চৈত্রসংক্রান্তির দিন গ্রামে এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে যাওয়ার বিষয়ে দোনোমনা করছিলেন খালেদ। স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসই তাকে উৎসাহ জোগালেন। বললেন, ‘ডাক্তার বলেছে আমার ডেলিভারির তারিখ ২৬ এপ্রিল, আরও দুই সপ্তাহ সময় আছে। চিন্তা করবেন না, আপনি যান বিয়েতে।’
খালেদ মনছুর পেশায় সাংবাদিক, চট্টগ্রামের একটি স্থানীয় দৈনিকের পাশাপাশি জাতীয় দৈনিকেরও আনোয়ারা উপজেলা প্রতিনিধি। ঘরে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী। খুব বেশি জরুরি না হলে রাতে কোথাও যান না, গেলেও খালেদ মনছুরের মনটা পড়ে থাকে ঘরে। সেদিন স্ত্রীর অনুরোধে গিয়েছিলেন বিয়েতে। বিয়েবাড়ির কোলাহলেও মোবাইলে স্ত্রীর মেসেজটুকু মিস করেননি খালেদ। রাত ১১টার দিকে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠল স্ত্রীর মেসেজ, ‘আমার পেইন উঠেছে, তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন।’
অনেকটা বাতাসের গতিতে বাড়িতে ছুটে গেলেন খালেদ। স্ত্রীর ব্যথাতুর মুখটা দেখে যা বোঝার বুঝে ফেললেন। বাড়ির লোকরা দ্রুত গাড়ি নিয়ে এলেন। ১২টা বাজার আগেই সিএনজি অটোরিকশা করে স্ত্রীকে নিয়ে ছুটলেন চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে; সঙ্গে আছেন মনছুরের মা ষাটোর্ধ্ব রাবেয়া খানম। বিপদে মুরব্বিরাই ভরসা।
চট্টগ্রাম শহর থেকে আনোয়ারা সদরের দূরত্ব ২৪ কিলোমিটার। সদর থেকে খালেদের গ্রাম চৌমুহনীর দূরত্ব আরও ৪ কিলোমিটার। মোট ২৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শহরের আন্দরকিল্লার জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালে পৌঁছাতে রাত ১টা বেজে গেল। রাত ২টার দিকে কেবিনে নেওয়া হলো জান্নাতুল ফেরদৌসকে। সাড়ে ৩ ঘণ্টা নরমাল ডেলিভারির পর প্রায় ৬টায় কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন জান্নাতুল। তখন পুব আকাশে হাসির আভা ছড়াচ্ছিল সূয্যি মামা। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে জন্ম হলো খালেদ-জান্নাতুলের তৃতীয় সন্তান। আনন্দের ঢেউ লেগে গেল পরিবারে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই দারুণ খুশি। নববর্ষের শুভেচ্ছা ও বাবা হওয়ার অভিনন্দন বার্তায় সিক্ত হতে লাগলেন খালেদ-জান্নাতুল দম্পতি।
সেই মুহূর্তের অনুভূতি প্রকাশ করে খালেদ মনছুর বলেন, ‘স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তির পর কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কারণ ব্যথা উঠেছে প্রায় ৪ ঘণ্টা আগে। এরপর ২৮ কিলোমিটার জার্নি। মনেপ্রাণে চাইছিলাম নরমাল ডেলিভারি হোক। আল্লাহ আমার ইচ্ছে পূরণ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। এই উৎসবের দিন আমার তৃতীয় কন্যার জন্ম হওয়ায় আনন্দ হয়েছে দ্বিগুণ। মোবাইলের মেসেজ, ফেসবুকের ইনবক্স, হোয়াটসআপে বন্ধু ও স্বজনরা আমাকে দু’বার করে উইশ করেছে। নববর্ষে পেয়েছি বাবা হওয়ার আনন্দ। আমার কন্যা অনেক ভাগ্যবতী।’
বাংলা নববর্ষের দিন সন্তানকে কোলে নিতে পেরে খুশি আর ধরে না জান্নাতুল ফেরদৌসেরও। আবহমান বাংলার বধূ বেশে ঘোমটা টেনে তিনি বলেন, ‘স্বজনদের একসঙ্গে দুই আনন্দের মিষ্টি খাইয়েছি। আপনারাও খেয়ে যান।’
খালেদ মনছুরের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার চাতরী গ্রামে। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুলের বাড়ি একই উপজেলার পরৈকোড়ায়। আট বছর আগে পরিবারের পছন্দে তাদের বিয়ে হয়।
হাসপাতালের কেবিনের এক পাশে মিটিমিটি হাসছিলেন নবজাতকের দাদি রাবেয়া খানম। বললাম, পহেলা বৈশাখে দাদি হলেন, নাতিনকে নিয়ে কী পরিকল্পনা করলেন? তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যা বললেন তা হলো– ‘আমার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। কারও জন্ম এমন আনন্দের দিনে (পহেলা বৈশাখ) হয়নি। নার্স যখন খবর দিলেন আমার একটি নাতিন হয়েছে, তখন সবে পুব আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে সূর্য উঁকি দিয়েছে। আমার নাতিন যেন সূর্যোদয়ের সাক্ষী।’
মা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘আমি লেবার রুমে থাকার সময় পাশের কক্ষে ডাক্তার-নার্সরা ডিসি হিলে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান নিয়ে কী যেন বলছিলেন। প্রসব হওয়ার পর একজন নার্স বাচ্চাকে উঁচু করে তুলে ধরে আমাকে বললেন, এই নিন আপনার পহেলা বৈশাখ।’ তারপরই তারা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানালেন।
মঙ্গলবার জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালের কেবিনে ছোট বোনকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলছিল বড় দুই বোন ওয়াজিফা খানম (৬) ও নুসাইবা খানমের মধ্যে। দু’জনই বোনকে কোলে নেওয়ার জন্য বারবার বায়না ধরছিল। ওয়াজিফা খানম গ্রামের তালিমুল কোরআন মাদ্রাসায় ক্লাস ওয়ানে পড়ে। নুসাইবা এখনও বিদ্যালয়ে যায়নি। তিন কন্যাকেই উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন মা-বাবার।
