অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের অভাব, যথাযথ সেবাপণ্যের স্বল্পতা, পুঁজির দৈন্য, মন্দ ঋণের বোঝা আর পরিচালকদের অপকর্ম নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এমনকি তারল্যস্বল্পতা এবং ক্রমবর্ধমান মন্দ ঋণ বিবেচনায় আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং বা ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস বা ফিচ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সম্ভাবনা নিয়ে বিবিধ আশঙ্কার কথাও তুলে এনেছে। 

 নতুন সরকারের গভর্নরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতকে আরও সংহত করতে অন্যান্য দেশ বা আন্তর্জাতিক ব্যাংকের মতো ‘ভালো ব্যাংক, মন্দ ব্যাংক’ প্রক্রিয়ার আদলে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের অপেক্ষাকৃত সবল করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।

সম্প্রতি ঝুঁকির মুখে থাকা দেশের ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে, এসব চ্যালেঞ্জ ভবিষ্যতের জন্য খাতটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তাই এই ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে সংস্থাটি ১০টি সুপারিশ করে। 

 সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে’ এসব সুপারিশ তুলে ধরা হয়। তাদের পক্ষ থেকে যে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো হলো ব্যাংক খাতের নীতিকাঠামো উন্নত করতে অগ্রাধিকার প্রদান; আমানত সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করা; প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতি; রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পুনর্গঠন; খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি; সমন্বিত দেউলিয়া আইন প্রণয়ন; ব্যাংকিং আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা; জরুরি প্রয়োজনে তারল্য সহায়তা প্রদানের জন্য একটি নীতিকাঠামো তৈরি; ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চাগুলোর অনুশীলন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। 

বিশ্বব্যাংক বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত উচ্চ খেলাপি ঋণের চাপে রয়েছে। এ ছাড়া মূলধনস্বল্পতা, পরিচালন অদক্ষতা, সুশাসনের ঘাটতি, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করা, ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার এবং সুবিধাভোগীদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদানের গড়ে ওঠা ব্যবস্থা বছরের পর বছর ব্যাংক খাতের সক্ষমতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। 

সংস্থাটি আরও বলেছে, রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই খাতের দুর্বলতাগুলো আমলে নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে এ খাতের দুর্বলতাগুলো একে একে প্রকাশ হতে শুরু করেছে। 

সুপারিশসমূহের বেশির ভাগ যেহেতু আমাদের মধ্যেও বহুল আলোচিত, সে ক্ষেত্রে আমাদের উচিত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কিছু ক্ষেত্রে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে অবশ্য রাজনীতিবিদদের বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি এবং উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণেও শক্ত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দক্ষতা এবং উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার ভালো কাজ দিতে পারে। 

আইনি ফাঁকফোকরের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে নানা ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে জোরালো ও শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাতের সংকটের বড় ধরনের অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। এ ধরনের সংকট স্বীকার করে তা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তাতে অর্থনৈতিক মূল্য কিছুটা কম দিতে হয়। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই ব্যাংক খাতনির্ভর। ২০২৪ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতের মোট সম্পদমূল্য ২১ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের মোট সম্পদের ৮৮ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৫০ শতাংশ। 

ব্যাংকিং খাতের মোট সম্পদের মধ্যে ৭০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের, ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের এবং ৪ শতাংশ বিদেশি ব্যাংকগুলোর। 

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এ দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে অদক্ষতা ও কাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্বল সুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কুক্ষিগত করা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ বিতরণের সমস্যায় ভুগছে। আইনি ফাঁকফোকরের মাধ্যমে পারিবারিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে নানা ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। 

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হলেও এক পরিবারের সদস্যদের পর্ষদে থাকার মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করার মাধ্যমে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

দেশের অর্থনীতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের একটি তথ্য উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০২৩ সালে আটটি ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে পারস্পরিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭০ কোটি মার্কিন ডলার। এই তথ্য প্রমাণ করে, কীভাবে ব্যাংকগুলো ‘পারস্পরিক পিঠ চুলকানি’ সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটিয়েছে। 

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টিও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আলাদা কার্যক্রমের বিষয়টি গুরুত্ব হারিয়েছিল। আমরা দেখেছি, ২০১৭ সালে একটি
গোষ্ঠী এককভাবে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল। এমনকি অস্ত্রের মুখে ব্যাংকের শীর্ষ পদে পরিবর্তন আনা হয়। 

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হলেও এক পরিবারের সদস্যদের পর্ষদে থাকার মেয়াদ ১২ বছরে উন্নীত করার মাধ্যমে এ খাতে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর দুর্বল সুশাসনের বিষয়টি দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এক সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় তা বিশাল আর্থিক ক্ষতি ও আর্থিক খাতের অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যেমন ব্যাহত করে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও দুর্বল করে দেয়। এর ফলে বছরে গড়ে জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ ক্ষতি হয়। 

বিশ্বব্যাংক বলছে, বিশ্বজুড়ে ব্যাংকিং সংকটের সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশও ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতার জন্য অর্থনৈতিক নানা সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। 

১৯৭০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৫১টি ব্যাংকিং ব্যবস্থার পদ্ধতিগত সংকট বিশ্লেষণের তথ্য তুলে ধরে সংস্থাটি বলছে, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যেমন ব্যাহত করে, তেমনি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও দুর্বল করে দেয়। 

এর ফলে বছরে গড়ে জিডিপির প্রায় ৭ শতাংশ ক্ষতি হয়। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে ১০টি সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। 

সুপারিশসমূহের বেশির ভাগ যেহেতু আমাদের মধ্যেও বহুল আলোচিত, সে ক্ষেত্রে আমাদের উচিত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কিছু ক্ষেত্রে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে অবশ্য রাজনীতিবিদদের বিষয়টির গভীরতা উপলব্ধি এবং উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণেও শক্ত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দক্ষতা এবং উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহার ভালো কাজ দিতে পারে। 


মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক র পর চ ব যবহ র গ রহণ ও র ব ষয়ট আম দ র দ র বল ধরন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সৌদি আরবের কাছে ৩৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিল যুক্তরাষ্ট্র

সৌদি আরবের কাছে ৩৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের আগে শুক্রবার এ অনুমোদন দেওয়া হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি তারা কংগ্রেসকে জানিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে থাকবে মধ্যপাল্লার ১ হাজার ‘এআইএম–১২০’ ক্ষেপণাস্ত্র। আকাশে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার জন্য কোনো আকাশযান থেকে (এয়ার টু এয়ার) এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া যায়।

আগামী ১৩ থেকে ১৬ মে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে সম্প্রতি প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে ইতালির রাজধানী রোমে সংক্ষিপ্ত সফর করেছিলেন তিনি। এটিই ছিল দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম বিদেশ সফর।

তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্যচুক্তি করার কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন ট্রাম্প। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে মস্কো ও কিয়েভের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে রিয়াদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