Samakal:
2025-04-30@21:39:39 GMT

ঐতিহাসিক দলিলে প্রবাদ

Published: 25th, April 2025 GMT

ঐতিহাসিক দলিলে প্রবাদ

রংচটা, ছেঁড়া, প্রায় বোঝা না যাওয়া লেখা– এ রকম ৩১টি দলিল। এ দলিলগুলোই সবার কাছে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন লাগছে। এদের ওপর রয়েছে বিভিন্ন রঙে আঁকা বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাগধারা ও বচনের চিত্র। সেখানে রাজা, বাঘ, হাতি, গ্রামীণ নারীসহ বিভিন্ন বিষয়কে সহজ ভাষায় তুলে এনেছেন শিল্পী আরহাম উল হক চৌধুরী তাঁর ২০তম একক প্রদর্শনী ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনী ‘দলিলে দৃশ্যপট’-এ।
ছোট্ট একটি বাক্য দিয়ে অনেক কথা বুঝিয়ে দেওয়া যায় বাগধারা কিংবা প্রবাদ প্রবচনের মধ্য দিয়ে। যেমনটি নিজের একটি কাজ নিয়ে বলছিলেন শিল্পী নিজে। ‘সাজতে গুজতে ফিঙে রাজা’ শীর্ষক কাজটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘একবার ভগবান প্রাণিকুলকে বললেন, আগামীকাল প্রত্যুষে সবাই পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে আসবে এবং যে সঠিক সময়ে আসবে তাকে রাজা ঘোষিত করা হবে। ফিঙে কালো এবং চকচকে সুন্দর, তার কোনো ঝামেলা নেই। সে সারা শরীরে কালি ঢেলে সকাল হওয়ার অপেক্ষা 
করতে লাগল। সে সঠিক সময় উপস্থিত হওয়ার কারণে তাকে রাজা ঘোষিত করা হলো। বাকিরা সাজতে এত সময় ব্যয় করল, সঠিক সময়ে আসতে পারল না।’
এই চিত্রটিতে খেয়াল করলে দেখা যাবে, একটি ফিঙে পেছনে কালো অন্ধকারের মধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে যে কখন সকাল হবে, ও যাবে। মূলত বচনটির মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে, আমাদের কাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ও পরিপাটি হতে গিয়ে কাজে দেরি করে যাওয়া উচিত নয়। এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে বচনের ব্যবহারকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছেন শিল্পী। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, পুরোনো-প্রাচীন বচনগুলোকে ক্ষয়ে পড়া দলিলের ওপর লিখনের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হলো– কালের একটা প্রমাণ তত্ত্ব।’ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া বচন চিত্রগুলো ক্যালিগ্রাফি ও টাইপোগ্রাফির মিশেলে এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ‘লাট সাহেব’, ‘ভরাডুবি’, ‘বাঘা বাঘা’, ‘পটের বিবি’, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চরে সে’সহ বিভিন্ন চিত্র একবার দেখলে সরে যাওয়া মুশকিল। লাল-হলুদ রঙের ছটায় আঁকা ‘যেমন দেব, তেমনি দেবী’ ছবিটি ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সেখানে যেমন হরফগুলো ফুটে উঠেছে কালো কালিতে, ঠিক তেমনি দেব অনুষঙ্গগুলোও রয়েছে সেখানে। প্রতিটি চিত্র বেশ সময় নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার পর চিত্রগুলোয় স্থান পাওয়া হরফগুলো চোখে ধরা পড়ে। নয়তো সাধারণ দৃষ্টিতে সেটি কেবলই একটি আঁকিবুঁকি মনে হতে পারে।
আরহাম উল হক চৌধুরী একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ক্যালিগ্রাফার, ভাস্কর, নকশাবিদ ও গবেষক হিসেবেও তিনি সমাদৃত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এই শিল্পীর কাজে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পরিবেশ এবং সমাজ মনস্তত্ত্বের গভীর প্রভাব লক্ষণীয়। 
