যুক্তরাষ্ট্র কি উত্তর কোরিয়া হতে যাচ্ছে
Published: 7th, April 2025 GMT
বর্তমান বিশ্বে হাতেগোনা কয়েকটি ‘প্যারিয়া’ রাষ্ট্র রয়েছে। অনেকটা একঘরে হয়ে থাকা রাষ্ট্র। এগুলোর মধ্যে শীর্ষে উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, বেলারুশ প্রভৃতি। যুক্তরাষ্ট্রও কি প্যারিয়া রাষ্ট্র হতে চলেছে? মাত্র তিন মাস আগে ক্ষমতায় আসা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে পরিচালিত করছেন, তাতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটি একঘরে হয়ে পড়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে নানা ইস্যুতে দীর্ঘ দিনের মিত্র এবং প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আটলান্টিকের এপার-ওপারের দেশগুলোর বিশ্বস্ত বন্ধুত্বে চিড় ধরিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল বিশ্বের ১৮৪টি দেশের পণ্যের ওপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করেছেন, যে পদক্ষেপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু ও মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে সমানভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই মেক্সিকো ও কানাডার ওপর খড়্গহস্ত হন ট্রাম্প। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহণের দিনই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি প্রয়োগের সূত্রপাত ঘটান প্রতিবেশীর নামে থাকা ‘গালফ অব মেক্সিকো’কে ‘গালফ অব আমেরিকা’ নামকরণের মধ্য দিয়ে; যে উপসাগর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের পশ্চিমে এবং অ্যালাবামা, মিসিসিপি, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত। শুধু এ পদক্ষেপেই ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প; গত ৪ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর বাড়তি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এ ছাড়া কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম অঙ্গরাজ্যে পরিণত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে দেশটির নাগরিকদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েন ট্রাম্প।
এদিকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই পানামা খালে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন ট্রাম্প। তাঁর অভিযোগ, পানামা যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করছে। ট্রাম্পের এ ঘোষণায় ক্ষোভ জানিয়ে পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো সাফ জানিয়ে দেন– এই খাল ও আশপাশের প্রতিবর্গমিটার জায়গা তাঁর দেশের; যুক্তরাষ্ট্রের নয়। ট্রাম্প দেশের ক্ষমতাভার নেওয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথের মালিকানা প্রতিষ্ঠান হংকংভিত্তিক সিকে হাচিসন ২ হাজার ২৮০ কোটি ডলারের বিনিময়ে মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থা ব্ল্যাকরকের কাছে পানামা খালের দুটি বন্দরের সিংহভাগ হিস্যা বিক্রি করতে সম্মত হয়। নতুন করে ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কঠোর অভিবাসন নীতি গ্রহণ করে। আর্কটিক বা উত্তর মহাসাগর অঞ্চলে অবস্থিত ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড কিনতে চেয়ে এবং ন্যাটো ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ভূখণ্ডটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া এবং গাজার প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীকে মিসর ও জর্ডানে স্থানান্তরের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার জন্ম দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাঁর উদ্ভট পরিকল্পনায় ক্ষোভ জানিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা করেন আরব নেতারা। ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিরোধিতায় আরব নেতাদের মধ্যে বিরল ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া ইরানের পরমাণু স্থাপনায় বোমা হামলার হুমকিকে কেন্দ্র করেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন প্রশাসনের। গত ৩০ মার্চ ট্রাম্প ইরানে বোমা হামলা চালানোর ঘোষণা দেওয়ার পর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েত যুক্তরাষ্ট্রকে সাফ জানিয়ে দেয়– ইরানে হামলা চালানোর জন্য মার্কিন যুদ্ধবিমানকে নিজেদের আকাশসীমা বা ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এমনকি ইরানে হামলা চালানোর সঙ্গে জড়িত কোনো মার্কিন বিমান এসব দেশ থেকে জ্বালানিও নিতে পারবে না। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর এ সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বড় ধাক্কা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই আফ্রিকা মহাদেশের প্রভাবশালী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ফিলিস্তিনকে সমর্থন ও শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের ওপর ‘অন্যায্য বর্ণবাদী বৈষম্যের’ অভিযোগ তুলে দক্ষিণ আফ্রিকায় সহায়তা বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিযোগ ছিল, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের নতুন আইনে শ্বেতাঙ্গদের থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার বিধান আছে। গত ১৫ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত ইব্রাহিম রাসুলকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হয়। কথায় আছে, ঢিল ছুড়লে পাটকেল খেতে হয়। ‘আনঅর্থোডক্স’ বা ব্যাকরণ না মেনে যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন ট্রাম্প, তাতে শত্রু-মিত্রের বাছবিচার করছেন না। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প ‘গিয়ার’ পরিবর্তন না করলে যুক্তরাষ্ট্র আর উত্তর কোরিয়ার মধ্যে কতটা তফাত থাকবে– সেটাই দেখার বিষয়।
আহসান হাবিব সম্রাট: সহসম্পাদক, দৈনিক সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ষমত য় য় র পর র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
