ইতিহাসের ধারায় কিছু মুহূর্ত থাকে, যেগুলো কেবল সংঘাতের দলিল নয়, নৈতিকতার পরাজয়েরও স্মারক হয়ে থাকে। ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের অতর্কিত সামরিক আঘাত এমনই এক পর্ব, যেখানে কূটনৈতিক বিধিবিধান, আন্তর্জাতিক আইন এবং ন্যায়নীতির মৌলিক ভিত্তিগুলোকে এক লঙ্ঘনপরায়ণ হাতছানিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা কিংবা রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার আগে ইরানের দিক থেকে এমন কোনো সরাসরি সামরিক হুমকি আসেনি, যা এই ধরনের আক্রমণকে আত্মরক্ষামূলক বলে আখ্যায়িত করতে পারে। অতএব, এটি একটি নির্ধারিত ‘আগ্রাসী যুদ্ধ’, যা জাতিসংঘ সনদের নির্যাসকেই অস্বীকার করে।

দ্বিতীয়ত, এই হামলা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের রোম সংবিধি অনুযায়ী ‘আগ্রাসনের অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা যায়। যেখানে বলা আছে, কোনো রাষ্ট্র যদি পূর্বঘোষণাহীনভাবে আরেক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ চালায়, তবে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে ইরানের ভূগর্ভস্থ ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান—এই তিন স্থানে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের বাংকারবিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করে এই অপরাধ সংঘটন করেছে।

এই হামলায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও উপেক্ষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ফর্দোর মতো স্থানে (যা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান) সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এমন হামলায় বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাই এমন হামলার ক্ষেত্রে সেই বিষয়টি বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য ছিল। অথচ তা ট্রাম্প উপেক্ষা করেছেন।

ইরান পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) একটি স্বাক্ষরকারী দেশ। এই চুক্তির অধীনে ইরান পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের অধিকারী এবং এ–সংক্রান্ত নিরীক্ষার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ)। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা এনপিটির ৪ ও ৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, ওই দুটি অনুচ্ছেদে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কার্যক্রমের নিরাপত্তা ও রক্ষাকবচ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

জাতিসংঘ সনদের অধ্যায় ৬ অনুযায়ী, কোনো বিরোধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলো সর্বাগ্রে আলোচনা, মধ্যস্থতা কিংবা বিচারিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধানের পথ অনুসন্ধান করবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে বলেছিল, ইরানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তারা দুই সপ্তাহ সময় নেবে। কিন্তু দুই দিন পেরোতেই আকাশ থেকে বোমাবর্ষণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ—এ কেবল কূটনৈতিক অঙ্গীকারের অবমাননাই নয়, বরং একটি রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাসভঙ্গের কুৎসিত নজিরও বটে।

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিনা উসকানিতে ইরানের অভ্যন্তরে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা যে উত্তেজনার বীজ বপন করেছিল, তা ইরানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু সেই উত্তেজনা প্রশমনের বদলে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ভূমিকাকে অগ্রসর করে সংঘাতকে আরও তীব্র করে তোলে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণায় উঠে আসে, ‘শান্তি না এলে’ যুক্তরাষ্ট্র আরও হামলা চালাবে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এই যৌথ অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? কেবল পারমাণবিক কর্মসূচির নিষ্ক্রিয়করণ, নাকি ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা সরকার কাঠামো জোর করে পরিবর্তনের এক দুরভিসন্ধিমূলক প্রয়াস? যদি তা-ই হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের চেয়েও অধিকতর ভয়ংকর; একটি সভ্যতার শিকড় উৎপাটনের হুমকি।

তবে মানব ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বোমা দিয়ে আদর্শিক রাজনীতি পরিবর্তন করা যায় না। এই ধরনের আগ্রাসন নতুন সংঘাতের সূচনা করে, পরিসমাপ্তির নয়। ট্রাম্পের এই হামলার পরিণতি হিসেবে ইরানের দিক থেকে আরও কঠোর সামরিক প্রতিক্রিয়া ও হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, যার প্রভাব হতে পারে বিশ্বব্যাপী। তাই আন্তর্জাতিক সমাজ, বিশেষত আরব রাষ্ট্রসমূহ এবং জাতিসংঘের নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এখনই কার্যকর হস্তক্ষেপ করা। মনে রাখা দরকার, যুদ্ধের আগুন যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে তাতে পুড়ে ছারখার হবে কেবল একটি দেশ নয়, বরং সমগ্র মানবতা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র

এছাড়াও পড়ুন:

গৌরনদীতে বাসচাপায় মোটরসাইকেল চালক নিহত

বরিশালের গৌরনদীতে বাসচাপায় আব্দুল কাদের (৩৬) নামের এক মোটরসাইকেলচালক নিহত হয়েছেন। সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সকালে উপজেলার মাহিলাড়া মোল্লাবাড়ি এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত কাদের জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের ভাজনা এলাকার তাজেল হাওলাদারের ছেলে। গৌরনদী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আমিনুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

আরো পড়ুন:

ধামরাইয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পিকআপ, চালকসহ নিহত ২

মাদারীপুরে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় অটোরিকশার যাত্রী নিহত

তিনি বলেন, ‘‘ঢাকাগামী লাবিবা পরিবহনের একটি বাস মোটরসাইকেলকে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই মোটরসাইকেলচালক মারা যান। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করেছে। একইসঙ্গে দুর্ঘটনাকবলিত বাস ও মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় পরবর্তী আইনি কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।’’

ঢাকা/পলাশ/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