ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় উত্তেজনার মধ্যে সীমান্তে গোলাগুলিতে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। গত বৃহস্পতিবার রাতভর কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এ গোলাগুলি হয়। এ অবস্থায় উভয় পক্ষকে ‘চরম সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। দু’দেশই সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে এবং সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ চেয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে।

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানান, লিপা উপত্যকায় সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখায় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। তবে বেসামরিক এলাকায় কোনো গুলির শব্দ শোনা যায়নি। জীবনযাপন স্বাভাবিক ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে।

ভারতের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারতীয় অবস্থান লক্ষ্য করে পাকিস্তানের সেনারা ছোট আকৃতির অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করে ভারতের এক সেনা কর্মকর্তা জানান, গুলির জবাব দিয়েছেন তারা। এ পরিস্থিতিকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের শ্রীনগরে উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা বৈঠক করেছেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী। 

গত মঙ্গলবার পেহেলগামে বন্দুকধারীর হামলায় ২৬ বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতাও দেখছেন দেশটির বিরোধী দলগুলোর নেতারা। তাদের প্রশ্ন, হামলার সময় পেহেলগামের জনপ্রিয় ওই পর্যটনকেন্দ্রে কেন সেনা মোতায়েন ছিল না। বৃহস্পতিবার সর্বদলীয় বৈঠকে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে বিরোধীরা বলেন, পেহেলগামের বৈসরনে ওই হামলার সময় আশপাশে কোনো সেনাসদস্য ছিলেন না। প্রশ্নটি প্রথমে তোলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। পরে তাঁর সঙ্গে সুর মেলান কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও আম আদমি পার্টির নেতা সঞ্জয় সিং।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন জানায়, পেহেলগাম হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে তলানিতে ঠেকেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে বেসামরিক মানুষের ওপর ‘আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদে’ উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে।

এ অবস্থায় গতকাল শুক্রবার ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশটিতে থাকা সব পাকিস্তানিকে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এনডিটিভি জানায়, অমিত শাহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এ নির্দেশ দেন। এর আগে ভারত সব পাকিস্তানির সার্ক ভিসা বাতিল করে, যা আগামী রোববার থেকে কার্যকর হবে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে পাকিস্তানও। তারা ভারতীয়দের ভিসা বাতিলের পাশাপাশি ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। 

অন্যদিকে, একজন পাকিস্তানিও যদি ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাহলে ভারতকে পরিণাম ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। তিনি বলেন, যদি ভারত পাকিস্তানের মাটিতে কোনো অভিযান চালানোর কথা চিন্তা করে, এটা কোনো ভুল বোঝাবুঝির মধ্যে থাকা উচিত নয়। তাদের (ভারত) এর পরিণাম ভোগ করতে হবে। বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, যদি পাকিস্তানের নাগরিকরা নিরাপদ না থাকেন, ভারতকেও এর পরিণাম ভোগ করতে হবে। পাকিস্তানের শহরগুলোতে ভারতের সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে– এমন তথ্য পাকিস্তানের কাছে আছে। ভারত যদি পাকিস্তানের কোনো শহরে কোনো ধরনের তৎপরতা চালায়, কোনো পাকিস্তানি নাগরিকের ক্ষতি করে, তবে পাকিস্তানও একইভাবে জবাব দেবে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘ভারতসহ যে কোনো স্থানে সংঘটিত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নিন্দা জানাই আমরা। কিন্তু আমাদের নিজেদেরও আত্মরক্ষার পূর্ণ অধিকার রয়েছে।’

পেহেলগাম হামলাকে কেন্দ্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একগুচ্ছ পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিলেও সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত ও পাকিস্তানের আকাশপথ বন্ধ হতে পারে তাৎক্ষণিক প্রভাব বিস্তারকারী। পাকিস্তান এরই মধ্যে সিন্ধুর পানি প্রবাহ বন্ধ করা নিয়ে ভারতকে কঠোর বার্তা দিয়ে সতর্ক করেছে। তারা এটাকে ‘যুদ্ধ করার শামিল’ বলে বর্ণনা করেছে। 
এর জেরে বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের লাহোরে ভারত সীমান্তের কাছে বিক্ষোভ করেন কয়েকশ মানুষ। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আজমল বেলুচ নামের এক ব্যবসায়ী ফ্রান্স টোয়ান্টিফোরকে বলেন, ‘ভারত যদি যুদ্ধ চায়, তাহলে সরাসরি আসুক।’ মোহাম্মদ ওয়াইস নামের আরেকজন বলেন, ‘পানি আমাদের অধিকার। এটা আল্লাহর ইচ্ছা। আমরা এর দাবি রাখি। এর জন্য যুদ্ধ করতে হলেও করব। আমরা মাথা নত করব না।’ বিক্ষোভ হয়েছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুজাফ্ফরাবাদেও। সেখানে শওকত জাভেদ মির নামের একজন বলেন, ‘পাকিস্তানের হামলা করার ভুল যদি ভারত করে, তাহলে আমরা সামনের সারিতে থেকে লড়াই করব। আমরা পাকিস্তানের জন্য মরতে প্রস্তুত।’ বিক্ষোভ হয়েছে বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটায়ও। 

