বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। এ জন্য তিনি চীনের সহযোগিতা চেয়েছেন। চীনের সহায়তায় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াকরণের প্রযুক্তি সহায়তাও চেয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। চীনের পক্ষ থেকেও এসব বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে।

ঢাকা সফররত চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাওয়ের সঙ্গে আজ শনিবার ঢাকার একটি হোটেলে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব সহযোগিতা চেয়েছেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা জোরদার করতে বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে চীনা ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার ও  গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াকরণে দেশটির প্রযুক্তি সহায়তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আজ রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।

চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীর একটি দল নিয়ে আজ ৩১ মে তিন দিনের সফরে দুপুরে ঢাকায় পৌঁছান। তাঁর সঙ্গে ২৫০ জন চীনা বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ী প্রতিনিধি রয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন দলটির আগামীকাল রোববার একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

আজ অনুষ্ঠিত বৈঠকে চীনা প্রতিনিধিদলে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনসহ দেশটির বিনিয়োগবিষয়ক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টার পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যসচিব, শিল্পসচিব, কৃষিসচিব, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান প্রমুখ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য প্রসারে যৌথ কার্য দল (জেডব্লিউজি) গঠন ও ই-কমার্স বিষয়ে সহযোগিতা–সংক্রান্ত দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ও চীনের পক্ষে সে দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও স্বাক্ষর করেন।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে সার, বীজ বপন, কীটনাশক ছিটানো ও ফসল নিরীক্ষণে বিপ্লব আনা সম্ভব। চীনের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি বাংলাদেশের কৃষি খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমা থাকলেও আধুনিক ফিশিং জাহাজ ও প্রযুক্তির অভাব রয়েছে। ফলে এ খাতের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। চীনের সহায়তায় গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ বাড়লে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

বাংলাদেশে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে শ্রমিক পাওয়া যায় এবং এখানকার শ্রমিকেরা দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়ায় দ্রুত ও ভালো কাজ করতে পারেন—এ কথা উল্লেখ করে বাণিজ্য উপদেষ্টা চামড়াজাতশিল্প, হালকা প্রকৌশল, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও ওষুধশিল্পে চীনের বিনিয়োগের প্রত্যাশা করেন।

চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও বাংলাদেশের সঙ্গে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘চীন কৃষি ও ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। বিশেষ করে স্মার্ট কৃষি ও ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে আমরা সহযোগিতা করতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, চীন বাংলাদেশের মৎস্য খাত ও সমুদ্রসীমার সম্পদ আহরণে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ন র ব ণ জ যমন ত র ন ব ণ জ য উপদ ষ ট সহয গ ত

এছাড়াও পড়ুন:

বাজেট কীভাবে তৈরি হয়, বাজেটে আপনি কী দেখবেন

বাজেট হচ্ছে মূলত ব্যয় ব্যবস্থাপনা। যে অর্থ আছে তা কীভাবে ব্যয় করলে উন্নতি হবে, সে পরিকল্পনার নামই আসলে বাজেট। বাজেট একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। এর লক্ষ্য পুরো রাষ্ট্রের কল্যাণ ও উন্নয়ন। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হয়, উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাটসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি করতে হয়। আছে নাগরিকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয়। অর্থাৎ সরকারের ব্যয়ের খাত অনেক।

সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে সরকার কোথায় কত ব্যয় করবে, সে পরিকল্পনার নামই বাজেট।

একজন মানুষকেও কিন্তু আয় ও ব্যয়ের হিসাব করতে হয়। তাঁর পরিবারের সবার জন্য পরিকল্পনা করতে হয়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, যাতায়াত, চিকিৎসার জন্য অর্থ আয় ও ব্যয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। এখানেও বাজেটের উদ্দেশ্য একই—ব্যক্তির নিজের ও পরিবারের কল্যাণ বা উন্নতি।

আরও পড়ুনতাজউদ্দীন থেকে সালেহউদ্দিন: ৫৪টি বাজেট কে, কখন, কীভাবে দিলেন১ ঘণ্টা আগেতাহলে জাতীয় বাজেট আর ব্যক্তি বাজেট কি একই

