গল টেস্টে ক্রিকেট যেভাবে বাংলাদেশের ‘খেলা’ হয়ে উঠল
Published: 22nd, June 2025 GMT
শন টেইটকে পাওয়া গেল একা। প্রথমে মনে হচ্ছিল কারও জন্য অপেক্ষা করছেন। ভুল ভাঙল উল্টো দিকের দেয়ালে ঝোলানো টেলিভিশনটা দেখে। ভারত-ইংল্যান্ড টেস্টের হাইলাইটস দেখাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের রিসেপশনের সোফায় বসা টেইট সেটারই মনোযোগী দর্শক।
সৌজন্য বিনিময় শেষে পুরোনো ধাঁচের ভবনের অ্যান্টিক সব আসবাব পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। করিডর ধরে একটু এগোতেই বাঁ দিকে সুখী এক পরিবারের ওপর চোখ পড়ল। পরিবারের কর্তার কোলে ছোট্ট শিশু, তাকে আদর করে কিছু একটা বলছেন বাবা। পাশে বসা মা–বাবা ছেলের আহ্লাদ দেখে হাসছেন। কর্তা-বাবাটির নাম-পরিচয় জেনে রাখুন। নাজমুল হোসেন, তিনি বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক।
খাবারের অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন আরেক পরিচিত মুখ। পেসার হাসান মাহমুদ, তিনিও সস্ত্রীক। রাতের খাবার শেষে রেস্তোরাঁর সামনেই দুই পরিবার মিলে কিছুক্ষণ খোশগল্প হলো।
নাজমুল এক ফাঁকে জানালেন, আগস্টেই দুই বছরে পা দিতে যাওয়া তাঁর পুত্রসন্তান মাঠে এসে বাবার খেলা গলেই প্রথম দেখেছে। গলে গড়া বাবার কীর্তিটা এখনই তার বোঝার কথা নয়। কিন্তু বড় হয়ে তো জানবে, ‘তুমিও ছিলে সেখানে…।’
গল ডাচ ফোর্টের পুরোনো ধাঁচের সব স্থাপনার মাঝের সরু রাস্তাগুলো পর্যটকদের ভীষণ টানে। প্যাডলার্স ইন এখানে থাকা অনেক ভিনটেজ রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যেই একটি। খাবারে ভিন্নতা থাকায় পর্যটকদের কাছে এখানকার মেনুটা সম্ভবত একটু বেশিই আকর্ষণীয়, নানা রকম অ্যান্টিক আসবাব আর জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো বলে হয়তো পরিবেশটাও তেমন।
পেস বোলিং কোচ শন টেইটসহ বাংলাদেশ দলের দুই ক্রিকেটারকে সপরিবার সেখানে পেয়ে যাওয়াও হতে পারে সে কারণে। আগে-পরে দলের অন্যরাও এসে থাকবেন। আসলে কাল রাতটাই যে ছিল বিশেষ কিছু করে কাটানোর। সেটা দলীয়ভাবে যদি না–ও হয়, অন্তত ‘সেলফ ট্রিট’ দেওয়া তো যেতেই পারে।
গলে বাংলাদেশ এবারের আগে দুটি টেস্ট খেলেছে, যার প্রথমটিতেই লেখা হয়েছিল ইতিহাস। ড্র হয়েছিল এক যুগ (২০১৩ সালের মার্চ) আগের সেই টেস্টও। প্রথম ইনিংসে করা ৬৩৮ রান এখনো টেস্টের এক ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। প্রথম ইনিংসে মুশফিকুর রহিমের ২০০ রান ছিল বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি।
এরপর ২০১৭ সালে আরেকটি টেস্ট খেলে ২৫৯ রানে হেরে যায় বাংলাদেশ। মুশফিকের ব্যাট থেকে সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসেও আসে ৮৫ রান। আর এবার করেছেন আরেকটি ডাবল সেঞ্চুরির স্বপ্ন দেখানো সেঞ্চুরি (১৬৩)।
সঙ্গে দুই ইনিংসেই অধিনায়ক নাজমুলের তিন অঙ্কে যাওয়া, প্রথম ইনিংসে লিটন দাসের ৯০ আর উইকেটের পেছনে দুর্দান্ত কয়েকটি ক্যাচ এবং দ্বিতীয় ইনিংসে অফ স্পিনার নাঈম হাসানের ৫ উইকেট এবারের গল টেস্টকেও কম ঐশ্বর্যশালী করেনি।
