যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের তালিকায় আছে বাংলাদেশিরাও
Published: 19th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ওপর কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন। সম্প্রতি প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছে মার্কিন সরকার। আমেরিকান ইমিগ্রেশন ল ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এআইএলএ) একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এআইএলএর ‘দ্য স্কোপ অব ইমিগ্রেশন এনফোর্সমেন্ট অ্যাকশনস অ্যাগেইনস্ট ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাতিলকৃত ৩২৭টি ভিসা পর্যালোচনা করেছে এআইএলএ। ভিসা বাতিল হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫০ শতাংশ ভারতের, ১৪ শতাংশ চীনের। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, নেপাল, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীও এই তালিকায় রয়েছেন। তবে বাংলাদেশিদের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
গত চার মাস ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) বিদেশি শিক্ষার্থীদের ডেটা, তাদের কার্যকলাপ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তৎপরতার ওপর নজরদারি করছে। অনেকের অভিযোগ, এই নজরদারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে করা হচ্ছে। ফলে কোনো প্রকার অপরাধের ইতিহাস বা ক্যাম্পাস বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের ভুলভাবে চিহ্নিত করার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
গত মার্চে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ‘ক্যাচ অ্যান্ড রিভোক’ নামের কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভিসাধারীদের নজরদারি ও চিহ্নিত করা হবে। রুবিও বলেন, এই শিক্ষার্থীদের সোশ্যাল মিডিয়া কার্যকলাপও পর্যবেক্ষণ করা হবে। ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ বা ফিলিস্তিন ও হামাসের প্রতি সমর্থনের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেম (এসইভিআইএস) পোর্টালটির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ (ডিএইচএস) আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের ভিজিটরদের ট্র্যাক করে।
আইসিই–এর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, এসইভিআইএস সিস্টেমে ৪ হাজার ৭৩৬ জন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা স্ট্যাটাস বাতিল করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই এফ১ ভিসাধারী।
ভিসা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ভিসা বাতিলের নোটিশ পেয়েছেন মাত্র ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। সেটিও তারা পেয়েছেন ই–মেইলের মাধ্যমে। এর মধ্যে মাত্র ২ জন শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। এছাড়া নোটিশ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। অনেক শিক্ষার্থী সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নোটিশ পাননি। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়েছে। অনেকে ক্ষেত্রেই কোনো ধরনের তথ্যপ্রমাণ ও ব্যাখ্যা তো দূরের কথা, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হচ্ছে না।
এআইএলএ এই প্রশাসনিক পদক্ষেপকে নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছে। তারা বলেছে, সরকারের এমন পদক্ষেপ বেশ কিছু আইনি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে এবং এর জন্য সম্ভবত আইনি লড়াইয়ের প্রয়োজন হতে পারে।
এই ভিসা বাতিলের প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ৩২৭টি ঘটনার মধ্যে ৫০ শতাংশই অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং (ওপিটি) ধারী। ওপিটি আন্তর্জাতিক এফ১ ভিসাধারী শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে ১২ মাস পর্যন্ত কাজের সুযোগ দেয়। এই শিক্ষার্থীরা স্নাতক সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত। ভিসা বাতিল হওয়ার ফলে এই শিক্ষার্থীরা এখন আর কাজ করতে পারবেন না। ভিসা বাতিলের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যেসব অঙ্গরাজ্য এর মধ্যে রয়েছে—টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, মিশিগান এবং অ্যারিজোনা।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবৃতি এবং স্কুল কর্মকর্তাদের সঙ্গে চিঠিপত্রের পর্যালোচনায় অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) দেখেছে, গত মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রায় ১ হাজার আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল বা তাদের আইনি মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে।
আইনি মর্যাদা হারানো অনেক শিক্ষার্থীই ভারত ও চীনের। এই দুই দেশের মোট শিক্ষার্থী আমেরিকার কলেজগুলোতে অধ্যয়নরত মোট আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর অর্ধেকেরও বেশি। তবে আইনজীবীরা বলছেন, এই বাতিলের ঘটনা বিশ্বের কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
