রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে মেঘালয় ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে সীমান্তবর্তী জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা। মেঘ, পাহাড়, নীলাদ্রি লেক আর যাদুকাটা নদীর দেশ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু অপরূপ তাহিরপুর যে ক্রমে ভয়াবহ দুর্দশা ও বিপর্যয়ে পড়ছে, সেটা বাকি বাংলাদেশের এখনই জানা দরকার।
শুধু প্রকৃতি নয়; প্রকৃত তাহিরপুরকে জানতে-বুঝতে সম্প্রতি উপজেলার একেবারে সীমান্ত এলাকার দিকে গিয়েছিলাম। চানপুর, রজনীলাইন, পাহাড়তলী, আমতৈল, শান্তিপুর, রাজাই, কড়ইগড়াসহ কমবেশি বিশটি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষের বাস এখানে। হাজং, মান্দি, খাসি, বাঙালিসহ বহু উদ্বাস্তু ও স্থানান্তরিত মানুষও আছেন। মেঘালয়ের কয়লা খনি, বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, পরিবেশ বিপর্যয়, পাহাড় ধসে বালু-পাথরের বন্যায় আবাদি জমির ক্ষতি, কর্মহীনতা, যাদুকাটা-রক্তি নদী ঘিরে কয়লা-পাথর বাণিজ্য, কাঁটাতারের বেড়া, অসহায় মানুষের স্থানান্তর ও ভূরাজনীতি মিলে এ অঞ্চল বেশ গুরুত্বপূর্ণ । 

নদী বেয়ে বিপর্যয়ের স্রোত
ভারত থেকে প্রবাহিত ২২টি নদী ও সীমান্তবর্তী পাহাড় থেকে নেমে আসা ছড়াগুলোর জলধারা হাওড়াঞ্চলের পানির উৎস। একসময় বৃষ্টির ঢল নেমে হাওড় এলাকায় সৃষ্টি হতো মৌসুমী বন্যা। ঢল ও বন্যার পানি কবে কোন নদী দিয়ে কোন হাওড়ে নামবে, তার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা এ অঞ্চলের মানুষের সহজাতভাবে জানা ছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। মেঘালয় রাজ্যে পাথর ও কয়লা খনন, প্রাকৃতিক বনভূমি বিনষ্ট করে অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদির জন্য প্রায়ই ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা ও ঢলের সঙ্গে ধসের পাথর ও বালুতে ঢেকে যাচ্ছে সীমান্তের এদিকের ফসলি জমি, বসত ভিটা ও পানির উৎস প্রাকৃতিক ছড়া। তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর অনেক এলাকা ইতোমধ্যে পাহাড়ি বালুতে ঢেকে গেছে। 

তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী কড়ইগড়া থেকে ধীরেন্দ্রনগর প্রায় অর্ধশত গ্রাম এক অর্থে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেকেই কৃষিজীবন থেকে উচ্ছেদ হয়ে দিনমজুরি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মেঘালয় পাহাড়ের বালু ও পাথরের ঢলে পরিবর্তিত হচ্ছে জলপথগুলোর ঐতিহাসিক গতিপ্রকৃতি, যা আবার এতদিনের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। 
এর শুরু অনেক বছর আগে।
২০০৮ সালের ২০ জুলাই টানা পাঁচ দিনের বৃষ্টিতে ধসে পড়ে মেঘালয়ের কালাপাহাড়ের অনেকখানি। এতে তাহিরপুরের উত্তর বড়দল ইউনিয়নের চানপুর-রজনীলাইন-পাহাড়তলীর প্রায় ৫০০ একর রোয়া জমি ৪-৫ ফুট বালু-পাথরের নিচে তলিয়ে যায়। প্রায় ৩০০ ঘর, ২টি বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা, ১টি বাজার, ৪টি মসজিদ, চানপুর বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) ক্যাম্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপজেলা প্রশাসন থেকে কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ অবস্থা রুখতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। ইতোমধ্যে আক্রান্ত গ্রামগুলোর অনেক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ছড়িয়ে গেছে শহরে ও বিভিন্ন জেলায়। 