তবে নিজের সম্পূর্ণ প্রদর্শনী ও চিন্তা নিয়ে শিল্পী আরও বলেন, ‘‘দলিলে দৃশ্যপট আমার একটি দীর্ঘ পথচলার অংশ। এই প্রদর্শনী শুধু নান্দনিকতার জন্য নয়, এটি আমাদের ভাষা, ইতিহাস ও বিস্মৃত প্রজ্ঞার পুনরুজ্জীবনের এক প্রয়াস। যেসব উপকরণ সময়ের সাক্ষী, সেসবের মাধ্যমে প্রাচীন প্রবাদগুলোর উপস্থিতি আমার কাছে সময়ের এক জীবন্ত দলিল। আমি সবসময় বাংলা প্রবাদ ও বাগধারার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। সেই প্রয়াসে নানা ধরনের কৌশল এবং কাগজে ব্যবহার করেছি। এই ধারাবাহিকতায় এসেছে প্রাচীন দলিল– কিছু কোম্পানি যুগের, কিছু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের, আবার কিছু পাকিস্তান আমলের। এগুলো আমাদের স্পর্শযোগ্য ঐতিহ্যের অংশ। এদের মূল ব্যবহার আজ ম্লান হলেও, তারা এখনও অনেক কথা বলে। আমি যখন এ দলিলগুলোর ওপর বাংলার প্রবাদ প্রয়োগ করি, তখন ভাষাগত ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক স্মৃতির এক সেতুবন্ধ তৈরি হয়, যা টেকসই ও অর্থবহ। এ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য ও সবচেয়ে পুরোনো দলিলের মধ্যে রয়েছে, পূর্ব ভারত কোম্পানি আমলের রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনকাল ও ব্রিটিশ রাজত্বের সময়কার দলিল। কিছু কাগজ ১৫০ বছরেরও বেশি পুরোনো। যেমন ‘পটের বিবি’ প্রবাদ এমন প্রাচীন দলিলে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে শব্দ ও পৃষ্ঠার সংমিশ্রণে গভীর তাৎপর্য সৃষ্টি হয়েছে।’’ বাংলার প্রবাদ বাক্য ও বর্তমান জীবনে তাদের প্রাসঙ্গিকতা টেনে তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাদ যে কোনো সংস্কৃতির একটি সম্পদ। বাংলা ভাষায় রয়েছে এর ভরপুর দার্শনিকতা, রূপক এবং বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত এই জ্ঞান কখনও হাস্যরস, কখনও ব্যঙ্গ, আবার কখনও কাব্যিক চিত্রকল্পে প্রকাশ পায়। যদিও এগুলোর জন্ম বহু পুরোনো গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, তবুও এগুলোর বক্তব্য আজকের গতিশীল, ডিজিটাল যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক।’
যখন এ পুরোনো কথাগুলো শতবর্ষ পুরোনো কাগজে লেখা হয়, তখন সেগুলো হয়ে ওঠে সময়ের এক জীবন্ত চিহ্ন। শিল্পীর মতে, এসব প্রবাদ কেবল অতীতের প্রতিফলন নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। আরহাম উল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি শব্দের অনুভূতি আঁকতে চেষ্টা করি। শুধু অক্ষর নয়, বরং তাদের গতি, টেক্সচার আর ছন্দও তুলে ধরার চেষ্টা করি আমার কাজের মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে দর্শকদের বলতে চাই, আমরা যা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, তাকে যেন সম্মান করি ও যত্নে রাখি।’
দলিলে দৃশ্যপট প্রদর্শনীটি আর্টকনের সহযোগিতায় আয়োজন করেছে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা। প্রদর্শনীটি চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত। v
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রব দ র একট

