রংচটা, ছেঁড়া, প্রায় বোঝা না যাওয়া লেখা– এ রকম ৩১টি দলিল। এ দলিলগুলোই সবার কাছে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন লাগছে। এদের ওপর রয়েছে বিভিন্ন রঙে আঁকা বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাগধারা ও বচনের চিত্র। সেখানে রাজা, বাঘ, হাতি, গ্রামীণ নারীসহ বিভিন্ন বিষয়কে সহজ ভাষায় তুলে এনেছেন শিল্পী আরহাম উল হক চৌধুরী তাঁর ২০তম একক প্রদর্শনী ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনী ‘দলিলে দৃশ্যপট’-এ।
ছোট্ট একটি বাক্য দিয়ে অনেক কথা বুঝিয়ে দেওয়া যায় বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচনের মধ্য দিয়ে। যেমনটি নিজের একটি কাজ নিয়ে বলছিলেন শিল্পী নিজে। ‘সাজতে গুজতে ফিঙে রাজা’ শীর্ষক কাজটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘একবার ভগবান প্রাণিকুলকে বললেন, আগামীকাল প্রত্যুষে সবাই পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে আসবে এবং যে সঠিক সময়ে আসবে তাকে রাজা ঘোষিত করা হবে। ফিঙে কালো এবং চকচকে সুন্দর, তার কোনো ঝামেলা নেই। সে সারা শরীরে কালি ঢেলে সকাল হওয়ার অপেক্ষা
করতে লাগল। সে সঠিক সময় উপস্থিত হওয়ার কারণে তাকে রাজা ঘোষিত করা হলো। বাকিরা সাজতে এত সময় ব্যয় করল, সঠিক সময়ে আসতে পারল না।’
এই চিত্রটিতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, একটি ফিঙে পেছনে কালো অন্ধকারের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে যে কখন সকাল হবে, ও যাবে। মূলত বচনটির মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে, আমাদের কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ও পরিপাটি হতে গিয়ে কাজে দেরি করে যাওয়া উচিত নয়। এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বচনের ব্যবহারকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছেন শিল্পী। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, পুরোনো-প্রাচীন বচনগুলোকে ক্ষয়ে পড়া দলিলের ওপর লিখনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হলো– কালের একটা প্রমাণ তত্ত্ব।’ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বচন চিত্রগুলো ক্যালিগ্রাফি ও টাইপোগ্রাফির মিশেলে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ‘লাট সাহেব’, ‘ভরাডুবি’, ‘বাঘা বাঘা’, ‘পটের বিবি’, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চরে সে’সহ বিভিন্ন চিত্র একবার দেখলে সরে যাওয়া মুশকিল। লাল-হলুদ রঙের ছটায় আঁকা ‘যেমন দেব, তেমনি দেবী’ ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সেখানে যেমন হরফগুলো ফুটে উঠেছে কালো কালিতে, ঠিক তেমনি দেব অনুষঙ্গগুলোও রয়েছে সেখানে। প্রতিটি চিত্র বেশ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার পর চিত্রগুলোয় স্থান পাওয়া হরফগুলো চোখে ধরা পড়ে। নয়তো সাধারণ দৃষ্টিতে সেটি কেবলই একটি আঁকিবুঁকি মনে হতে পারে।
আরহাম উল হক চৌধুরী একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ক্যালিগ্রাফার, ভাস্কর, নকশাবিদ ও গবেষক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই শিল্পীর কাজে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পরিবেশ এবং সমাজ মনস্তত্ত্বের গভীর প্রভাব লক্ষণীয়।
তবে নিজের সম্পূর্ণ প্রদর্শনী ও চিন্তা নিয়ে শিল্পী আরও বলেন, ‘‘দলিলে দৃশ্যপট আমার একটি দীর্ঘ পথচলার অংশ। এই প্রদর্শনী শুধু নান্দনিকতার জন্য নয়, এটি আমাদের ভাষা, ইতিহাস ও বিস্মৃত প্রজ্ঞার পুনরুজ্জীবনের এক প্রয়াস। যেসব উপকরণ সময়ের সাক্ষী, সেসবের মাধ্যমে প্রাচীন প্রবাদগুলোর উপস্থিতি আমার কাছে সময়ের এক জীবন্ত দলিল। আমি সবসময় বাংলা প্রবাদ ও বাগধারার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। সেই প্রয়াসে নানা ধরনের কৌশল এবং কাগজে ব্যবহার করেছি। এই ধারাবাহিকতায় এসেছে প্রাচীন দলিল– কিছু কোম্পানি যুগের, কিছু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের, আবার কিছু পাকিস্তান আমলের। এগুলো আমাদের স্পর্শযোগ্য ঐতিহ্যের অংশ। এদের মূল ব্যবহার আজ ম্লান হলেও, তারা এখনও অনেক কথা বলে। আমি যখন এ দলিলগুলোর ওপর বাংলার প্রবাদ প্রয়োগ করি, তখন ভাষাগত ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক স্মৃতির এক সেতুবন্ধ তৈরি হয়, যা টেকসই ও অর্থবহ। এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য ও সবচেয়ে পুরোনো দলিলের মধ্যে রয়েছে, পূর্ব ভারত কোম্পানি আমলের রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল ও ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কার দলিল। কিছু কাগজ ১৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো। যেমন ‘পটের বিবি’ প্রবাদ এমন প্রাচীন দলিলে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শব্দ ও পৃষ্ঠার সংমিশ্রণে গভীর তাৎপর্য সৃষ্টি হয়েছে।’’ বাংলার প্রবাদ বাক্য ও বর্তমান জীবনে তাদের প্রাসঙ্গিকতা টেনে তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাদ যে কোনো সংস্কৃতির একটি সম্পদ। বাংলা ভাষায় রয়েছে এর ভরপুর দার্শনিকতা, রূপক এবং বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত এই জ্ঞান কখনও হাস্যরস, কখনও ব্যঙ্গ, আবার কখনও কাব্যিক চিত্রকল্পে প্রকাশ পায়। যদিও এগুলোর জন্ম বহু পুরোনো গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, তবুও এগুলোর বক্তব্য আজকের গতিশীল, ডিজিটাল যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক।’
যখন এ পুরোনো কথাগুলো শতবর্ষ পুরোনো কাগজে লেখা হয়, তখন সেগুলো হয়ে ওঠে সময়ের এক জীবন্ত চিহ্ন। শিল্পীর মতে, এসব প্রবাদ কেবল অতীতের প্রতিফলন নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। আরহাম উল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি শব্দের অনুভূতি আঁকতে চেষ্টা করি। শুধু অক্ষর নয়, বরং তাদের গতি, টেক্সচার আর ছন্দও তুলে ধরার চেষ্টা করি আমার কাজের মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে দর্শকদের বলতে চাই, আমরা যা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, তাকে যেন সম্মান করি ও যত্নে রাখি।’
দলিলে দৃশ্যপট প্রদর্শনীটি আর্টকনের সহযোগিতায় আয়োজন করেছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা। প্রদর্শনীটি চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।