হোসাম শাবাত ২৩ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তরুণ, যাঁর ছিল স্বাভাবিক সুন্দর জীবন। তিনি ছিলেন তাঁর সমবয়সী আর দশটা তরুণের মতোই স্বপ্নবাজ এবং একটা সুন্দর জীবনের প্রত্যাশী। তবে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তাঁর জীবনচিত্র বদলে দেয়।
‘এই মাটি/ভূমি (ফিলিস্তিন) আমাদের। এটিকে রক্ষা করতে এবং এর সেবা করতে মৃত্যুবরণ করা আমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান,’ বলেছিলেন হোসাম শাবাত।
গাজার গণহত্যা ও যুদ্ধের মধ্যেও হোসাম শাবাত হয়েছিলেন লাখো নির্যাতিত ফিলিস্তিনির প্রতিবাদী কণ্ঠ। ২৩ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের শেষ আবেদন ছিল– ‘গাজা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করবেন না। বিশ্বকে চোখ এড়িয়ে যেতে দেবেন না। লড়াই চালিয়ে যান, আমাদের গল্প বলতে থাকুন–যতক্ষণ না ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়।’
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার সত্য উন্মোচন করে চলেছিলেন শাবাত। গাজায় চলমান নির্মম সহিংসতা ও গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছিলেন বিশ্ববাসীর কাছে। নিজের জনগণের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন ২৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি এ সাংবাদিক।
গত ২৪ মার্চ গাজার উত্তরাঞ্চলে বেইত লাহিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় শাবাত নিহত হন। সেদিন তাঁর সঙ্গে গাড়িতে থাকা সবচেয়ে কাছের বন্ধু মোহাম্মদ নিদালও নিহত হন।
ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরুর পর গাজা উপত্যকার উত্তরে মাত্র কয়েকজন সাংবাদিক রয়ে গিয়েছিলেন, যাদের একজন ছিলেন শাবাত। এই তরুণ সাংবাদিক নির্ভয়ে ইসরায়েলের বর্বরতায় নিশ্চিহ্ন হওয়া ৫০,৩০০ ফিলিস্তিনির অব্যক্ত বেদনার গল্প বলেছেন, বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা মিডিয়ার তথ্য বিকৃতির চেষ্টাকে ব্যর্থ করে তিনি গাজায় ইসরায়েলের নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের নির্মম চিত্র বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন।
মৃত্যুর আগে তিনি বিশ্ববাসীর জন্য আবেগঘন বার্তা রেখে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর সহকর্মীদের তা পোস্ট করতে বলে গেছেন।
শাবাতের সহকর্মীরা তাঁর শেষ কথাগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেন।
শাবাত লিখেছেন, ‘এ বার্তা যদি আপনার কাছে পৌঁছে থাকে, জানবেন, আমি আর আপনাদের মাঝে নেই। এবং খুব সম্ভব দখলদার ইজরায়েলি সেনাদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছি। আমি উত্তর গাজার চালানো ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে প্রতিটি মিনিট নথিভুক্ত করেছি। যে সত্যকে ওরা কবর দেওয়ার চেষ্টা করছিল তা বিশ্বকে দেখাতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। আমি ফুটপাতে ঘুমিয়েছি। স্কুলে, তাঁবুতে– যখন যেখানে পেরেছি। লড়াই করে বাঁচতে হয়েছে প্রত্যেকটা দিন। মাসের পর মাস ধরে ক্ষুধা-যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তবুও কখনও আমার দেশের জনগণের পক্ষ ত্যাগ করিনি।’
শাবাত বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমি সাংবাদিক হিসেবে আমার কর্তব্য যথাসাধ্য পালন করেছি। সত্য প্রকাশের জন্য আমি সব ঝুঁকি মাথা পেতে নিয়েছি। অবশেষে, বুঝি বিশ্রামের সময় হলো। গত আঠার মাস বিশ্রাম কাকে বলে জানি না। আমি বিশ্বাস করি, সব করেছি ফিলিস্তিনের স্বার্থে।’
যুদ্ধ শুরুর আগে হোসাম শাবাত ছিলেন তৃতীয় বর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখা তাঁর পোস্টে উঠে এসেছিল মর্মস্পর্শী সেই কথা:
‘এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ২১। অন্য সবার মতোই ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু দেড় বছর ধরে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উৎসর্গ করেছি আমার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষদের জন্য।’
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ায় তাঁর ডিগ্রি অসম্পূর্ণই থেকে গেছে–এই আক্ষেপ যেন তাঁর প্রতিটি কথায় মিশে ছিল।
দখলদার বাহিনী যখন গাজার মানুষকে দক্ষিণাঞ্চলে সরে যেতে বাধ্য করেছিল, তখন যুদ্ধের ভয়াবহতা নথিভুক্ত করতে হোসাম শাবাত উত্তরে রয়ে গিয়েছিলেন–প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও।
শাবাতের শোকাহত মা আমাল শাবাত বলেন, ‘আমাদের যখন দক্ষিণে সরে যেতে হয়, শাবাত আমাদের সঙ্গে কিছুদূর হেঁটে এসেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এখানেই (উত্তর গাজা) থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। নুসাইরাতের (মধ্য গাজা) শিবিরে থাকার সময় আমি তাকে বারবার ফোন করে অনুরোধ করতাম, তবু সে আসত না।’
জানুয়ারির শেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর প্রায় ৪৯২ দিন পর তাঁর পরিবার তাঁকে দেখতে গাজা শহরে ফিরে আসে। শাবাত ততদিনে ভীষণ ব্যস্ত, ব্যস্ততার কারণে মায়ের সঙ্গে সময় কাটানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁর জন্য। মায়ের মমতায় আমাল নিজেই ছেলের পেছনে ছুটতেন–যেখানে শাবাত রিপোর্ট করতেন। ছেলেকে একবার দেখার আশায় মা ছুটে যেতেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতেও।
