প্রাচীনকালের মানুষ যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই সে বিপদ থেকে পরিত্রাণের জন্য কোনো এক অদৃশ্য শক্তির আরাধনা করেছে। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে নানা দেবতা, পূজা, আচার, উৎসব। চৈত্রসংক্রান্তিও ভারতবর্ষের বাঙালি সমাজের তেমন এক উৎসব। সাধারণত বঙ্গাব্দের দিনপঞ্জি বিবেচনায় মাস গণনার শেষ দিনটিকে ‘সংক্রান্তি’ বলা হয়ে থাকে। তাই চৈত্র মাসের শেষ দিনটি হলো চৈত্রসংক্রান্তি। বাংলা বছরের সমাপনী মাস চৈত্র। চৈত্রের শেষ দিনটিকে চৈত্রসংক্রান্তি বলা হয়। লোকাচার অনুযায়ী এদিনে বর্ষ বিদায় উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। চৈত্রসংক্রান্তির সুর্যাস্তের মধ্যে দিয়ে কালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে যাবে একটি বঙ্গাব্দ।
বাংলা সনের শেষ মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নামানুসারে। আদি গ্রন্থ পুরাণে বর্ণিত আছে, সাতাশটি নক্ষত্র যা রাজা প্রজাপতি দক্ষের সুন্দরীকন্যার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। লোককথা অনুযায়ী, প্রবাদতুল্য সুন্দরী এই কন্যাদের বিয়ে দেওয়ার চিন্তায় উৎকণ্ঠিত ছিলেন রাজা দক্ষ। যোগ্যপাত্র পাওয়া না গেলে অনূঢ়া থেকে যাবেন তারা। অবশেষে বিধির বিধানে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেল।
আরও পড়ুনদুর্গার নয়টি শক্তির পূজো নবরাত্রি০৯ অক্টোবর ২০২৪একদিন মহাধুমধাম করে চন্দ্রদেবের সঙ্গে বিয়ে হলো দক্ষের সাতাশ কন্যার। দক্ষের এককন্যা চিত্রার নামানুসারে চিত্রানক্ষত্র এবং চিত্রানক্ষত্র থেকে চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়। রাজা দক্ষের আরেক অনন্য সুন্দরী কন্যা বিশাখার নামানুসারে ‘বিশাখা’ নক্ষত্র এবং ‘বিশাখা’ নক্ষত্রের নামানুসারে বৈশাখ মাসের নামকরণ করা হয়।
প্রসঙ্গত, মাস হিসাবে বৈশাখের প্রথম হবার মর্যাদা খুব বেশি দিনের নয়। বৈদিক যুগে সৌরমতে বৎসর গণনার যে পদ্ধতি প্রচলিত ছিল সেখানেও বৈশাখের সন্ধান মেলে। বৈদিক যুগের তথ্যানুযায়ী বৈশাখের স্থান ছিল দ্বিতীয়। তৈত্তিরীয় ও পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের মতে বৈশাখের অবস্থান ছিল বছরের মাঝামাঝি জায়গায়। অন্যদিকে ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে অনুষঙ্গপাদের একটি শ্লোক অনুসারে মাসচক্রে বৈশাখের অবস্থান ছিল চতুর্থ। তখন বাংলা সন বলতে কিছু ছিল না। ছিল ভারতীয় সৌরসন গণনা পদ্ধতি।
মোঘল সম্রাট আকবর ‘সুবে বাংলা’ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে ফসল কাটার মৌসুম অনুসারে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে নতুন একটি সনের প্রবর্তনের জন্যে অনুরোধ করেন বিজ্ঞ রাজ জ্যোতিষী ও পণ্ডিত আমির ফতেহউল্লাহ্ সিরাজীকে। সিরাজী হিজরী চন্দ্রমাসের সঙ্গে সম্রাটের সিংহাসনের আরোহনের বছর এবং ভারতীয় সৌরসনের সমন্বয়ে বাংলাসনের প্রবর্তন করেন। মাসের নামগুলো সৌরমতে রেখেই পুনর্বিন্যাস করেন তিনি। সে অনুযায়ী বৈশাখ বাংলা সনের প্রথমে চলে আসে।
আরও পড়ুনআসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে সুরের লড়াই০১ অক্টোবর ২০১৪ফিরে আসি আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় চৈত্রসংক্রান্তিতে।