বিপদের নানা দিক
মেঘালয়ের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পাহাড়ে রয়েছে কয়লা ও চুনাপাথরের অনেক কোয়ারি। এগুলোর খননকৃত মাটি ও বালু ১৮টি ছড়া দিয়ে নেমে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বর্তমান লেখক স্বচক্ষে চুনাপাথর, বালু, কয়লার কারবার দেখে এসেছেন। স্থানীয় জনসাধারণের ভাষ্যমতে, ২০০৭ সালে বর্ষা মৌসুমে প্রথম বালু ও পাথরের বড় ঢল নামে। ২০০৮ সালে মহা বিপর্যয়ের দিনে এক রাতের মধ্যে সশব্দে পাহাড় ধসে ‘একতলা বাড়িসমান’ পাথর ও বালু তাহিরপুর এলাকার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে। কয়েক হাজার হেক্টর আয়তনের ছোট-বড় ২০টি হাওর বালুর স্তরে চাপা পড়ে। এর পর থেকে প্রতিবছর বন্যা ও ঢলের সঙ্গে বালু ও পাথরখণ্ড নেমে আসছে। বছরে তিন-চারবার ভিটে উঁচু করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। পাশাপাশি বিরান হয়ে যাচ্ছে আবাদি জমি। বেড়ে চলেছে কর্মহীনতা। স্থানান্তরিত হচ্ছে বিপুল জনশক্তি। 
মেঘালয়ের উন্মুক্ত পদ্ধতিতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পাহাড় ফাঁপা করে তৈরি হয়েছে আলোচিত খনিগুলো। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। এসব পাহাড়ের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করছে উভয় দেশের সীমান্তবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা এবং হাওর এলাকার প্রাণ-প্রকৃতি।

স্থানীয় আদিবাসী মান্দি, হাজং, খাসি ও দরিদ্র উদ্বাস্তু বাঙালিদের প্রধান জীবিকা ছিল পাহাড়-জলাভূমিনির্ভর। কিন্তু বর্তমানে অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়লা ও পাথর খনিতে কাজ করেন। খনিতে কাজ করতে গিয়ে অপমৃত্যুর শিকার হন অনেকে; অনেকে সন্তান হারিয়ে দিশেহারা। কোনো পরিবারে একই সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন দুই সহোদর। সীমান্তের কাঁটাতারের ফাঁক গলে সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে বিপন্ন ও বেপরোয়া মানুষ ভোরের আলো ফোটার আগেই কয়লা খনিতে নামেন। কখনও খনির ভেতর জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসে বা পাথরচাপায় প্রাণ হারান। স্থানীয় অধিবাসী ও কয়লা শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে রোজার ঈদের সময় অনেক মানুষ খনিতে কাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন। দুর্ভাগ্য, এসব মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

রাষ্ট্রের করণীয়
সুনামগঞ্জ ও তাহিরপুর উপজেলার এ সমস্যা বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে। এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের জন্য বিএসএফকে চিঠিও দিয়েছিল তৎকালীন বিডিআর। স্থানীয় সংগঠন ‘উইকক্লিব সিম যুব সংঘ’ এবং এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে আবাদি জমি বিনষ্ট ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনকে বিষয়টা অবহিত করে। পাশাপাশি এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেয়। কিন্তু তাহিরপুরে দুর্দশা তাতে কমেনি।
উজানের পাহাড়ধস ও বালু-পাথরের কবল থেকে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো বাংলাদেশের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে মেঘালয়ে অন্যায্য ও অপরিকল্পিত বাণিজ্যিক প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা ও থামানো দরকার। পাশাপাশি তাহিরপুরের মতো এলাকাগুলোতে জীবনের সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতকে সম্মিলিতভাবে বিদ্যমান আইনি কাঠামো অনুসরণ করে, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে, পরিবেশ ও জনগণের সংকট ও চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংলাপের মধ্য দিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। নিশ্চয়ই সেটা সম্ভব।

ড.