এছাড়াও পড়ুন:

চিনি-লবণের অনুপম পাঠ

চিনি আর লবণ– দুটিই সাদা ও ঝকঝকে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক হলেও তাদের স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই সরল অথচ গভীর সত্যটি আমাদের চারপাশের সমাজের প্রতিচ্ছবি। আজ যখন মানুষ শুভাকাঙ্ক্ষীর মুখোশ পরে এগিয়ে আসে, আমরা বুঝতে পারি না– কে চিনি, কে লবণ। এই বিভ্রমের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের চিরন্তন দ্বন্দ্ব। তার ফলে সমাজে জন্ম নিচ্ছে ভাঙন, ক্ষয় ও ব্যথার করুণ কাব্য।

শুভাকাঙ্ক্ষী সেজে প্রতারণার ছায়া আজ সমাজের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনও বন্ধুত্বের আবরণে, কখনও আত্মীয়তার মোড়কে, আবার কখনও নির্ভরতার চাদরে ঢাকা পড়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের বারবার আহত করে। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন বা পারিবারিক জীবন– বিশ্বাসের অবক্ষয়ের নির্মম চিত্র আজ সর্বত্র বিদ্যমান। সবচেয়ে আপন বলে যার হাত ধরেছি, সেই হাত কখন যে ছুরি হয়ে ফিরে আসে– বলা দুষ্কর।

সম্প্রতি রাজধানীর উপকণ্ঠে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা আমাদের ব্যথিত করেছে। বৃদ্ধ মা তাঁর তিন সন্তানকে অকুণ্ঠ বিশ্বাস করে সব সম্পত্তি লিখে দেন। সন্তানরা কথা দিয়েছিল– শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের পাশে থাকবে। কিন্তু দলিলের কালি শুকানোর আগেই মাকে উঠিয়ে দেওয়া হয় বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের চোখের জল তখন ছিল মূল্যহীন; সম্পদের নেশাই ছিল মূল।

অন্যদিকে দীর্ঘদিনের ‘বিশ্বস্ত’ বন্ধু ব্যবসার আড়ালে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে রাতের অন্ধকারে। এসব গল্প আজ প্রতিটি নগর-পল্লীর অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পর্কের পবিত্রতা আজ যেন লোভ ও মুনাফার কাছে নতজানু।

বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা কোনো দাগের মতো নয়, যা সময়ের সঙ্গে মুছে যায়। বরং এটি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। একজনের আঘাত শুধু তার নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না; ছড়িয়ে পড়ে সমাজজুড়ে। গড়ে ওঠে এক অবিশ্বাসের দেয়াল, যেখানে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সম্পর্কের উষ্ণতা ক্রমে ঠান্ডা হতে হতে বরফে পরিণত হয়, যা গলাতে লাগে যুগের পর যুগ।

ভোগবাদী সভ্যতা মানুষকে করে তুলেছে আত্মকেন্দ্রিক। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিকতার সংকট এবং তাৎক্ষণিক লাভের মোহে সম্পর্কও আজ মুনাফার মাপে মাপা হয়। বন্ধুত্ব, আত্মীয়তা, প্রেম– সবকিছু যেন পরিণত হয়েছে একেকটি চুক্তিতে। ‘কে কতটা কাজে লাগবে’– এই প্রশ্নই আজ সম্পর্কের মানদণ্ড। তবে সব আলো নিভে যায়নি। অন্ধকার যত গভীর হোক, এক টুকরো মোমবাতি গোটা ঘর আলোকিত করতে পারে। এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক হতে হবে। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে, যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবেগের তাড়নায় নয়, বিবেকের আলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে মজবুত করতে হবে। শিশুর মনে শৈশব থেকেই সততা, বিশ্বস্ততা ও মানবিকতার বীজ বপন করতে হবে। পরিবারই হচ্ছে ব্যক্তিত্ব গঠনের মূল কেন্দ্র। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতারণা ও বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে সমাজে ন্যায়বোধ প্রতিষ্ঠা পায়। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে নৈতিক চেতনা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে হবে। তবু এই অন্ধকারে কিছু আলোকবর্তিকা রয়েছেন, যারা এখনও বিশ্বাসের মানদণ্ডে অবিচল। যাদের জীবন শুধু নিজের জন্য নয়, অপরের কল্যাণে নিবেদিত। সংকটে পাশে দাঁড়ানো, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিলানো– এটাই তাদের ধর্ম। এরা প্রমাণ করে– বিশ্বাস এখনও বিলুপ্ত হয়নি পুরোপুরি। শুধু খুঁজে নিতে জানতে হবে।

পরিশেষে, চিনি ও লবণের বাহ্যিক সাদার ভ্রম নয়, আসল স্বাদ বোঝার সক্ষমতা অর্জন করাই আজ সময়ের দাবি। মানুষকে তার কার্যকলাপের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে; বাহ্যিক মোহের ফাঁদে পা না দিয়ে। অন্ধবিশ্বাস নয়– সচেতন, বিবেকবান বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্পর্কের ভিত।

মুহাম্মদ ইমাদুল হক প্রিন্স: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