এনডিটিভির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ নিয়ে ভারত সরকার প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘আমরা জেনেছি, বেশ কয়েকজন ভারতীয় শিক্ষার্থী তাদের এফ ১ ভিসা স্ট্যাটাসের বিষয়ে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বার্তা পেয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আমাদের দূতাবাস ও কনস্যুলেট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশ পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে: আইরিন খান
জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান বলেছেন, ‘আমাদের যে বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে, তার একটি হলো ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একটি স্বাভাবিক গণতন্ত্রের দেশ নয়। এখানে গণতন্ত্র চলছে না। কার্যত এটা পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে।’
টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট (টিজিআই) আয়োজিত এক ওয়েবিনারে আইরিন খান এ কথা বলেন। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে গত বুধবার ‘আইন থেকে অধিকার: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণে ডিজিটাল স্বাধীনতার সুরক্ষা’ শীর্ষক এ ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
ওয়েবিনারে বিদ্যমান ও নতুন সাইবার আইন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া এবং নাগরিকদের ওপর নজরদারিসহ ডিজিটাল সুশাসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা হয়। টিজিআই–এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে নজরদারি সরঞ্জাম কেনার জন্য ১৯ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছে।
ওয়েবিনারে সূচনা বক্তব্য দেন টিজিআই–এর নির্বাহী পরিচালক সাবহানাজ রশীদ দিয়া। গত বছরের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশে বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাবহানাজ রশীদ বলেন, ‘আমরা দেখেছি, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে কিছু উল্লেখযোগ্য তদন্ত, কমিশন ও প্রক্রিয়া করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা নির্বিচার গ্রেপ্তার হতেও দেখেছি।’
টিজিআই–এর নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। অতীতে আমাদের বিশ্লেষণে আমরা দেখেছি, এই আইন বাংলাদেশে নজরদারির সবচেয়ে সহায়ক এবং একই সঙ্গে এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে।’
আলোচনায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা খাতের বিষয়গুলো নিয়ে আইরিন খান বলেন, ‘আমাদের একটি অন্তর্বর্তী সরকার আছে, যার কর্তৃত্ব সীমিত। আমাদের একটি নিরাপত্তা খাত আছে; এই একটি মাত্র খাতে অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা খাতে সংস্কার নিশ্চিত করতে আমরা কী করতে পারি?’
জাতিসংঘের বিশেষ এই র্যাপোর্টিয়ার বলেন, ‘এই রূপান্তর বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা খাতকেই সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে (বর্তমান সরকারকে)। এখনো তাদের কাছে সব ধরনের (নজরদারি) সরঞ্জাম রয়েছে। আর সে কারণে পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব কে দেবে, তা নির্ধারণে অন্য সবার চেয়ে তাদের বাড়তি সুবিধা রয়েছে।’
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ডিজিটাল পরিসরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় বর্তমান সরকার কী করতে পারে, সে বিষয়ে আলোচনায় আইরিন খান বলেন, ‘ডিজিটাল নিয়ে ভাবুন। আমি মনে করি না, সরকার তা করছে। তবে অন্য সবাই ডিজিটাল নিয়ে ভাবছে। তাই সরকারের ডিজিটাল নিয়ে এবং ডিজিটাল পরিসরে কীভাবে কাজ করবে, সে বিষয়ে ভাবা দরকার। (ইন্টারনেট) কোম্পানিগুলোকে ডাকুন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন এবং ডিজিটাল পরিসর কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা মানুষকে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেও বুঝতে দিন।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিনের প্রোগ্রাম অফিসার ডায়নাহ ফন ডার গেস্ট বলেন, ‘আমি মনে করি, নজরদারি নিজে থেকে অবৈধ নয়। সর্বত্র রাষ্ট্রগুলোর জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অপরাধের তদন্ত করা এবং নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু নজরদারি যখন ব্যাপক, অস্বচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়, তখন তা একটি বিপজ্জনক সীমা অতিক্রম করে।’
ওয়েবিনারে বলা হয়, বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ডিজিটাল স্বাধীনতা যেমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যে প্রবেশাধিকার এবং অনলাইনে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিয়ে আলোচনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে সাইবার আইন ও এর প্রয়োগের ফলে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ; ডিজিটাল পরিসরে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং মানুষের অধিকার সুরক্ষায় সংস্কারের সম্ভাবনা নিয়ে এতে আলোচনা হয়েছে।