শন টেইটকে পাওয়া গেল একা। প্রথমে মনে হচ্ছিল কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। ভুল ভাঙল উল্টো দিকের দেয়ালে ঝোলানো টেলিভিশনটা দেখে। ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টের হাইলাইটস দেখাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের রিসেপশনের সোফায় বসা টেইট সেটারই মনোযোগী দর্শক।

সৌজন্য বিনিময় শেষে পুরোনো ধাঁচের ভবনের অ্যান্টিক সব আসবাব পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। করিডর ধরে একটু এগোতেই বাঁ দিকে সুখী এক পরিবারের ওপর চোখ পড়ল। পরিবারের কর্তার কোলে ছোট্ট শিশু, তাকে আদর করে কিছু একটা বলছেন বাবা। পাশে বসা মা–বাবা ছেলের আহ্লাদ দেখে হাসছেন। কর্তা-বাবাটির নাম-পরিচয় জেনে রাখুন। নাজমুল হোসেন, তিনি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক।

খাবারের অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন আরেক পরিচিত মুখ। পেসার হাসান মাহমুদ, তিনিও সস্ত্রীক। রাতের খাবার শেষে রেস্তোরাঁর সামনেই দুই পরিবার মিলে কিছুক্ষণ খোশগল্প হলো।

নাজমুল এক ফাঁকে জানালেন, আগস্টেই দুই বছরে পা দিতে যাওয়া তাঁর পুত্রসন্তান মাঠে এসে বাবার খেলা গলেই প্রথম দেখেছে। গলে গড়া বাবার কীর্তিটা এখনই তার বোঝার কথা নয়। কিন্তু বড় হয়ে তো জানবে, ‘তুমিও ছিলে সেখানে…।’

গল ডাচ ফোর্টের পুরোনো ধাঁচের সব স্থাপনার মাঝের সরু রাস্তাগুলো পর্যটকদের ভীষণ টানে। প্যাডলার্স ইন এখানে থাকা অনেক ভিনটেজ রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যেই একটি। খাবারে ভিন্নতা থাকায় পর্যটকদের কাছে এখানকার মেনুটা সম্ভবত একটু বেশিই আকর্ষণীয়, নানা রকম অ্যান্টিক আসবাব আর জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো বলে হয়তো পরিবেশটাও তেমন।

পেস বোলিং কোচ শন টেইটসহ বাংলাদেশ দলের দুই ক্রিকেটারকে সপরিবার সেখানে পেয়ে যাওয়াও হতে পারে সে কারণে। আগে-পরে দলের অন্যরাও এসে থাকবেন। আসলে কাল রাতটাই যে ছিল বিশেষ কিছু করে কাটানোর। সেটা দলীয়ভাবে যদি না–ও হয়, অন্তত ‘সেলফ ট্রিট’ দেওয়া তো যেতেই পারে।

গলে বাংলাদেশ এবারের আগে দুটি টেস্ট খেলেছে, যার প্রথমটিতেই লেখা হয়েছিল ইতিহাস। ড্র হয়েছিল এক যুগ (২০১৩ সালের মার্চ) আগের সেই টেস্টও। প্রথম ইনিংসে করা ৬৩৮ রান এখনো টেস্টের এক ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। প্রথম ইনিংসে মুশফিকুর রহিমের ২০০ রান ছিল বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।

এরপর ২০১৭ সালে আরেকটি টেস্ট খেলে ২৫৯ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। মুশফিকের ব্যাট থেকে সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসেও আসে ৮৫ রান। আর এবার করেছেন আরেকটি ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখানো সেঞ্চুরি (১৬৩)।

সঙ্গে দুই ইনিংসেই অধিনায়ক নাজমুলের তিন অঙ্কে যাওয়া, প্রথম ইনিংসে লিটন দাসের ৯০ আর উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত কয়েকটি ক্যাচ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অফ স্পিনার নাঈম হাসানের ৫ উইকেট এবারের গল টেস্টকেও কম ঐশ্বর্যশালী করেনি।