একই দিনে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের বাইরেও বিক্ষোভ করে ভারতীয়রা। এক বিক্ষোভকারী এনডিটিভিকে বলেন, ‘যখন আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন আসবে, তখন সব দলকে তাদের নীতিগত বৈষম্য দূর করে দেশের জন্য এক হতে হবে।’ 

বিক্ষোভ হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও। কলকাতা প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ও রাতে পশ্চিমবঙ্গে ধারাবাহিকভাবে চলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। এতে পেহেলগামে হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার দাবি ওঠে। রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন এর প্রতিবাদে মিছিল, মৌন মিছিল, মোমবাতি মিছিল করেছে। সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা একটি বড় মোমবাতি মিছিল বের করেন। কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বের করেন মৌন মিছিল। মিছিল করেছেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে প্রতিবাদ মিছিল করে সিপিএম। নদীয়ার কৃষ্ণনগরে মোমবাতি মিছিল করেছে তৃণমূল। বর্ধমান আদালতের আইনজীবীরা মিছিল করেন। 

এ পরিস্থিতিতে দুই দেশকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা উভয় সরকারের কাছেই আবেদন করছি, তারা যেন সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করে। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি যাতে আরও অবনতি না হয়, তা নিশ্চিত করে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে কোনো সমস্যা অর্থপূর্ণ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যেতে পারে এবং এটা করা উচিত।’ 

এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তারা। বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস এক প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান। 
এদিকে কাশ্মীর হামলার ঘটনায় সমবেদনা জানাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বৃহস্পতিবার তাদের মধ্যে এ ফোনালাপ হয়। নেতানিয়াহুর কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, মোদি ভারতের জনগণের শোক ভাগ করে নেওয়ার জন্য নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, দু’দেশই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অভিযানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে।

সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত নিয়ে বিশ্বব্যাংককে কিছুই জানায়নি ভারত
পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিন্ধু পানিচুক্তি (আইডব্লিউটি) একতরফা স্থগিত করার ভারতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিশ্বব্যাংককে (ডব্লিউবি) কিছু জানানো হয়নি। বিশ্বব্যাংক এ কথা জানিয়েছে বলে কয়েকটি সূত্র ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুকে নিশ্চিত করেছে। অতীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পানিবণ্টন-সংক্রান্ত বিরোধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বিশ্বব্যাংক। গত বৃহস্পতিবার ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখার্জি পাকিস্তানের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আলি মুর্তজাকে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি লেখেন, ভারত ওই চুক্তি স্থগিত করছে এবং ‘অবিলম্বে তা কার্যকর’ হবে।
ভারতের এক সরকারি সূত্র দ্য হিন্দুকে বলেছে, চুক্তি নিয়ে ভারতের অবস্থান পাকিস্তানকে জানানো হয়েছে। তাই এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংককে জানানোর ‘কোনো প্রয়োজন’ নেই। বিশ্বব্যাংকের এক মুখপাত্র বলেন, চুক্তি নিয়ে সদস্য দেশগুলোর সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে তারা কোনো মতামত দেননি।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ক ষ ভ হয় ছ ম ছ ল কর অবস থ য় র জন য মন ত র র ঘটন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

করের চাপ কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের

আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে করের চাপ কমানোর দাবি জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলছেন, করজাল বৃদ্ধি না পাওয়ায় যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপরই করের চাপ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি করহারের চেয়েও প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি কর দিতে হয় তাঁদের। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের যে হয়রানি করেন, তা বন্ধ করতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৪৫তম সভায় এ দাবিগুলো জানান বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা। এনবিআর এবং ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল বুধবার এই সভার আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।

পরামর্শক সভায় বিভিন্ন খাতের প্রায় ৪০ জন ব্যবসায়ী নেতা বাজেটে বাস্তবায়নের জন্য নানা দাবি তুলে ধরেন। শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান সাধারণ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতাদের জন্য এই সীমা পাঁচ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো জরুরি। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষদের নিত্যপণ্য কিনতে আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে। এই বাস্তবতায় বিদ্যমান করকাঠামো তাঁদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

এ ছাড়া পণ্য রপ্তানিতে পাঁচ বছরের জন্য উৎসে কর দশমিক ৫০ শতাংশ করা, আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম আয়কর ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা, স্থানীয় পর্যায়ে সব পণ্য সরবরাহে মূসক ২ শতাংশ নির্ধারণ, যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে এইচএস কোডে ভুলের জন্য জরিমানার যে বিধান আছে, সেটি বাতিলের সুপারিশ করেছে এফবিসিসিআই।

অন্যদিকে বাজেটে করহার না কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। তিনি বলেন, করহার আর কমানো সম্ভব নয়। তবে ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা থাকবে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সব কথা হয়তো শুনতে পারব না। কারণ, সরকারের রাজস্ব আয় কমানো যাবে না। সরকার চালাতে রাজস্বের প্রয়োজন।’