ঈশিতা দস্তিদার: নৃবিজ্ঞানী; 
বৃহত্তর সিলেটের খাসি সমাজ গবেষক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ম ন তবর ত পর ব শ ব প হ ড় ধস র জন য র অন ক উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

সার্চ দুনিয়ার নতুন দিগন্ত জিইও: দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্

ইন্টারনেট সার্চ দুনিয়ায় চলছে নীরব এক বিপ্লব। তথ্য খোঁজার ধরন বদলে যাচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত। আগে যেখানে গুগলে উচ্চ র‌্যাংকিং মানেই ছিল সাফল্য, এখন সেই জায়গা নিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্ভর সার্চ টুল।

সার্চ জগতের নতুন চ্যালেঞ্জ

চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি, মাইক্রোসফট কপিলট কিংবা পারপ্লেক্সিটি এআই-এগুলো আর শুধু সার্চ ইঞ্জিন নয়, বরং উত্তর তৈরিকারক ইঞ্জিন। ব্যবহারকারী এখন শুধু ‘লিংক’ নয়, বরং সরাসরি উত্তর পেতে চায়। আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্যই এসেছে নতুন এক কৌশল- জিইও বা জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন।

জিইও কী?

জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনার ওয়েবসাইট ও কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো হয় যাতে এআই-চালিত সার্চ ইঞ্জিন সহজেই আপনার তথ্য চিনতে, বুঝতে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে সেটি অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।

আগে ব্র্যান্ডগুলোর ফোকাস ছিল গুগলের প্রথম পাতায় জায়গা করে নেওয়া। কিন্তু এখন গুরুত্ব পাচ্ছে- চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-এর উত্তরে আপনার ব্র্যান্ডের নাম আসছে কি না!

এসইও বনাম জিইও: সার্চ দুনিয়ার নতুন যুগের পালাবদল

অনেকেই এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এবং জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক মনে করেন, কিন্তু এদের মধ্যে মূলত লক্ষ্য ও কৌশল ভিন্ন। এসইও হচ্ছে পুরোনো পদ্ধতি, অন্যদিকে জিইও হচ্ছে নতুন পদ্ধতি।

* মূল লক্ষ্য
এসইও: সার্চ ইঞ্জিনে র‌্যাংক বাড়ানো
জিইও: এআই সার্চের উত্তরে দৃশ্যমান হওয়া

* কাজের ধরন
এসইও: কিওয়ার্ড ও ব্যাকলিংক ভিত্তিক
জিইও: কনটেক্সট, প্রাসঙ্গিকতা ও ব্র্যান্ড অথরিটি নির্ভর

* ফলাফল
এসইও: ক্লিক ও ট্রাফিক বৃদ্ধি
জিইও: ব্র্যান্ড উল্লেখ ও আস্থা বৃদ্ধি

* প্ল্যাটফর্ম
এসইও: গুগল, বিং ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিন
জিইও: চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, পারপ্লেক্সিটি, এসজিই ইত্যাদি এআই সার্চ

এসইও এখনও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ভবিষ্যতের সার্চ ইকোসিস্টেমে জিইও সমান অপরিহার্য হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশি ব্যবসার জন্য জিইও-এর গুরুত্ব

বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিক্ষা, ট্রাভেল, স্বাস্থ্যসেবা, ই-কমার্স, রিয়েল এস্টেট- প্রায় প্রতিটি খাতেই ব্যবসা অনলাইনে আরো দৃশ্যমান হতে চাচ্ছে। কিন্তু বদলেছে মানুষের সার্চ করার ধরন। এখন তারা শুধু গুগলে সার্চ করেই সন্তুষ্ট থাকছে না, তারা এআই-চালিত সার্চ টুলগুলো যেমন চ্যাটজিপিটি, জেমিনি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মাধ্যমে সরাসরি উত্তর খুঁজছে। 

গার্টনারের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ ভলিউম প্রায় ২৫ শতাংশ কমে যাবে- কারণ ব্যবহারকারীরা দ্রুতই এআই-চালিত সার্চ ও চ্যাটবটের দিকে ঝুঁকছে। (তথ্যসূত্র: Gartner, “Search Engine Volume Will Drop 25% by 2026, Due to AI Chatbots and Other Virtual Agents)