আসলে এক নয়। একটা কথা আমরা সবাই বলি। আর সেটি হলো আয় বুঝে ব্যয় করো। পার্থক্যটা আসলে এখানেই। আয় বুঝে ব্যয় করার ব্যাপারটা ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য খুবই দরকারি। ব্যক্তি আগে আয় কত হবে সেই হিসাব করেন, তারপর কোথায় কোথায় ব্যয় করতে হবে সেগুলো নির্ধারণ করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র করে ঠিক উল্টোটা। রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে। এরপর ঠিক করে, কোথা থেকে অর্থ আসবে। অর্থাৎ সরকার আয় করে খরচ বুঝে আর ব্যক্তি ব্যয় করেন আয় বুঝে। আরেকটি বড় পার্থক্য তো আছেই। জাতীয় বাজেট হচ্ছে দেশের সব মানুষের উন্নতির জন্য আর ব্যক্তি ভাবেন নিজের বা পরিবারের উন্নতির কথা।

সুতরাং মোটাদাগে ব্যক্তির বাজেটের সঙ্গে সরকারের বাজেটের পার্থক্য হলো চারটি।

ক. ব্যক্তি আয় বুঝে ব্যয় করেন। অন্যদিকে সরকার আয় করে খরচ বুঝে।

খ. ব্যক্তির বাজেট দৈনিক, মাসিক বা বার্ষিক হতে পারে। কিন্তু সরকারের বাজেট সব সময় এক অর্থবছরের জন্য করা হয়।

গ. কোনো ব্যক্তির আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করার দরকার হলে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, এনজিও কিংবা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। অথচ সরকার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হবে দেখলে দেশের ভেতরে কোনো ব্যাংক থেকে, যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক কিংবা অন্য কোনো দেশ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করতে পারে।

ঘ. ব্যক্তি খুব বেশি ঋণ করলে তা যদি শোধ করার ক্ষমতা না থাকে তাহলে আদালত তাঁকে দেউলিয়া ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু সরকার কখনো দেউলিয়া হয় না।

আসলে রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে, দেশের নাগরিকদের জন্য কর্মসংস্থান বা আয়ের ব্যবস্থা করা। এ উদ্দেশ্যেই বাজেট তৈরি করে একটি সরকার। সেটি চাকরি হতে পারে, ব্যবসা হতে পারে, কৃষিকাজও হতে পারে। এখান থেকেই একজন ব্যক্তি আয়ের পথগুলো খুঁজে নেন। আর সে অনুযায়ী ব্যয়ের পরিকল্পনা করেন।

আরও পড়ুনঅর্থনীতির গতি মন্থর, বিনিয়োগ ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ৪ ঘণ্টা আগেরাষ্ট্র কোথা থেকে আয় করে

রাষ্ট্রের আয়ের কতকগুলো উৎস আছে। মূলত রাষ্ট্র নাগরিকদের কাছ থেকে নানাভাবে কর আদায় করে। এগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর ও করবহির্ভূত আয়। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে আছে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর কর (করপোরেট কর), দান কর, উত্তরাধিকার কর, যানবাহন কর, মাদক শুল্ক, ভূমি রাজস্ব ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কর হচ্ছে আমদানি কর, আবগারি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক শুল্ক—এ রকম নানা ধরনের কর।

কর ছাড়া আরও আয় আছে। যেমন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ, সুদ, সাধারণ প্রশাসন থেকে আয়; ডাক, তার ও টেলিফোন থেকে আয়; পরিবহন আয়, জরিমানা ও দণ্ড থেকে আয়; ভাড়া, ইজারা, টোল ও লেভি থেকে আয় ইত্যাদি।

এর মানে একটি দেশের ক্ষেত্রে বাজেট হচ্ছে সেই দেশের জনসাধারণের দেওয়া নানা রকম ট্যাক্স বা কর হিসেবে বা পাওয়া যাবে ও করের বাইরে থেকে যা পাওয়া যাবে, এসব মিলিয়ে একটা সম্ভাব্য আয়ের পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন ও চলতি (রাজস্ব) খাতে ওই আয় খরচ করার একটি বার্ষিক হিসাব।

আরও পড়ুনঅর্থমন্ত্রীর নতুন রেকর্ড ও বাজেট বক্তৃতার গালগল্প০৭ জুন ২০২১রাষ্ট্রের আয়-ব্যয় কি সমান হয়