সবচেয়ে বড় কথা শ্রীলঙ্কার মাটিতে এসে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আরেকটি টেস্ট ড্র করেছে বাংলাদেশ এবং সেটা পুরো ম্যাচে দাপট ধরে রেখে। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠে ২৫ জুন শুরু দ্বিতীয় টেস্টটাতে যদিও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের পরীক্ষা নিতে পারেন শ্রীলঙ্কার পেসাররা, তবু টেস্ট শুরুর আগপর্যন্ত অন্তত বাংলাদেশকে সমতায় রাখছে গলের সাফল্য।
গলে ড্র করাটা ‘সাফল্য’ কি না, তা নিয়ে অবশ্য দুই রকম আলোচনাই আছে। দ্বিতীয় ইনিংসে নাজমুল-মুশফিক আরেকটু দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করে শ্রীলঙ্কাকে কেন আরও আগে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে টেস্টটা জেতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করল না, সেটা নিয়ে বিতর্ক।
বাংলাদেশের ক্রিকেটামোদীরাও এ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত। কেউ বলছেন, আরও দ্রুত রান তুলে আরও আগে ইনিংস ঘোষণা করা উচিত ছিল বাংলাদেশের। তাতে জয়ের সম্ভাবনা থাকত। কেউ বলছেন, নাজমুল ঠিকই করেছেন। আগে তো নিজেদের নিরাপদ জায়গায় নিতে হবে! তারপর টেস্ট জিতলে ভালো, ড্র করলেও খারাপ নয়। অন্তত হারবে তো না বাংলাদেশ।
ম্যাচ শেষে কাল অধিনায়ক নাজমুলও এই যুক্তিই দিয়েছেন, যেটাকে অযৌক্তিক বলার উপায় নেই। এটা ঠিক যে গল টেস্ট জিতলে এই সফরে বাংলাদেশ দলের চেহারাটাই বদলে যেত। টেস্টের নতুন চক্রের শুরুতে পাওয়া জয় বাংলাদেশকে অনেকটা এগিয়েও দিত। কিন্তু সেই ‘অতি লোভে’ পড়ে যদি ম্যাচ হেরে গিয়ে বাংলাদেশ দল ‘তাতি নষ্ট’ করে ফেলত, সেটাও কি মানতে পারতেন কেউ?
তার চেয়ে এই ভালো, বাংলাদেশ জেতেওনি, হারেওনি। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার সমকক্ষ থেকে টেস্টটা শেষ করেছে। আর স্কোরকার্ডের ফলাফলে ‘ড্র’ লেখা থাকলেও শ্রীলঙ্কা নিশ্চিতভাবেই এই ড্রকে একটা পরাজয় হিসেবেই নেবে।
এই টেস্টে হওয়া চার সেঞ্চুরির তিনটিই বাংলাদেশের, আছে লিটনের ৯০ রানের ইতিবাচক ইনিংস, টেস্টের একমাত্র ৫ উইকেটটিও শ্রীলঙ্কার কোনো বোলারের নয়; বাংলাদেশের নাঈম হাসানের।
টেস্ট শেষে পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টির অংশটুকু বাদ দিলে গলে বাংলাদেশেরই আধিপত্য ছিল। হ্যাঁ, বাংলাদেশ বলতে পারবে না যে ‘টেস্টটা আমরা জিতেছি’, কিন্তু ড্র টেস্টেও শ্রীলঙ্কানদের মনে তো জিততে না পারার হতাশা ছড়ানো গেছে, ঘরের মাঠে যে হতাশা কিছুটা হারের গ্লানির অনুভূতিও দিতে পারে তাদের।
গল টেস্ট বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় যে ইতিবাচক প্রভাবটা ফেলেছে, সেটা অবশ্য মাঠের বাইরে। খেয়াল করে কী দেখেছেন, গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেট বলতে মাঠের খেলাটাকেই বেশি বুঝেছে?