তবে এই পরিবর্তনের প্রভাব ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, কেউ চ্যাটজিপিটি-তে লিখল, ‘ঢাকায় সেরা অ্যাকাউন্টিং ফার্ম কোনটি?’ যদি আপনার কোম্পানির নাম বা কনটেন্ট এআই-এর তৈরি উত্তরে না আসে, তাহলে সম্ভাব্য ক্লায়েন্ট ও ব্যবসার সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

মূলত এখানেই জিইও-এর গুরুত্ব উঠে আসে। জিইও ব্যবহার করে কনটেন্ট এমনভাবে সাজানো যায় যাতে এআই সার্চ সিস্টেম আপনার ব্র্যান্ডকে সহজেই চিনতে পারে, বুঝতে পারে এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসা যদি এআই-এর দুনিয়ায় দৃশ্যমান থাকতে চায়, জিইও’র সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এখন আর বিকল্প নয়- এটি একান্ত প্রয়োজন।

জিইও’র জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) কোনো একদিনে শেখার মতো বিষয় না- এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবসাগুলোকে নিজেদের কনটেন্ট, উপস্থিতি ও বিশ্বাসযোগ্যতা এআই-বান্ধব করে গড়ে তুলতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে দেখা যাক, কীভাবে আপনি জিইও’র পথে প্রস্তুত হতে পারবেন।

১. অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করুন

জিইও’র প্রথম ধাপ হলো আপনার ব্যবসা বা ব্র্যান্ডের বর্তমান অনলাইন উপস্থিতি যাচাই করা। চ্যাটজিপিটি বা পারপ্লেক্সিটি-এর মতো এআই-চালিত সার্চ টুলে সার্চ দিন ‘বাংলাদেশে সেরা (আপনার ইন্ডাস্ট্রি)-এর কোম্পানিগুলো কোনগুলো?’

যদি সার্চের উত্তরে আপনার নাম না আসে, বোঝা যাবে যে আপনার এআই-দৃশ্যমানতা এখনও সীমিত। এই ক্ষেত্রে আপনাকে জিইও অনুযায়ী কনটেন্ট ও অনলাইন উপস্থিতি বাড়াতে কাজ শুরু করতে হবে।

২. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করুন

জেনারেটিভ এআই সার্চ সিস্টেম সেই উৎসকেই অগ্রাধিকার দেয়, যা নির্ভরযোগ্য ও যাচাইযোগ্য। তাই আপনার ওয়েবসাইটে ব্র্যান্ড, টিম, যোগাযোগ ও রিভিউসহ সব তথ্য সম্পূর্ণ ও স্বচ্ছ রাখুন।

গুগল বিজনেস প্রোফাইল নিয়মিত আপডেট করুন-  ঠিকানা, সময়, পোস্ট ও রিভিউসহ।

বিশ্বস্ত সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে ব্র্যান্ডের উল্লেখ বাড়ান।

E-E-A-T (Experience, Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness) বজায় রাখুন।

এভাবেই এআই ও ব্যবহারকারীর কাছে আপনার ব্র্যান্ড একটি বিশ্বাসযোগ্য সোর্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে- যা জিইও সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

৩. কনভারসেশনাল কনটেন্ট লিখুন

এআই সার্চ এখন ব্যবহারকারীর প্রশ্নভিত্তিক অনুসন্ধানকে গুরুত্ব দেয়। তাই আপনার কনটেন্ট তৈরি করুন এমনভাবে যেন এটি প্রাকৃতিক প্রশ্ন ও কথোপকথনের মতো শোনায়। উদাহরণ: ‘Where can I find a trusted IELTS coaching center in Dhaka?’ ‘Where can I apply for a blue-collar job?’ এ ধরনের কনটেন্ট এআই-এর চোখে আরো সহজে বোঝার মতো হয় এবং ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উল্লেখযোগ্য।

৪. বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সক্রিয় থাকুন

এআই শুধু ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে না। এটি ফেসবুক, ইউটিউব, লিংকডইন, কোরা এবং অন্যান্য সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে। তাই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা জিইও-এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৫. এসইও এবং জিইও একসাথে ব্যবহার করুন

