তাহসিন তাজওয়ার জিয়া। ২০ এপ্রিল হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ফারাগো ইভান মেমোরিয়াল গ্র্যান্ডমাস্টার দাবায় স্বাগতিক দেশের গ্র্যান্ডমাস্টার গেরগেলি আৎসেলকে হারিয়ে বহুল কাঙ্ক্ষিত তৃতীয় আইএম নর্ম পান। আইএম খেতাব পেতে তাহসিনের রেটিং ২৩৭৪। আর ২৬ রেটিং পেলে তাকে এনে দেবে আইএম খেতাব। তাহসিনের বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান দেশের দাবার পোস্টারম্যান। স্বপ্নবাজ এই তরুণের স্বপ্নের পথে ছুটে চলার গল্প শুনেছেন আশিক মুস্তাফা
দা বায় আন্তর্জাতিক মাস্টার বা আইএম হতে আর তিনটি নর্ম দরকার ফিদে মাস্টার তাহসিন তাজওয়ার জিয়ার। তাহসিন তাঁর বহুল কাঙ্ক্ষিত তৃতীয় আইএম নর্মটি পেলেন গত ২০ এপ্রিল। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ফারাগো ইভান মেমোরিয়াল গ্র্যান্ডমাস্টার দাবায় দশম রাউন্ডে স্বাগতিক দেশের গ্র্যান্ডমাস্টার গেরগেলি আৎসেলকে হারিয়ে এই আইএম নর্ম অর্জন করেন তাহসিন। কেবল তাই নয়, টুর্নামেন্টে রানারআপও হয়েছেন এই ফিদে মাস্টার। দশ ম্যাচে তাঁর পয়েন্ট ৬। এক ম্যাচ হেরেছেন, যেটি ছিল নবম রাউন্ডে। তিনটি জিতেছেন, ছয়টি ড্র। তবে আইএম খেতাব পেতে তাহসিনের রেটিং হতে হবে ২৪০০। এ টুর্নামেন্ট শেষে তাঁর রেটিং ২৩৭৪। এক-দুটি টুর্নামেন্টেই হয়তো তা পূরণ করে ফেলতে পারবেন।
একটু পেছনে ফিরে
তাহসিন তাজওয়ার জিয়া তাঁর প্রথম আইএম নর্ম অর্জন করেন ২০২৩ সালে ঢাকায় এশিয়ান জোনাল চ্যাম্পিয়নশিপে। দ্বিতীয়টি গত মাসে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত এশিয়ান জোনালে। ওই টুর্নামেন্টে রানারআপ হন তাহসিন। কলম্বোয় খেলে হাঙ্গেরিতে গিয়েছিলেন তিনটি টুর্নামেন্টে খেলতে। প্রথম দুটিতে নর্ম না মিললেও তৃতীয়টি তাঁকে নিরাশ করেনি। এই নর্ম অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে তাহসিন বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। আজ বাবা থাকলে আরও বেশি ভালো লাগতো। তবে এই অর্জনে বাবার স্বপ্ন পূরণে এক ধাপ এগিয়েছি। সামনে বাকি নর্মগুলো অর্জন করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।’
তাহসিন ও দেশের দাবার দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া
তাহসিন তাজওয়ারের বাবা গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশের দাবার দ্বিতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার। ২০২৪ সালের ৫ জুলাই বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে জাতীয় দাবায় খেলতে খেলতেই তিনি আকস্মিক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ‘বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে গ্র্যান্ডমাস্টার হবে।’ এ কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে জিয়াপত্নী তাসমিন সুলতানা লাবণ্যর। চোখ মুছে, নিজেকে সামলে বলেন, ‘ছেলের এমন অর্জন তার বাবা দেখে যেতে পারেনি। আজ জিয়া থাকলে খুব খুশি হতো। ওর কথা অনেক মনে পড়ছে। তবে জিয়া না থাকলেও নিশ্চয় সে সব দেখতে পাচ্ছে এবং খুশি হয়েছে। তাহসিন আইএম হওয়ার জন্য তৃতীয় নর্ম করেছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। তবে ছেলের জন্য কতোটা পরিশ্রম করে যাচ্ছি তা বলে বোঝানো যাবে না। তবু দিন শেষে এমন সাফল্য সব ক্লান্তি দূর করে দেয়।’
বর্তমান ব্যস্ততা
২৪ এপ্রিল গ্রেট ওয়াল সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় ও বাংলাদেশ দাবা