ইসরায়েলের নৃশংসতা কভার করতে গিয়ে হোসাম শাবাত বারবার মৃত্যুঝুঁকি নিয়েছেন। ২০২৪-এ তাঁকে ‘হিট লিস্টে’ তালিকাভুক্ত করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। আহত হয়েও তিনি রিপোর্টিং চালিয়েছেন।
হন্যে হয়ে পিছু নিয়েছে ইসরায়েল, শাবাত জানতেন। জানতেন পিছু নেওয়া হয়েছে আরো অনেক সাংবাদিকেরই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #ProtectJournalists হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করতেন শাবাত।
জায়নবাদীদের হুমকির মুখে শাবাত লিখেছিলেন, ‘ইসরায়ের কী চায় তা অনুমেয়। তারা চায় সাংবাদিকশূন্যতা তৈরি করতে। তাদের আগ্রাসী চিন্তারই অংশ। বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক হত্যা করা সম্ভব হলে ‘মিডিয়া ব্লাকআউট’ হবে। তাদের অপকর্মের কথা বলার কেউ থাকবে না। সবাইকে সতর্ক থাকতে আহ্বান জানাই।’
২৪ মার্চের আগে আরেকবার বড় ধরনের আক্রমণ থেকে বেঁচে যান শাবাত। ২০২৪ এর নভেম্বরের কথা। ইসরায়েলি বিমানহামলার শিকার হন তিনি। শাবাতের বন্ধু মাহমুদ জানান সেই সময়ের কথা। ‘যখন বোমাহামলা হতো, আমরা পিছু হটতাম। কিন্তু শাবাত আসত না আমাদের সঙ্গে। থেকে যেত। কারণ খবর সংগ্রহ করতে হবে। ওকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতাম সারাক্ষণ।’
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। বন্ধুদের জানিয়েছিলেন, উত্তর গাজায় পরিস্থিতি খুব খারাপ। মুহুর্মুহু বোমাহামলা চলছে। একই সময়ে মার্কিন মিডিয়া ড্রপ নিউজে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের খবর দেন তিনি।
শুধু সাংবাদিক নন, একজন সমব্যথী মানুষ হিসেবে তাঁকে সবাই জানতেন। ভালোবেসে সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখতেন শাবাত। বন্ধুদের সঙ্গে ভবিষ্যতের গল্প করতেন–শান্তির সকাল, প্রিয়জনের সঙ্গে রাতের খাবার, মুক্ত ফিলিস্তিন।
বন্ধুদের মতে, নিপীড়নের মধ্যেও শাবাত রঙিন পোশাক পরতেন, প্রেম-সংসারের স্বপ্ন দেখতেন।
এক্সে একটি পোস্টে লিখেছিলেন, ‘শান্তি চাই–ফিলিস্তিনের জন্যই শুধু নয়, আমার আত্মার জন্যও।’
শাবাতের মৃত্যুতে ফিলিস্তিন হারাল এক সাহসী কণ্ঠ, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে দখলমুক্ত ফিলিস্তিনের লড়াইয়ে। শাবাত মরেও চির অমর ফিলিস্তিনের ইতিহাসে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র বন ধ দ র র জন য র জ বন আম দ র র বয়স
এছাড়াও পড়ুন:
চবি ছাত্রদলের ৪২০ জনের কমিটিতে নারী মাত্র ১১
আংশিক কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রদলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ৪২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে নারী সদস্য রয়েছেন মাত্র ১১ জন। যা শতকরা হিসেবে তাদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ২.৬২ শতাংশ।
এর মধ্যে, সহ-সভাপতি পদে একজন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদে তিনজন, সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে একজন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে একজন, মানবাধিকার সম্পাদক পদে একজন, সহ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে একজন, ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক পদে একজন এবং সহ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক পদে দুইজন।
আরো পড়ুন:
বগুড়ায় স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী আটক
কুমিল্লায় প্রবাসীর স্ত্রীকে মারধর-তালাক, অন্যজনের সঙ্গে বিয়ে
বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে ৬০ জন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ৯২ জন, সহ-সাধারণ সম্পাদক ৬৩ জন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ৬৪ জন এবং সদস্য রয়েছেন ৬২ জন।
এর আগে, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মো. আলাউদ্দিন মহসিনকে সভাপতি ও আবদুল্লাহ আল নোমানকে সাধারণ সম্পাদক করে পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি পায় চবি ছাত্রদল। এরপর নানা জটিলতা ও সাংগঠনিক স্থবিরতায় ২ বছর পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি সংগঠনটি। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ৪২০ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, একটি কমিটির মেয়াদ থাকে সর্বোচ্চ ২ বছর। সেখানে চবি ছাত্রদলের পাঁচ সদস্যের কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ।
এদিকে, গত ১২ অক্টোবর চাকসু নির্বাচনের আগে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চবি ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতির পদ থেকে মোহাম্মদ মামুন উর রশিদ মামুনকে সংগঠনের সদস্য পদসহ স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় সংসদ। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতির পদটি শূন্য রয়েছে।
পূর্বের আংশিক কমিটিতে সভাপতি ছিলেন মো. আলাউদ্দিন মহসিন, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান, সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. ইয়াসিন ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও তারা একই পদে বহাল আছেন।
ঢাকা/মিজান/মেহেদী