ডিজিটাল দুনিয়ায় এখন শুধু সার্চ র‌্যাংকই যথেষ্ট নয়। এসইও যেমন গুগল সার্চে আপনার কনটেন্টকে শীর্ষে নিয়ে আসে, তেমনি নতুন যুগের জিইও (জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) আপনার ব্র্যান্ডকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সার্চে আরো দৃশ্যমান করে তোলে।

এসইও মূলত গুগল ও অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনে ওয়েবসাইটের অবস্থান উন্নত করে, আর জিইও শেখায়- কীভাবে এআই মডেলগুলো আপনার ব্র্যান্ডকে চিনবে, উল্লেখ করবে এবং বিশ্বাস করবে।

দুটি কৌশল একসাথে প্রয়োগ করলে অনলাইন উপস্থিতি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়। একদিকে সার্চে দৃশ্যমানতা বাড়ে, অন্যদিকে এআই-নির্ভর প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আপনার ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

ভবিষ্যতের সার্চ জগতে টিকে থাকতে হলে এখনই সময়- এসইও এবং জিইও-কে একসাথে কাজে লাগানোর।

বাংলাদেশের ব্যবসার জন্য জিইও’র নতুন সম্ভাবনা

জিইও বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোর জন্য হতে পারে এক গেম চেঞ্জার। আগে যেখানে অনলাইন দৃশ্যমানতা মানেই ছিল গুগলে র‌্যাংক করা, এখন সেটি ধীরে ধীরে স্থান ছেড়ে দিচ্ছে এআই সার্চ ভিজিবিলিটি–কে।

আজ যদি কোনো ব্যবহারকারী চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি-তে জিজ্ঞেস করে- 

‘বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য অনলাইন বই বিক্রির সাইট কোনটা?’

অথবা, ‘ঢাকায় সেরা ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি কারা?’

যদি আপনার ব্র্যান্ডের নাম সেই উত্তরে উঠে আসে, সেটিই হবে প্রকৃত দৃশ্যমানতা- শুধু ক্লিক নয়, বরং আস্থা, প্রভাব ও ব্র্যান্ড অথরিটি–এর প্রতিফলন।

বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন শত শত নতুন অনলাইন ব্যবসা শুরু হচ্ছে- ই–কমার্স, এডুকেশন, হেলথটেক, রিয়েল এস্টেট, ফাইন্যান্স, এমনকি ছোট স্টার্টআপরাও দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে শুধু এসইও নয়, জিইও–কেন্দ্রিক কৌশলও অপরিহার্য।

জিইও’র ভবিষ্যৎ

খুব শিগগিরই এআই সার্চ টেক্সটের বাইরে গিয়ে ভয়েস, ভিডিও ও ইমেজ কনটেন্ট থেকেও উত্তর তৈরি করবে। তখন জিইও কেবল ওয়েবসাইট নয়, বরং ভিডিও, পডকাস্ট, সোশ্যাল প্রোফাইল, নিউজ রিপোর্ট- সবকিছুর মধ্যেই প্রভাব ফেলবে।

তাই এখন থেকেই যারা জিইও-কেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করবে, ভবিষ্যতের সার্চ রেভোলিউশনে নেতৃত্ব দেবে তারাই।

উপসংহার

জেনারেটিভ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন (জিইও) শুধু নতুন ট্রেন্ড নয়- এটি ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের পরবর্তী অধ্যায়।

এসইও যেমন আপনাকে সার্চ রেজাল্টে নিয়ে যায়, জিইও তেমনি আপনাকে নিয়ে যাবে এআই–এর উত্তরে।

‘ভবিষ্যতের সার্চে র‌্যাংক নয়, ব্র্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতাই হবে সাফল্যের আসল মাপকাঠি।’

লেখক: হেড অব ওয়েব অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এসইও ডিরেক্টর, ইন্টেলেক আইটি এলএলসি (ইউএসএ অ্যান্ড বাংলাদেশ)

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