ফেডারেশনের আয়োজনে গ্রেট ওয়াল সিরামিক প্রিমিয়ার ডিভিশন দাবা লিগের খেলা শুরু হয়। তাতে খেলছেন তাহসিন তাজওয়ার জিয়া। এই টুর্নামেন্ট চলবে আগামী ২ মে পর্যন্ত। এরপর ৬ মে তাহসিন উড়াল দেবেন দুবাইয়ের উদ্দেশে। ৬ মে থেকে ৫ জুন থাকবেন দুবাইয়ে। সেখানে খেলবেন এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ও শারজাহ এবং দুবাইতে দুটি গ্র্যান্ড মাস্টার টুর্নামেন্ট। এ তিনটি টুর্নামেন্ট শেষে ৫ জুন দুবাই থেকে উড়াল দেবেন শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে। সেখানে ৫ তারিখেই শুরু হবে ওয়েস্টার্ন এশিয়ান জুনিয়র দাবা। চলবে ১১ জুন পর্যন্ত। সেই টুর্নামেন্ট শেষে বাড়ি ফিরবেন এই তরুণ দাবাড়ু। তাহলে তো দেশের বাইরে কাটাতে হবে ঈদ–এমন প্রশ্নের উত্তরে তাহসিন বলেন, ‘তেমন বেশি সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া খেলার জন্য, দেশের জন্য এ ছাড়টা তো দিতে হবে।’
জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা
তাহসিনের জন্ম ঢাকার মোহাম্মদপুরে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। তবে বাবার সঙ্গে বেশ আনন্দে দাবার বোর্ডে কেটেছে শৈশব। বাবা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নিয়ে যেতেন। দেখতেন বিশ্বের নামিদামি দাবাড়ুদের। তাদের দেখে আর বাবার অনুপ্রেরণা থেকে দাবাকে নিজের ধ্যানজ্ঞান মানিয়ে নেন তাহসিন। বর্তমানে এ-লেভেলে পড়ছেন সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এখান থেকে ও-লেভেল পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাহসিন।
আগামীর স্বপ্ন
আগামীর স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তাহসিন তাজওয়ার জিয়া বলেন, ‘বাবাকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। হতে চাই দেশের সেরা খেলোয়াড়। একটু চুপ থেকে ফের বলেন, ‘কেবল দেশে নয়, দেশের বাইরেও সেরা খেলোয়াড় হতে চাই। মানে দাবায় বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হতে চাই আমি। যদিও এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ। আমি বিশ্বাস করি, এ পর্যন্ত সবাইকে যেমন পাশে পেয়েছি আগামীতেও পাবো! তবে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে পারবো।’
তাহসিনের কথা শেষ হতে মনে হলো, আসলে স্বপ্ন দেখতে বড় করে দেখা উচিত। বাবার পথ ধরে দাবার আকাশ জয় করবেন তাহসিন; এমন স্বপ্ন দেখতে পারি আমরা!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
শ্রম অধিকার ও সুস্থ কর্মপরিবেশ
আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী মেহনতি মানুষদের স্মরণ করিবার দিন। তৎসহিত সকল শ্রমজীবী মানুষের জন্য মর্যাদাকর জীবন নিশ্চিতকরণের সংগ্রামে নূতন শপথ গ্রহণের দিন।
মে দিবস বিশ্বের শ্রমিকদের সংহতি যদ্রূপ বৃদ্ধি করিয়াছে, তদ্রূপ তাহাদিগকে অধিকার সচেতনও করিয়াছে; প্রেরণা জোগাইয়া চলিয়াছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে। মে দিবস বাংলাদেশসহ বিশ্বের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশসমূহের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎসরূপে কাজ করিয়াছে।