এই রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে, তারপর আয়ের উৎসগুলো খোঁজা শুরু করে। তাহলে কি আয় ও ব্যয় সমান হতে হবে? সমান হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। আয় ও ব্যয় সমান কি না, সে প্রশ্নেও রাষ্ট্রের বাজেট দুই রকমের হয়। যেমন সুষম বাজেট ও অসম বাজেট।

সরকারের মোট আয় ও মোট ব্যয় সমান হলে সেটি সুষম বাজেট। অর্থাৎ সরকারের মোট ব্যয় পরিকল্পনার সমানই হচ্ছে সম্ভাব্য আয়। আর অসম বাজেট হচ্ছে যেখানে আয় আর ব্যয় সমান হয় না। অসম বাজেট আবার দুই রকমের হতে পারে। যেমন উদ্বৃত্ত বাজেট ও ঘাটতি বাজেট। ব্যয়ের তুলনায় আয় বেশি হলে সেটি উদ্বৃত্ত বাজেট। ঘাটতি বাজেট হচ্ছে ঠিক উল্টোটা। এখানে ব্যয় বেশি, আয় কম।

ব্যয় বেশি হলে রাষ্ট্র কী করে পরিস্থিতি সামাল দেয়? আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হলে দেশ-বিদেশ থেকে রাষ্ট্র অর্থ ধার করতে পারে। রাষ্ট্রকেও সেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। পরিশোধ না করতে পারলে রাষ্ট্র যে দেউলিয়া হয় না, তা নয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। তবে রাষ্ট্রের সুবিধা হচ্ছে নেওয়া ঋণ বা ধার বছরের পর বছর টেনে নিয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র এ সুযোগ নিজেই তৈরি করে নেয়। এর ফলে দায় ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এর উদাহরণ তো এ সময়ের বাংলাদেশই। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাতই হচ্ছে সুদ পরিশোধ।

সরকার কোথায় অর্থ ব্যয় করে

সরকারের ব্যয় দুই রকম। একটি অনুন্নয়ন বা রাজস্ব ব্যয়। এটি হচ্ছে সরকার পরিচালনার খরচ। এই অনুন্নয়ন ব্যয় মোটাদাগে তিনটি—দেশরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসন চালানোর খরচ। বাংলাদেশ একটি কল্যাণরাষ্ট্র নয়। তারপরও বাজেটে একটি মানবিক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা থাকে। এ জন্য নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়। আবার কৃষি ও জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি দেয়। এরও ব্যয় আছে।

দেশ পরিচালনায় যত ধরনের ব্যয় আছে, তা পূরণ করে আয়ের বাকি অর্থ দিয়ে সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা অর্থই উন্নয়ন বাজেট। এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। রাস্তা নির্মাণ, সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ উন্নয়ন, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি; স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল তৈরিসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করে সরকার। মূলত রাজস্ব উদ্বৃত্ত ও দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে নেওয়া ঋণ নিয়ে উন্নয়ন বাজেট করা হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নামে একটি প্রকল্প খাত রয়েছে। এ খাতেই সাধারণত উন্নয়ন বাজেটের খরচ দেখানো হয়।

আরও পড়ুনফাঁস, করের কড়াকড়ি ও অর্থমন্ত্রীদের গল্প০৬ জুন ২০২২বাজেট-ঘাটতি কীভাবে পূরণ হয়

বাংলাদেশ সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। সুতরাং প্রথম দিন থেকেই বাংলাদেশ ঘাটতি বাজেট করে আসছে। দুটি উৎস থেকে অর্থ ধার করে সরকার এই বাজেট-ঘাটতি পূরণ করে। বৈদেশিক উৎস ও অভ্যন্তরীণ উৎস। বৈদেশিক উৎস মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। বৈদেশিক উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারলে তা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদহার কম এবং পরিশোধে অনেক সময় পাওয়া যায়। যদিও এ জন্য নানা ধরনের শর্ত পূরণ করতে হয়। যেমন এখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির মধ্যে আছে। এ জন্য অনেক শর্তও পূরণ করতে হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকার দুইভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন ব্যাংকিং-ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত-ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত-ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। তবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার দুটি বিপদ আছে। ব্যাংকিং-ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ থাকবে কম। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংকবহির্ভূত-ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এতে সুদ পরিশোধে সরকারকে বেশি পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়। এতে পরের অর্থবছরের বাজেট বেড়ে যায়।

