Samakal:
2025-08-01@17:48:08 GMT

ঐতিহাসিক দলিলে প্রবাদ

Published: 25th, April 2025 GMT

ঐতিহাসিক দলিলে প্রবাদ

রংচটা, ছেঁড়া, প্রায় বোঝা না যাওয়া লেখা– এ রকম ৩১টি দলিল। এ দলিলগুলোই সবার কাছে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন লাগছে। এদের ওপর রয়েছে বিভিন্ন রঙে আঁকা বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাগধারা ও বচনের চিত্র। সেখানে রাজা, বাঘ, হাতি, গ্রামীণ নারীসহ বিভিন্ন বিষয়কে সহজ ভাষায় তুলে এনেছেন শিল্পী আরহাম উল হক চৌধুরী তাঁর ২০তম একক প্রদর্শনী ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনী ‘দলিলে দৃশ্যপট’-এ।
ছোট্ট একটি বাক্য দিয়ে অনেক কথা বুঝিয়ে দেওয়া যায় বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচনের মধ্য দিয়ে। যেমনটি নিজের একটি কাজ নিয়ে বলছিলেন শিল্পী নিজে। ‘সাজতে গুজতে ফিঙে রাজা’ শীর্ষক কাজটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘একবার ভগবান প্রাণিকুলকে বললেন, আগামীকাল প্রত্যুষে সবাই পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে আসবে এবং যে সঠিক সময়ে আসবে তাকে রাজা ঘোষিত করা হবে। ফিঙে কালো এবং চকচকে সুন্দর, তার কোনো ঝামেলা নেই। সে সারা শরীরে কালি ঢেলে সকাল হওয়ার অপেক্ষা 
করতে লাগল। সে সঠিক সময় উপস্থিত হওয়ার কারণে তাকে রাজা ঘোষিত করা হলো। বাকিরা সাজতে এত সময় ব্যয় করল, সঠিক সময়ে আসতে পারল না।’
এই চিত্রটিতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, একটি ফিঙে পেছনে কালো অন্ধকারের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে যে কখন সকাল হবে, ও যাবে। মূলত বচনটির মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে, আমাদের কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ও পরিপাটি হতে গিয়ে কাজে দেরি করে যাওয়া উচিত নয়। এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বচনের ব্যবহারকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছেন শিল্পী। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, পুরোনো-প্রাচীন বচনগুলোকে ক্ষয়ে পড়া দলিলের ওপর লিখনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হলো– কালের একটা প্রমাণ তত্ত্ব।’ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বচন চিত্রগুলো ক্যালিগ্রাফি ও টাইপোগ্রাফির মিশেলে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ‘লাট সাহেব’, ‘ভরাডুবি’, ‘বাঘা বাঘা’, ‘পটের বিবি’, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চরে সে’সহ বিভিন্ন চিত্র একবার দেখলে সরে যাওয়া মুশকিল। লাল-হলুদ রঙের ছটায় আঁকা ‘যেমন দেব, তেমনি দেবী’ ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সেখানে যেমন হরফগুলো ফুটে উঠেছে কালো কালিতে, ঠিক তেমনি দেব অনুষঙ্গগুলোও রয়েছে সেখানে। প্রতিটি চিত্র বেশ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার পর চিত্রগুলোয় স্থান পাওয়া হরফগুলো চোখে ধরা পড়ে। নয়তো সাধারণ দৃষ্টিতে সেটি কেবলই একটি আঁকিবুঁকি মনে হতে পারে।
আরহাম উল হক চৌধুরী একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ক্যালিগ্রাফার, ভাস্কর, নকশাবিদ ও গবেষক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই শিল্পীর কাজে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পরিবেশ এবং সমাজ মনস্তত্ত্বের গভীর প্রভাব লক্ষণীয়। 
তবে নিজের সম্পূর্ণ প্রদর্শনী ও চিন্তা নিয়ে শিল্পী আরও বলেন, ‘‘দলিলে দৃশ্যপট আমার একটি দীর্ঘ পথচলার অংশ। এই প্রদর্শনী শুধু নান্দনিকতার জন্য নয়, এটি আমাদের ভাষা, ইতিহাস ও বিস্মৃত প্রজ্ঞার পুনরুজ্জীবনের এক প্রয়াস। যেসব উপকরণ সময়ের সাক্ষী, সেসবের মাধ্যমে প্রাচীন প্রবাদগুলোর উপস্থিতি আমার কাছে সময়ের এক জীবন্ত দলিল। আমি সবসময় বাংলা প্রবাদ ও বাগধারার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। সেই প্রয়াসে নানা ধরনের কৌশল এবং কাগজে ব্যবহার করেছি। এই ধারাবাহিকতায় এসেছে প্রাচীন দলিল– কিছু কোম্পানি যুগের, কিছু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের, আবার কিছু পাকিস্তান আমলের। এগুলো আমাদের স্পর্শযোগ্য ঐতিহ্যের অংশ। এদের মূল ব্যবহার আজ ম্লান হলেও, তারা এখনও অনেক কথা বলে। আমি যখন এ দলিলগুলোর ওপর বাংলার প্রবাদ প্রয়োগ করি, তখন ভাষাগত ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক স্মৃতির এক সেতুবন্ধ তৈরি হয়, যা টেকসই ও অর্থবহ। এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য ও সবচেয়ে পুরোনো দলিলের মধ্যে রয়েছে, পূর্ব ভারত কোম্পানি আমলের রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল ও ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কার দলিল। কিছু কাগজ ১৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো। যেমন ‘পটের বিবি’ প্রবাদ এমন প্রাচীন দলিলে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শব্দ ও পৃষ্ঠার সংমিশ্রণে গভীর তাৎপর্য সৃষ্টি হয়েছে।’’ বাংলার প্রবাদ বাক্য ও বর্তমান জীবনে তাদের প্রাসঙ্গিকতা টেনে তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাদ যে কোনো সংস্কৃতির একটি সম্পদ। বাংলা ভাষায় রয়েছে এর ভরপুর দার্শনিকতা, রূপক এবং বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত এই জ্ঞান কখনও হাস্যরস, কখনও ব্যঙ্গ, আবার কখনও কাব্যিক চিত্রকল্পে প্রকাশ পায়। যদিও এগুলোর জন্ম বহু পুরোনো গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, তবুও এগুলোর বক্তব্য আজকের গতিশীল, ডিজিটাল যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক।’
যখন এ পুরোনো কথাগুলো শতবর্ষ পুরোনো কাগজে লেখা হয়, তখন সেগুলো হয়ে ওঠে সময়ের এক জীবন্ত চিহ্ন। শিল্পীর মতে, এসব প্রবাদ কেবল অতীতের প্রতিফলন নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। আরহাম উল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি শব্দের অনুভূতি আঁকতে চেষ্টা করি। শুধু অক্ষর নয়, বরং তাদের গতি, টেক্সচার আর ছন্দও তুলে ধরার চেষ্টা করি আমার কাজের মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে দর্শকদের বলতে চাই, আমরা যা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, তাকে যেন সম্মান করি ও যত্নে রাখি।’
দলিলে দৃশ্যপট প্রদর্শনীটি আর্টকনের সহযোগিতায় আয়োজন করেছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা। প্রদর্শনীটি চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। v
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রব দ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম, এখানে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই: জেড আই খান পান্না

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।

আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বারের হলরুমে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট ও আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জেড আই খান পান্না। সেমিনারটির আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।

বক্তব্যে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। আজ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখি, জুতা দিয়ে বাড়ি দিতে দেখি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তাই আমি সবচেয়ে বড় অসহায়।’

এসব কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জীবনে কখনো জেনে-বুঝে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

জেড আই খান পান্না আরও বলেন, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার দেশ না। সংবিধানে যেন কেউ হাত না দেয়। সরকারের অনেকেই বিদেশি হয়েও স্বদেশি ভাব দেখাচ্ছেন।

সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে ন্যায়বিচার বা সুবিচার পাওয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয় না। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে বেরিয়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা হলেও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না, এমনকি দুঃখও প্রকাশ করে না।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ শুরু হলে তা দমন করতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে সুমন কুমার দাবি করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের বাক্‌স্বাধীনতা বন্ধ করতে, নেতৃত্ব দমন করতে এসব করা হচ্ছে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে কে পাল। সঞ্চালনায় ছিলেন এইচআরসিবিএমের বাংলাদেশ চ্যাপটারের আহ্বায়ক লাকি বাছাড়। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ও মো. গোলাম মোস্তফা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