তাহারই প্রতিফলনস্বরূপ এই সকল দেশে ছুটিসহকারে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। উন্নত দেশসমূহ এই দিবসে পৃথক ছুটির ব্যবস্থা না করিলেও উহার প্রভাব উপেক্ষা করিতে পারে নাই। তাই ভিন্ন প্রকারে সেই সকল দেশেও দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে আজিকে শ্রমমান লইয়া যে আলোচনা হয়, জাতীয় ন্যূনতম মজুরিসহ শ্রমিকের বহু অধিকার আজিকে যে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বহু দেশে কার্যকর হইয়াছে, উহারও পশ্চাতে রহিয়াছে মে দিবসের চেতনা। তবে ইহা সত্য, বাংলাদেশে ঘটা করিয়া দিবসটি পালিত হইলেও মজুরি ও কর্মপরিবেশ প্রশ্নে খামতি সীমাহীন। প্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে শ্রমিকদের জন্য এক প্রকার আইনি আশ্রয় থাকিলেও বিশাল অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে উহার লেশমাত্র নাই। শেষোক্ত খাতে কোটি কোটি শ্রমিক উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও অন্যান্য অধিকার হইতে বঞ্চিত।
এই বৎসর শ্রমিক দিবস এমন সময়ে উপস্থিত, যখন গণঅভ্যুত্থানের ফসলস্বরূপ দেশে নূতন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াছে। সেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসাবে শ্রম খাতের সংস্কারেও উদ্যোগী। তাহাদের গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে প্রতিবেদনও দাখিল করিয়াছে, যথায় দেশের সাড়ে সাত কোটি শ্রমজীবী মানুষের মৌলিক অধিকার-সংক্রান্ত একগুচ্ছ সুপারিশ রহিয়াছে। প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক, সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়োজিত সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ ন্যূনতম মানদণ্ডরূপে বিবেচিত হইবে– কমিশনের এই সুপারিশ যুগান্তকারী বলিয়া আমরা মনে করি। উপরন্তু কমিশন ইহাও বলিয়াছে, কোনো খাতের মজুরি কাঠামো নির্ধারণে পরিবারে একক উপার্জনকারী হিসাবে বিবেচনায় লইয়া এমন পরিমাণ নির্ধারণ করিতে হইবে, যাহাতে শ্রমিক তাঁহার পরিবারের প্রয়োজন মিটাইতে পারেন।
বিভিন্ন খাতের শ্রমিকের মজুরি তিন বৎসর অন্তর মূল্যায়ন ও পুনর্নির্ধারণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য আপৎকালীন তহবিল, ট্রেড ইউনিয়ন করিবার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস এবং স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা-সংক্রান্ত সুপারিশসমূহও প্রণিধানযোগ্য। একটা সময় ছিল যখন শ্রমিক আন্দোলন বলিতে কারখানা ভাঙচুর ও সম্পদ ধ্বংস বোঝাইত। পরিণামে নিজের রুটি-রুজি লইয়া শ্রমিকদেরই টানাপোড়েনে পড়িতে হইত। ইহার সমাধান দিয়াছিল ট্রেড ইউনিয়ন প্রথা। দুর্ভাগ্যবশত এই দেশে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার বিগত দশকসমূহে ক্রমশ জটিল রূপ ধারণ করে। উহার সহিত সুস্থ ধারার শ্রমিক আন্দোলনও বিরল হইয়া পড়ে।
আমাদের বিশ্বাস, শ্রম সংস্কার কমিশনের ট্রেড ইউনিয়ন-সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ আলোর মুখ দেখিলে শ্রমিক-মালিক উভয়েরই স্বার্থ রক্ষা হইবে। সর্বোপরি দেশের বিকাশমান শিল্প খাত হইবে লাভবান। উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তিরূপে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে উদ্যোক্তার যদ্রূপ অবদান, তদ্রূপ শ্রমিকেরও অবদান ব্যাপক। তাই শ্রমজীবী মানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে আর কোনো অবহেলা নহে। এইবারের মে দিবসে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করিবে– ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। আমরা সমকালের পক্ষ হইতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল শ্রমজীবী মানুষকে মে দিবসের অভিনন্দন জানাই।