পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না
Published: 29th, April 2025 GMT
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—
১.
২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।
৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।
৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।
৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।
৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।
৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।
১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।
১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।
১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।
স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় সরক র ১৯৭১ স ল র জনগণ র ২৪ বছর কর ছ ল র জন য হয় ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘‘বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি তোলা উচিত, চব্বিশ এবং আগের গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, ভোটাধিকার হরণ—এসবের জন্য যদি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। তাহলে একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করতে হবে। একই অপরাধে দুই রকমের বিচার হতে পারে না।’’
শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে ‘স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’ শীর্ষক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন: দুলু
নৌকা ডুবেছে, শাপলা ভাসবে: এনসিপির তুষার
মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘‘যদি আওয়ামী লীগের মতো একই ধরনের অপরাধে জামায়াতের বিচার না হয়, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার।’’
তিনি বলেন, ‘‘আজকে জামায়াত তাদের পোশাক-চেহারা, আচরণ পাল্টে নতুন রূপে হাজির হয়েছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। কিন্তু, মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আক্রমণ করা। এই বহুরূপীদের চেহারা জনগণ চিনে ফেলেছে।’’
বিএনপির এই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপিই একমাত্র শক্তি। অথচ এই শক্তিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনের নামে প্রক্রিয়া চালালেও জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আলাল আরো বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার মনে করেছে, দেশের সব অনাচারের মূলে সংবিধান। কিন্তু সমস্যার মূল সংবিধান নয়—ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ। শেখ হাসিনার ১৬-১৭ বছরের শাসনে এই অন্যায়, নির্যাতন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারই হয়েছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।’’
ঢাকা/রায়হান/রাজীব