দীর্ঘমেয়াদে ‘একঘরে’ হয়ে পড়তে পারে ইসরায়েল, স্বীকার করলেন নেতানিয়াহু
গাজা উপত্যকায় প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধ নিয়ে বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলবিরোধী ক্ষোভ বাড়ছে। এমন অবস্থায় ইসরায়েল দীর্ঘ মেয়াদে কূটনৈতিকভাবে ‘একঘরে’ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গতকাল সোমবার তিনি সতর্ক করে বলেছেন, দেশটি এমন এক ‘বিচ্ছিন্ন’ অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, যা বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে। এমন অবস্থায় ইসরায়েলের স্বনির্ভর হওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
ইসরায়েলের অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে কট্টরপন্থী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এ কথা বলেছেন। তাঁর মতে, ইসরায়েলকে বিদেশি বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, গাজায় যুদ্ধ তীব্র করার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা তিনি স্বীকার করছেন। নেতানিয়াহুর এ ধরনের স্বীকারোক্তির ঘটনা বিরল।নেতানিয়াহু বলেন, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কারণে যেসব গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে, তার একটি অস্ত্র বাণিজ্য। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল বিদেশি অস্ত্র আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে বাধ্য হতে পারে।
যুদ্ধবাজ নেতা নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমাদের অস্ত্রশিল্পকে উন্নত করতে হবে। আমরা হব এথেন্স ও স্পার্টা শহরের মিলিত রূপ। অন্তত আগামী কয়েক বছরের জন্য আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, ওই সময় আমাদের একঘরে করে দেওয়ার চেষ্টাটা মোকাবিলা করতে হবে।’
নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে, গাজায় যুদ্ধ তীব্র করার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা তিনি স্বীকার করছেন। নেতানিয়াহুর এ ধরনের স্বীকারোক্তির ঘটনা বিরল।
বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা হতো। এর বড় কারণ তাদের হাইটেক শিল্প। তবে গাজায় চলমান যুদ্ধ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এটি এখন দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধ।জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা সতর্ক করার পরও ইহুদিবাদী নেতানিয়াহু তাঁর যুদ্ধ কৌশল পাল্টাতে রাজি নন। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা সতর্ক করে বলে আসছে, গাজা নগরীর ওপর অব্যাহত হামলার ঘটনা আরও মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনবে। একই সঙ্গে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় জাতিগত নিধনযজ্ঞ (জেনোসাইড) চালানোর অভিযোগ তীব্র হচ্ছে। তবে ইসরায়েল দৃঢ়ভাবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
গাজা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালিসহ আরও কিছু দেশ ইসরায়েলের ওপর আংশিক বা পুরোপুরিভাবে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তবে ইসরায়েলে আমদানি করা অস্ত্রের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলেও দেশটি এখনো এ ধরনের কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করেনি। তারা অন্য দেশগুলোকেও এমনটা না করার ব্যাপারে সতর্ক করেছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মেয়াদকালে ইসরায়েলের জন্য নির্ধারিত ২০০০ পাউন্ডের একটি বোমার চালান বিলম্বিত করা হয়েছিল। পরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন দ্রুত এর অনুমোদন দেয়।
ইসরায়েলের সাধারণ মানুষ, জিম্মিদের পরিবার, এমনকি দেশটির সেনাবাহিনীও যুদ্ধ আরও জোরদার করার বিপক্ষে মত দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, এতে জিম্মিদের জীবন আরও ঝুঁকিতে পড়বে এবং মানবিক বিপর্যয় বেড়ে যাবে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অনড় রয়েছেন।
আরও পড়ুনগাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল: প্রথমবারের মতো বলল জাতিসংঘ২ ঘণ্টা আগেবছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা হতো। এর বড় কারণ তাদের হাইটেক শিল্প। তবে গাজায় চলমান যুদ্ধ ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এটি এখন দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল যুদ্ধ।
যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর মতে, ইসরায়েলের এই বিচ্ছিন্নতার জন্য আংশিকভাবে একটি ‘চরম ইসলামপন্থী এজেন্ডা’ দায়ী, যা ইউরোপের পররাষ্ট্রনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এই উগ্র ইহুদি নেতা আরও অভিযোগ করেন, কাতারসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্য দিয়ে বিশ্বজনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। এতে ইসরায়েল কূটনৈতিকভাবে একধরনের বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্যে পড়ছে।
আরও পড়ুনআরব-মুসলিম নেতাদের ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান১২ ঘণ্টা আগেগাজায় জাতিগত নিধনের প্রধান অভিযুক্ত নেতানিয়াহু সতর্ক করে বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে এবং অস্ত্র ও অস্ত্রের যন্ত্রাংশ আমদানিতেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।’
ইসরায়েলের বিরোধী দলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ নেতানিয়াহুর বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। ইসরায়েল বিচ্ছিন্নতার দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করায় নেতানিয়াহুকে ‘উন্মাদ’ বলেছেন লাপিদ।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লাপিদ লেখেন, ‘বিচ্ছিন্নতা কোনো নিয়তি নয়, এটি নেতানিয়াহুর ত্রুটিপূর্ণ ও ব্যর্থ নীতির ফল।’