চৈত্রসংক্রান্তি সম্পর্কে প্রচলতি ছড়া আছে:
‘চিত্রা নক্ষত্র হইতে চৈত্র হইল নাম।
বসন্ত বিদায় নিল, বর্ষশেষ যাম—
চড়কের উৎসব, গাজনের গান।
সেইসঙ্গে বর্ষ হইল অবসান।’
চৈত্রসংক্রান্তির অন্যতম আকর্ষণ গাজন। গাজন একটি লোকউৎসব। চৈত্রসংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব উদ্যাপিত হয়। এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতাদের নাম। যেমন শিবের গাজন, নীলের গাজন ইত্যাদি।
এ উৎসবের মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবীর বিবাহ দেওয়া। গাজন উৎসবের পেছনে কৃষক সমাজের একটি সনাতনী বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচণ্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমণ ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে এই অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিলেন। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়।
আরও পড়ুনকালীপূজায় কেন জবা ফুল লাগে৩১ অক্টোবর ২০২৪চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। চড়ক গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এই উপলক্ষে একগ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়, একজন শিব ও একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে এবং অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে।
এ সময়ে শিব সম্পর্কে নানারকম লৌকিক ছড়া আবৃত্তি করা হয়, যাতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। চড়কে মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল দেখানো হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের খেলা এখন একেবারেই কমে গেছে।
চৈত্রসংক্রান্তিতে অনেক জায়গায় মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। মেলায় কাঠের তৈজসপত্র, মাটির তৈরি নানা জিনিসপত্র, খেলনা, কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন, পূজার নৈবেদ্য আর মিষ্টান্ন বিক্রি হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির দিনে গ্রাম-বাংলার বউ-মেয়েরা ঝোপ-জঙ্গল থেকে প্রথা মেনে ১৪ রকমের শাক তুলে আনতেন। সেই শাক একসঙ্গে রেঁধে এই দিনে খাওয়া হত। আজও নানা জায়গায় এইভাবে শাক তুলে এনে খাওয়ার রীতি রয়েছে। এই প্রথা শাকান্ন উৎসব নামে পরিচিত। চৈত্রসংক্রান্তির দিন নিরামিষ খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এই দিন বাড়িতে মাছ-মাংসের প্রবেশ নিষেধ। গ্রাম-বাংলায় গমের ছাতু খাওয়ার রীতি রয়েছে। দই, পাকা বেল, মুড়ি, চিড়ে, ছাতু, কলা ইত্যাদি মেখে ফলার খাওয়ার প্রচলন বহুকাল থেকেই বিদ্যমান। চৈত্রসংক্রান্তিতে গ্রাম-বাংলার আরও এক বিশেষ উৎসব তালতলার শিরনি। এই দিনে প্রতিটি বাড়ি থেকে চাল-তালের গুড়, দুধ সংগ্রহ করা হয়। যে বাড়িতে এগুলো থাকে না, তারা অর্থ দিয়ে দেন। এরপর গ্রামের কোনো পবিত্র তালগাছের নিচে এই জিনিসগুলো দিয়ে তৈরি হয় শিরনি। যা তালতলার শিরনি নামে পরিচিত।
আরও পড়ুননয় রাত্রি ধরে দুর্গার নয়টি শক্তির যে পুজো হয়, তাই নবরাত্রি১৯ অক্টোবর ২০২৩.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ত রস ক র ন ত র ন উৎসব উৎসব র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।