করজাল বাড়ানোর ওপর জোর

করজাল বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে মেট্রোপলিটন চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, করজাল বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। দেশে ১ কোটি ১৪ লাখ করদাতা রয়েছেন। এর মধ্যে ৪৫ লাখ রিটার্ন দেন, যাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ শূন্য রিটার্ন জমা দেন। ফলে এখানে গুণগত পরিবর্তন দরকার। করজাল না বাড়িয়ে বর্তমান করদাতার ওপর বিভিন্নভাবে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এতে রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে করদাতাদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট হয়।

সরকারের মোট রাজস্ব আহরণের ৮৪ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আসে—এমন তথ্য দিয়ে ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি রাজীব চৌধুরী বলেন, অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে কর আহরণ বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ দেশের অর্থনীতিতে ৬০-৭০ শতাংশ অবদানই এই খাতের।

তিন পার্বত্য জেলায় তিনটি কর অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবি জানান রাঙামাটি চেম্বারের প্রতিনিধি বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, মানুষের মন থেকে করভীতি দূর করতে হবে। তাহলে স্বচ্ছন্দে কর দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।

গ্যাস-বিদ্যুৎ চান ব্যবসায়ীরা

কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেও গ্যাস–বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমরাসহ অনেকেই কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইজেড) বিনিয়োগ করেছেন। আমরা ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছি। তবে দুই বছরেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। আমরা বিদেশিদের বিনিয়োগের জন্য ডাকছি। অথচ নিজের দেশের উদ্যোক্তারা জ্বালানিসংকটে ভুগছেন। এটা অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে।’

মোস্তফা কামাল আরও বলেন, সবাই করজাল বাড়ানোর কথা বলেছেন। বাস্তবতা হলো, যাঁরা কর দেন, তাঁদের ওপর আরও বেশি করের চাপ আসে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেকের ব্যাংক হিসাব ও করনথি তল্লাশি করা হচ্ছে। এ ছাড়া তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া ঢালাওভাবে তল্লাশি করে ব্যবসায়ীদের যেন হয়রানি করা না হয়, সে জন্য এনবিআরকে অনুরোধ জানান।

সিরামিকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএর সভাপতি মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে সিরামিক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সিরামিক পণ্যের মূল কাঁচামাল হিসেবে যে মাটি আমদানি করা হয়, তার মধ্যে ২০-৩০ শতাংশ পানি থাকে। এটি বাদ দিয়ে শুল্কায়ন করা হলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।’

ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমানোর দাবি

ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমিয়ে ৯ শতাংশ করার দাবি জানান আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের পরিচালক আইয়ুব আলী। তিনি বলেন, বর্তমানে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি সর্বমোট ১৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। এটি কমানো গেলে গ্রাহকেরা ফ্ল্যাট নিবন্ধনে আগ্রহী হবেন।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘নিবন্ধন ফি কমানোর ক্ষেত্রে জমি বা ফ্ল্যাটের প্রকৃত মূল্যায়ন হচ্ছে বড় সমস্যা। এটা ঠিক করা গেলে নিবন্ধন ফি ৯ শতাংশ করা হলেও সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। এটার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। হয়তো একদিন সফল হব।’

নির্মাণ খাতের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান ইস্পাতশিল্পে সরকারের বিশেষ নজর দাবি করেন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মাসাদুল আলম। তিনি বলেন, ‘কাস্টমসের অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। এক টন স্ক্র্যাপ আনতে ১ হাজার ২০০ টাকা কর দিই। কিন্তু চালানে কোনো স্ক্র্যাপ ৫-৭ ফুট দীর্ঘ হলেও হয়রানি করা হয়। এতে সময় ও অর্থ অপচয় হয়। এখান থেকে বের হতে হবে।’

শুল্ক কমান, রপ্তানি বাড়বে

প্লাস্টিকের খেলনা তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান আমদানিতে শুল্ক কমানো হলে রপ্তানি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিপিজিএমইএ) সভাপতি শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, খেলনাশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। দেশে কারখানা গড়ে ওঠায় খেলনা আমদানি কমে গেছে। রপ্তানিও হচ্ছে অনেক দেশে।

সিলেট চেম্বারের প্রতিনিধি হিসকিল গুলজার বলেন, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে। সেখান থেকে দিনে ১২-১৪টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট যাচ্ছে। হ্যান্ডলিং চার্জসহ অন্যান্য মাশুল কমানো গেলে পণ্য রপ্তানি বাড়বে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ। তিনি বলেন, ‘একসময় যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে বিটিএমএ ছাড়পত্র দিত। কোনো বিতর্ক হয়নি। এনবিআর পুরো বিষয়টি নিজের হাতে নেওয়ার পর জটিলতা বেড়েছে। দেখা যায়, ৩০ হাজার টাকা শুল্ক–কর জমা দিতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।’

ভারত থেকে বেনাপোল দিয়ে সুতা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন তৈরি পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন।

নিট পোশাকশিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান প্রশাসন বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সেবা মসৃণ হয়েছে। তবে বন্ড কমিশনারেট কার্যালয়ের নিচের দিকে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। সেখানে নজর দিতে হবে।

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু।

সম্পর্কিত নিবন্ধ