেজারি সেক্রেটারি জন কনলি তখন বলেছিলেন, ‘ডলার আমাদের মুদ্রা, কিন্তু এটা তোমাদের সমস্যা।’ এরপর বড় বড় দেশগুলো নিজেদের মুদ্রাকে জাগিয়ে তুলতে শুরু করে। অনেকেই ভেবেছিলেন, ডলারের আধিপত্য কমবে, কিন্তু তা হয়নি।

বিশ্বব্যাপী আর্থিক তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। ফেডের ডলার সোয়াপ লাইনের ওপরও আস্থা দুর্বল হচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি অতিরিক্ত উদার হলেও ডিজিটাল ডলার বা সিবিডিসি চালুর উদ্যোগ বন্ধ করেছে। এটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে আরও একঘরে করছে।

ডলার নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও টিকে থেকেছে। ১৯৭০-এর দশকে আইএমএফ বিশেষ ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) চালু করলেও, ডলার বিকল্প হারায়নি। ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান পল ভলকারের কঠোর নীতিতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে, আর্থিক বাজারের উদারীকরণ হয় এবং মার্কিন ট্রেজারি বন্ড বিশ্বের কাছে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে জনপ্রিয় হয়। 

বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ৮৮ শতাংশে এখনো ডলার বিজড়িত। তবে ডলারের শক্তির ভিত্তি (আইনের শাসন, মুক্তবাজার, মূল্য স্থিতিশীলতা) ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমেরিকার আর্থিক অব্যবস্থাপনা এত বেড়েছে যে কংগ্রেসের কাছ থেকে দায়িত্বশীল বাজেট প্রত্যাশা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

ব্লুস্টেইন কিছুটা আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু রগফ মনে করেন, ডলারের আধিপত্যের সময় ফুরিয়ে আসছে এবং পতনের মূল কারণ আমেরিকার নিজের ভেতর থেকেই আসছে।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে, মিত্রদের আস্থা হারিয়েছে এবং দেশের ভেতর ফেডারেল রিজার্ভ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে। এতে ডলারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

আরও পড়ুনএকটি কাগজের নোট যেভাবে অস্ত্র হয়ে উঠল০২ এপ্রিল ২০২৫

বিশ্বব্যাপী আর্থিক তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কমে যাচ্ছে। ফেডের ডলার সোয়াপ লাইনের ওপরও আস্থা দুর্বল হচ্ছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি অতিরিক্ত উদার হলেও ডিজিটাল ডলার বা সিবিডিসি চালুর উদ্যোগ বন্ধ করেছে। এটি বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে আরও একঘরে করছে।

এপ্রিলের শুরুতে ট্রাম্প যখন ‘মুক্তির দিন’ ঘোষণা করে নতুন শুল্ক আরোপ করেন, তখন মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বেড়ে যায়, আর ডলার পড়ে যায়। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মার্কিন সম্পদের ওপর আস্থা কমে যায় এবং শেয়ারবাজারও বড় ধাক্কা খায়।

এই এপ্রিল মাস সত্যিই টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ডলারের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। যদি বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকে, তাহলে হয়তো বিশ্ব মুদ্রাব্যবস্থায় ডলারের একক আধিপত্যের যুগ শেষ হয়ে আসছে।

মরিস অবস্‌ফেল্ড আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বার্কলে)-এর অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডলারের সিংহাসন কি কেঁপে উঠছে