সবচেয়ে বড় কথা শ্রীলঙ্কার মাটিতে এসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আরেকটি টেস্ট ড্র করেছে বাংলাদেশ এবং সেটা পুরো ম্যাচে দাপট ধরে রেখে। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ২৫ জুন শুরু দ্বিতীয় টেস্টটাতে যদিও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিতে পারেন শ্রীলঙ্কার পেসাররা, তবু টেস্ট শুরুর আগপর্যন্ত অন্তত বাংলাদেশকে সমতায় রাখছে গলের সাফল্য।

গলে ড্র করাটা ‘সাফল্য’ কি না, তা নিয়ে অবশ্য দুই রকম আলোচনাই আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে নাজমুল-মুশফিক আরেকটু দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করে শ্রীলঙ্কাকে কেন আরও আগে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেস্টটা জেতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করল না, সেটা নিয়ে বিতর্ক।

বাংলাদেশের ক্রিকেটামোদীরাও এ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ বলছেন, আরও দ্রুত রান তুলে আরও আগে ইনিংস ঘোষণা করা উচিত ছিল বাংলাদেশের। তাতে জয়ের সম্ভাবনা থাকত। কেউ বলছেন, নাজমুল ঠিকই করেছেন। আগে তো নিজেদের নিরাপদ জায়গায় নিতে হবে! তারপর টেস্ট জিতলে ভালো, ড্র করলেও খারাপ নয়। অন্তত হারবে তো না বাংলাদেশ।

ম্যাচ শেষে কাল অধিনায়ক নাজমুলও এই যুক্তিই দিয়েছেন, যেটাকে অযৌক্তিক বলার উপায় নেই। এটা ঠিক যে গল টেস্ট জিতলে এই সফরে বাংলাদেশ দলের চেহারাটাই বদলে যেত। টেস্টের নতুন চক্রের শুরুতে পাওয়া জয় বাংলাদেশকে অনেকটা এগিয়েও দিত। কিন্তু সেই ‘অতি লোভে’ পড়ে যদি ম্যাচ হেরে গিয়ে বাংলাদেশ দল ‘তাতি নষ্ট’ করে ফেলত, সেটাও কি মানতে পারতেন কেউ?

তার চেয়ে এই ভালো, বাংলাদেশ জেতেওনি, হারেওনি। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার সমকক্ষ থেকে টেস্টটা শেষ করেছে। আর স্কোরকার্ডের ফলাফলে ‘ড্র’ লেখা থাকলেও শ্রীলঙ্কা নিশ্চিতভাবেই এই ড্রকে একটা পরাজয় হিসেবেই নেবে।

এই টেস্টে হওয়া চার সেঞ্চুরির তিনটিই বাংলাদেশের, আছে লিটনের ৯০ রানের ইতিবাচক ইনিংস, টেস্টের একমাত্র ৫ উইকেটটিও শ্রীলঙ্কার কোনো বোলারের নয়; বাংলাদেশের নাঈম হাসানের।

টেস্ট শেষে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির অংশটুকু বাদ দিলে গলে বাংলাদেশেরই আধিপত্য ছিল। হ্যাঁ, বাংলাদেশ বলতে পারবে না যে ‘টেস্টটা আমরা জিতেছি’, কিন্তু ড্র টেস্টেও শ্রীলঙ্কানদের মনে তো জিততে না পারার হতাশা ছড়ানো গেছে, ঘরের মাঠে যে হতাশা কিছুটা হারের গ্লানির অনুভূতিও দিতে পারে তাদের।

গল টেস্ট বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় যে ইতিবাচক প্রভাবটা ফেলেছে, সেটা অবশ্য মাঠের বাইরে। খেয়াল করে কী দেখেছেন, গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট বলতে মাঠের খেলাটাকেই বেশি বুঝেছে?