আবার ব্যক্তি যা পারেন না, সরকার কিন্তু তা করতে পারে। সরকার টাকা ছাপিয়ে বাজেট-ঘাটতি পূরণ করতে পারে। তবে এই পথে বাজেট-ঘাটতি পূরণ করার বিপদও আছে। এতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। এখন যে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দিয়েছে।

কোন বাজেট ভালো

সাধারণত উন্নত দেশগুলো সুষম বাজেট করে থাকে। তবে প্রতিবছরই সুষম বাজেট করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। উন্নত বা ধনী দেশগুলো বাণিজ্য চক্র মেনে সুষম বাজেট করে। অর্থাৎ অর্থনীতির ওঠানামার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হয়। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে সুষম বাজেট, খারাপ হলে ঘাটতি বাজেট। অনেক উন্নত দেশই আইন করে সুষম বাজেট তৈরি করে।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অব্যাহতভাবে সুষম বাজেট তৈরি করা ভালো কিছু নয়; বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বাজেট কেমন হবে তা ঠিক করা উচিত। সাধারণত অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে সুষম বাজেট করা হয়, খারাপ হলে অর্থনীতিকে উদ্দীপনা দিতে তৈরি হয় ঘাটতি বাজেট। একটা সময় ছিল যখন ঘাটতি বাজেটকে ক্ষতিকর ও সরকারের দুর্বলতাও ভাবা হতো। পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে; বরং অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো। এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে। তাতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়। সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতিকে মেনে নেওয়া হয়।

সাধারণ মানুষ বাজেটের কী কী দেখবেন

বাজেট তো দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু অনেকেই বাজেট নিয়ে আগ্রহ দেখান না। অথচ সাধারণ মানুষেরও বাজেটের দিকে মনোযোগ বাড়ানো উচিত। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেটের কোন কোন দিকে নজর রাখবেন তাঁরা।

ক. মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য
বাজেটে পণ্যের ওপর শুল্ক বা কর বাড়লে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। সুতরাং দাম বাড়বে, এমন কোনো কর বা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার সাধারণ নাগরিকদের।

খ. করনীতি ও করের বোঝা
বাজেটে নতুন কর আরোপ বা বিদ্যমান করের হার পরিবর্তন সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে বেতনভোগী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিরাই হচ্ছেন কর আদায়ের সহজ লক্ষ্যবস্তু। নতুন বাজেটে কাদের লক্ষ্য করে কর বা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, সেটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এদিকেও নজর থাকবে।

গ. কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব
এই সময়ের বড় সমস্যা হচ্ছে বিনিয়োগ মন্দায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কম সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য নতুন কোনো উদ্যোগ আছে কি না, সেটা দেখা গুরুত্বপূর্ণ।

ঘ. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ
সরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতে কখনোই পর্যাপ্ত বাজেট রাখা হয় না। নতুন বাজেটে এ দুই খাতে বাজেট বাড়ল না কমল, সেটাও জানা দরকার। কেননা এই খাতে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলে সেবা উন্নত হবে, যা থেকে প্রত্যক্ষভাবে নাগরিকেরা উপকৃত হবেন।

ঙ. করমুক্ত আয়ের সীমা
টানা তিন বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ দেখছেন দেশের সাধারণ মানুষ। ফলে বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলে কিছুটা স্বস্তি পাবে দেশের মানুষ। এতে ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে।

চ. উন্নয়ন প্রকল্প ও অবকাঠামো
নিজ এলাকায় রাস্তা, সেতু, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ ইত্যাদি অবকাঠামো খাতে নতুন কোনো প্রকল্প বা বরাদ্দ আছে কি না, সে বিষয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে।

ছ. ঋণ ও বাজেট–ঘাটতি
সরকার কি বাজেট–ঘাটতি পূরণের জন্য বেশি ঋণ নিচ্ছে—এ তথ্য জানা দরকার। ঋণ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি নেওয়া হচ্ছে, নাকি বৈদেশিক ঋণ বেশি নিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে সুদ পরিশোধের চাপ কতটা বাড়বে। এই চাপ অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

জ. স্বচ্ছতা
বাজেটের ব্যয় ও আয়ের হিসাব স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা হলে নাগরিকেরা বুঝতে পারেন তাঁদের করের টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে। এতে সরকারের জবাবদিহিও নিশ্চিত হয়। সুতরাং বাজেট কতটা স্বচ্ছ, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