বোনের কী নাম রাখবে? দুই বোনের উদ্দেশে এই প্রশ্ন করলে কথা টেনে নেন তাদের দাদি। তিনি বলেন, ‘আমার নামের সঙ্গে মিল রেখেই দুই নাতিন ওয়াজিফা খানম ও নুসাইবা খানমের নাম রেখেছি; নতুন মেহমানের নাম রাখব মাহমুদা খানম।’ কবে নাম রাখবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আজ বিকালে আমরা গ্রামের বাড়ি চলে যাব। গ্রামে একটা প্রথা আছে, সাত দিনের দিন বাচ্চার মাথা মুণ্ডন করতে হয়। সেদিন একটা অনুষ্ঠান করে স্বজনদের দাওয়াত খাওয়াব। ওই অনুষ্ঠানেই মৌলবি ডেকে নাতিনের নাম রাখব।’
গ্রাম থেকে এত দূরে জেমিসন হাসপাতালে কেন এলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে মনছুর বলেন, ‘কারণ আমার আগের দুই সন্তানের জন্মও এ হাসপাতালে হয়েছে। এখানে নরমাল ডেলিভারির জন্য শতভাগ চেষ্টা করা হয়।’
ডাক্তার ফারজানা বীথি জানান, মা ও শিশু ভালো আছে। তারা নিয়মিত পরামর্শ নিচ্ছেন। বাচ্চার ওজন ও স্বাস্থ্য ভালো। বাচ্চা বুকের দুধও পাচ্ছে।
দুই কন্যার পর এবার কি ছেলে সন্তানের আশা ছিল? ফিরে আসার সময় কথাটা বলেছিলাম মনছুরের কাছে। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ যা দিয়েছে তা অতুল্য। এই সময়ে ছেলেমেয়ের মধ্যে খুব একটা তফাত দেখি না। বরং মেয়েরা বেশি বাপকাতুরে হয়। রাতে আমি বাড়ি ফিরলে বড় দুই মেয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, কে বাবার শার্টটা আগে হাতে নেবে, কে বাবার জুতাটা আগে খুলে দেবে এই আনন্দ স্বর্গীয়।’ সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সন্তানদের জন্য দোয়া চান তিনি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নববর ষ র অন ষ ঠ ন বলল ন আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
৮ বছরেও শুরু হয়নি কুবির ২ বিভাগের কার্যক্রম
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) দীর্ঘ ৮ বছর আগে অনুমোদন পাওয়া দুটি বিভাগ এখনো চালু হয়নি। অনুমোদন সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের ধীরগতির কারণে বিভাগ দুটি কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ‘বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ’ এবং ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীনে ‘মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকেই বিভাগ দুটি চালু হওয়ার কথা থাকলেও, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত ও শ্রেণিকক্ষ সংকটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে নতুন অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণের পরে বিভাগ দুটি চালুর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণ হয়নি।
আরো পড়ুন:
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় কুবি প্রক্টরের জরুরি নির্দেশনা
সিএনজি চালকের বিরুদ্ধে কুবি শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ
এছাড়া, তৎকালীন অর্গানোগ্রামে ৩১টি বিভাগের মধ্যে এই দুইটি বিভাগ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যা পরবর্তীতে চালু করা নিয়ে জটিলতা তৈরি করে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে বৈঠক করে এই বিষয়ে পুনরায় আলোচনা করে। ইউজিসি নির্দেশনা অনুযায়ী, নতুন অর্গানোগ্রামে বিভাগের অন্তর্ভুক্তি ও নতুন বিভাগের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সে অনুযায়ি ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কুবির ৮৯তম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল মিটিংয়ে পূর্বের ‘মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ এর পরিবর্তে ‘লজিস্টিক্স ও মার্চেন্ডাইজিং বিভাগ’ এবং ‘বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ’-এর পরিবর্তে ‘পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ’ নামে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়। এছাড়াও অর্গানোগ্রামে নতুন আরও ১৮টি বিভাগের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
তৎকালীন বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রস্তাবক রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, “২০১৭ সালে অনুমোদন থাকলেও জায়গা সংকটের কারণে বিভাগ চালু করা সম্ভব হয়নি। পরে প্রশাসন পাল্টালেও কেউ উদ্যোগ নেয়নি।”
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, “অর্গানোগ্রামে অন্তর্ভুক্তি মানে এখনই চালু হবে না। অনুমোদন থাকলেও তৎকালীন সময়ে চালু করা সম্ভব হয়নি। এখন ইউজিসি নির্দেশনায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, “তৎকালীন প্রশাসন বলতে পারবে কেন বিভাগ চালু হয়নি। আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা মাধ্যমে নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছি। আগামী ২ বছরের মধ্যে আশা করি বিভাগ চালু করা সম্ভব হবে, তখন নতুন ক্যাম্পাসও প্রস্তুত থাকবে।”
ঢাকা/এমদাদুল/মেহেদী