বিশ্ববিধির সশব্দ অপমান সমর্থনযোগ্য নয়
Published: 23rd, June 2025 GMT
ইতিহাসের ধারায় কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো কেবল সংঘাতের দলিল নয়, নৈতিকতার পরাজয়েরও স্মারক হয়ে থাকে। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের অতর্কিত সামরিক আঘাত এমনই এক পর্ব, যেখানে কূটনৈতিক বিধিবিধান, আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যায়নীতির মৌলিক ভিত্তিগুলোকে এক লঙ্ঘনপরায়ণ হাতছানিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।
জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার আগে ইরানের দিক থেকে এমন কোনো সরাসরি সামরিক হুমকি আসেনি, যা এই ধরনের আক্রমণকে আত্মরক্ষামূলক বলে আখ্যায়িত করতে পারে। অতএব, এটি একটি নির্ধারিত ‘আগ্রাসী যুদ্ধ’, যা জাতিসংঘ সনদের নির্যাসকেই অস্বীকার করে।
দ্বিতীয়ত, এই হামলা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের রোম সংবিধি অনুযায়ী ‘আগ্রাসনের অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা যায়। যেখানে বলা আছে, কোনো রাষ্ট্র যদি পূর্বঘোষণাহীনভাবে আরেক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ চালায়, তবে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ইরানের ভূগর্ভস্থ ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—এই তিন স্থানে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকারবিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করে এই অপরাধ সংঘটন করেছে।
এই হামলায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও উপেক্ষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ফর্দোর মতো স্থানে (যা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান) সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এমন হামলায় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাই এমন হামলার ক্ষেত্রে সেই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য ছিল। অথচ তা ট্রাম্প উপেক্ষা করেছেন।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। এই চুক্তির অধীনে ইরান পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকারী এবং এ–সংক্রান্ত নিরীক্ষার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ)। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা এনপিটির ৪ ও ৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, ওই দুটি অনুচ্ছেদে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কার্যক্রমের নিরাপত্তা ও রক্ষাকবচ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘ সনদের অধ্যায় ৬ অনুযায়ী, কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলো সর্বাগ্রে আলোচনা, মধ্যস্থতা কিংবা বিচারিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধানের পথ অনুসন্ধান করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে বলেছিল, ইরানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা দুই সপ্তাহ সময় নেবে। কিন্তু দুই দিন পেরোতেই আকাশ থেকে বোমাবর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ—এ কেবল কূটনৈতিক অঙ্গীকারের অবমাননাই নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাসভঙ্গের কুৎসিত নজিরও বটে।
এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিনা উসকানিতে ইরানের অভ্যন্তরে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা যে উত্তেজনার বীজ বপন করেছিল, তা ইরানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু সেই উত্তেজনা প্রশমনের বদলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ভূমিকাকে অগ্রসর করে সংঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণায় উঠে আসে, ‘শান্তি না এলে’ যুক্তরাষ্ট্র আরও হামলা চালাবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এই যৌথ অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? কেবল পারমাণবিক কর্মসূচির নিষ্ক্রিয়করণ, নাকি ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সরকার কাঠামো জোর করে পরিবর্তনের এক দুরভিসন্ধিমূলক প্রয়াস? যদি তা-ই হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের চেয়েও অধিকতর ভয়ংকর; একটি সভ্যতার শিকড় উৎপাটনের হুমকি।
তবে মানব ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বোমা দিয়ে আদর্শিক রাজনীতি পরিবর্তন করা যায় না। এই ধরনের আগ্রাসন নতুন সংঘাতের সূচনা করে, পরিসমাপ্তির নয়। ট্রাম্পের এই হামলার পরিণতি হিসেবে ইরানের দিক থেকে আরও কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া ও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, যার প্রভাব হতে পারে বিশ্বব্যাপী। তাই আন্তর্জাতিক সমাজ, বিশেষত আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং জাতিসংঘের নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এখনই কার্যকর হস্তক্ষেপ করা। মনে রাখা দরকার, যুদ্ধের আগুন যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তাতে পুড়ে ছারখার হবে কেবল একটি দেশ নয়, বরং সমগ্র মানবতা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র
এছাড়াও পড়ুন:
‘ইরানে রেজিম চেঞ্জ হলে কে ক্ষমতায় বসবে, তা কেউ বলে দিতে পারে না’
ইরানে রেজিম চেঞ্জ (শাসন ব্যবস্থায় বদল) চাইছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন অনেকে তার সুরে কথা বলছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন তারা। এ অবস্থায় খামেনি তার উত্তরসূরিদের মনোনয়ন দিয়ে রেখেছেন; যাতে তাকে হত্যা করা হলেও নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি না হয়।
ইরানে শাসন পরিবর্তনে নেতানিয়াহুর মতিগতি ধরে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) যাচাইকরণ ও নিরাপত্তা নীতি সমন্বয় দপ্তরের সাবেক প্রধান তারিক রউফ। তিনি নেতানিয়াহুকে ইরানে সরকার পতনের চেষ্টার ব্যাপারে গুরুতর সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
সোমবার (২৩ জুন) আলজাজিরাকে তারিক রউফ বলেছেন, “নেতানিয়াহু অনেক দিন ধরেই ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন দেখতে চাইছেন। তিনি ইরানি নেতৃত্বের ওপর বিশ্বাস করেন না। কিন্তু বর্তমান শাসনব্যবস্থার যদি পতন হয়, তাহলে ফলাফল কী হবে, আমরা কেউই তা জানি না।”
আরো পড়ুন:
যুদ্ধ কখনোই গণতন্ত্র নিয়ে আসে না: ইরানের নোবেলজয়ী নার্গিস
হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হবে অর্থনৈতিক আত্মহত্যা: যুক্তরাষ্ট্র
তিনি আরো বলেন, “আমরা দেখেছি ইরাকে কী ঘটেছিল। আমরা দেখেছি লিবিয়ায় কী ঘটেছিল। তাই বাইরে থেকে কেউই নিশ্চয়তা দিতে পারবে না, একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাত হলে কে ক্ষমতায় আসবে, পরিস্থিতি কেমন হবে, কিংবা সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে কি না।”
ঢাকা/রাসেল