তর্ক-বিতর্ক, মত-দ্বিমত, প্রশংসা-সমালোচনা সব মাঠের খেলা, অর্থাৎ এই টেস্ট নিয়ে। এমনকি টেস্ট না জেতায় নাজমুলের আরও আগে ইনিংস ঘোষণা না করা নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা, সেখানেও বিতর্কটা পুরোপুরি ক্রিকেটীয়।

নইলে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা মানেই তো কে কী বললেন আর কে কী করলেন জাতীয় বিষয়। ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, রাজনীতি, কাদা–ছোড়াছুড়ি—এসব কলুষিত সব এজেন্ডাই যেন ‘অক্সিজেন’ হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট–সংক্রান্ত আলোচনার।

ভারত মহাসাগরের পাড়ে এসে পাওয়া দাপুটে ড্র তার বদলে দিচ্ছে সত্যিকারের সতেজ ‘অক্সিজেন’। বাংলাদেশের ইনিংস ঘোষণার সময়টা ঠিক ছিল না বেঠিক হয়েছে, কারও প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণে না গিয়ে সে বিতর্ক চলতেই পারে। তাতে অন্তত ক্রিকেটটাকে একটা খেলা মনে হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম ইন গল ট স ট ল দ শ দল ব তর ক পর ব র

এছাড়াও পড়ুন:

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে নতুন নির্দেশনা

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষায় ভ্রমণকালে পর্যটকদের আবশ্যক পালনীয় নির্দেশনা দিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন।

শনিবার (২১ জুন) সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেজে ১৩টি করণীয় ও বর্জনীয় নির্দেশনা সংবলিত একটি ফটোকার্ড পোস্ট করা হয়।

পর্যটকদের বর্জনীয় নির্দেশনাগুলো হলো- উচ্চ শব্দে গান-বাজনা করা/শোনা যাবে না, হাওরের পানিতে অজৈব বা প্লাস্টিক জাতীয় পণ্য/বর্জ্য ফেলা যাবে না, মাছ ধরা, শিকার বা পাখির ডিম সংগ্রহ করা যাবে না, পাখিদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে কোনো ধরণের বিঘ্ন ঘটানো যাবে না, ডিটারজেন্ট/শ্যাম্পু বা রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না, গাছ কাটা/ডাল ভাঙা বা বনজ সম্পদ সংগ্রহ করা যাবে না, কোর জোন বা সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করা যাবে না, মনুষ্য সৃষ্ট জৈব বর্জ্য হাওরে ফেলা যাবে না।

আরো পড়ুন:

প্রকৃতির আলোয় সিলেটের ‘বনলতা’ 

ঈদের তৃতীয় দিন কুয়াকাটা পর্যটকে মুখর

পর্যটকদের আবশ্যক পালনীয় নির্দেশনাগুলো হলো- জেলা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত নৌপথ ব্যবহার করতে হবে, লাইফ জ্যাকেট পরিধান করতে হবে, প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার হতে বিরত থাকতে হবে, দূর থেকে পাখি ও প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে হবে—ফ্ল্যাশ ছাড়া ছবি তুলতে হবে, স্থানীয় গাইড ও পরিষেবা গ্রহণ এবং ক্যাম্প ফায়ার বা আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, ‘‘পর্যটকদের বর্জনীয় ও আবশ্যক পালনীয় নির্দেশনাগুলো লিফলেট আকারে প্রতিটি নৌকায় সাঁটানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নিজ নিজ উপজেলার পর্যটন স্পটগুলোতে নির্দেশনাগুলো সাইনবোর্ড আকারে টানানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’’

ঢাকা/মনোয়ার/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সীতাকুণ্ডের ঝরনায় দুর্ঘটনা এড়াতে নানা উদ্যোগ
  • টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের মানতে হবে ১২ নির্দেশনা
  • টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে নতুন নির্দেশনা