তর্ক-বিতর্ক, মত-দ্বিমত, প্রশংসা-সমালোচনা সব মাঠের খেলা, অর্থাৎ এই টেস্ট নিয়ে। এমনকি টেস্ট না জেতায় নাজমুলের আরও আগে ইনিংস ঘোষণা না করা নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা, সেখানেও বিতর্কটা পুরোপুরি ক্রিকেটীয়।
নইলে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা মানেই তো কে কী বললেন আর কে কী করলেন জাতীয় বিষয়। ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, রাজনীতি, কাদা–ছোড়াছুড়ি—এসব কলুষিত সব এজেন্ডাই যেন ‘অক্সিজেন’ হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট–সংক্রান্ত আলোচনার।
ভারত মহাসাগরের পাড়ে এসে পাওয়া দাপুটে ড্র তার বদলে দিচ্ছে সত্যিকারের সতেজ ‘অক্সিজেন’। বাংলাদেশের ইনিংস ঘোষণার সময়টা ঠিক ছিল না বেঠিক হয়েছে, কারও প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণে না গিয়ে সে বিতর্ক চলতেই পারে। তাতে অন্তত ক্রিকেটটাকে একটা খেলা মনে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম ইন গল ট স ট ল দ শ দল ব তর ক পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
দুই দিনে যেতে পারেননি কোনো পর্যটক, কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন জাহাজ চলাচল অনিশ্চিত
নভেম্বর থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যটকদের জন্য খুলে দিয়েছে সরকার। সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছিল, কক্সবাজার থেকে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটক যেতে পারবেন। কিন্তু দুই দিনে একজন পর্যটকও যেতে পারেননি। কারণ, পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ। কবে থেকে জাহাজ চলাচল শুরু হবে, তা নিয়েও কেউ নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকেই পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিনে যাতায়াতের কথা। এ জন্য ১ হাজার ৭০০ জন ধারণক্ষমতার দুটি জাহাজ—এমভি কর্ণফুলী ও এমভি বার আউলিয়া চলাচলের অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু গতকাল শনিবার ও আজ রোববার ওই রুটে কোনো জাহাজ চলেনি। আরও চারটি জাহাজ চলাচলের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা শুধু দিনের বেলায় সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করতে পারবেন, রাত যাপন করা যাবে না, তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাতযাপনের সুযোগ থাকবে। বিআইডব্লিউটিএ ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান সেন্ট মার্টিনে যেতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকতে হবে। কিউআর কোডবিহীন টিকিট নকল বলে গণ্য হবে।
সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে রাতের বেলায় সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ পার্টি, কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা বিক্রি, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সৈকতে মোটরসাইকেল বা সি-বাইকসহ মোটরচালিত যান চলাচলও বন্ধ। নিষিদ্ধ পলিথিন বহন এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, পানির বোতল ইত্যাদি) ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
পর্যটক নেই, ফাঁকা ঘাটআজ সকাল সাতটায় নুনিয়াছটা বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কোনো যাত্রী নেই। বাঁকখালী নদীতেও পর্যটকবাহী কোনো জাহাজ দেখা যায়নি। ঘাটে অবস্থান করছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তর ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। জানা যায়, গতকাল সকালে তিনজন পর্যটক টিকিট কেটে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, পরে জাহাজ না থাকায় ফিরে যান।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার মাহবুব পাশা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে তিন মাসের জন্য সেন্ট মার্টিন উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় গত দুই দিনে কোনো পর্যটক যেতে পারেননি। নভেম্বরে দিনে গিয়ে দিনে ফেরার নিয়ম থাকায় সময় ও সুযোগ কম, আবার দীর্ঘ জাহাজযাত্রার কারণে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। তারপরও আমরা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে ঘাটে অবস্থান করছি।’
জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, টানা ৯ মাস বন্ধ থাকার পর ১ নভেম্বর থেকে তিন মাসের জন্য কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে উখিয়ার ইনানী নৌবাহিনীর জেটিঘাট কিংবা টেকনাফের কোনো স্থান থেকে এখনো জাহাজ চলাচলের অনুমতি নেই।
জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মান্নান বলেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সংকট নিরসনের চেষ্টা চলছে।
গত ডিসেম্বরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়ে কক্সবাজারের পথে পর্যটকবাহী একটি জাহাজ