এনবিআরের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা
Published: 25th, June 2025 GMT
আগামীকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান।
আজ দুপুরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়। এনবিআরের যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ২২ জুন থেকে আবার আন্দোলন শুরু করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। টানা তৃতীয় দিনের মতো আজ বুধবারও এনবিআরসহ সারা দেশে শুল্ক-কর কার্যালয়ের কলমবিরতি কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকার প্রত্যাশা করে, এই আলোচনার (২৬ জুন) মাধ্যমে সব ভুল–বোঝাবুঝির অবসান হয়ে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা সম্ভব হবে। এনবিআরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে যাঁর যাঁর দপ্তরে অবস্থান করে অর্থবছরের শেষ কর্মদিবসগুলোয় রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে মনোনিবেশ করার জন্য অর্থ উপদেষ্টা অনুরোধ করছেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দীর্ঘদিন যাবৎ দেশের সুশীল সমাজ, ব্যবসায়ী সংগঠন, অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন সহযোগীরা রাজস্ব কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়নের কাজ পৃথক্করণের পরামর্শ দিয়ে আসছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে গত বছরের ৯ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার বিষয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। ওই পরামর্শক কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ১৬ জানুয়ারি উপদেষ্টা রাজস্ব আহরণে দুটি কার্যক্রম পৃথক করার বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন প্রদান করে। পরবর্তী সময়ে বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাঁদের নিজ নিজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের তত্ত্বাবধানে অন্য অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ওই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ মে অর্থ উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ১৩ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঘণ্টাব্যাপী সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রাজস্ব সংস্কার কমিটিসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার পর তা বাস্তবায়ন করা হবে। এরপরও আন্দোলন চলমান থাকায় গত ২৫ মে অর্থ উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বলা হয়, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে। এরপর আন্দোলনকারীরা তাঁদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সাগর থেকে মাছ আহরণ বাংলাদেশের কমছে, ভারত-মিয়ানমারে বাড়ছে
বঙ্গোপসাগর থেকে গত তিন বছর বাংলাদেশের মাছ আহরণ ধারাবাহিকভাবে কমছে। ব্যাপকভাবে কমেছে সামুদ্রিক ইলিশ, কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণ। সাগর থেকে মাছ ধরার পরিমাণ কমতে থাকায় সার্বিকভাবে দেশের মাছের জোগানের গতিও কমে গেছে। যদিও ভিন্ন চিত্র প্রতিবেশী দেশগুলোর। বছর বছর সাগর থেকে মাছ ধরা বাড়িয়ে মাছ আহরণে বিশ্বের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে ভারত। এমনকি গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত মিয়ানমারেও প্রতিবছর বাড়ছে সামুদ্রিক মাছ আহরণ।
সাগর থেকে বাংলাদেশের মাছ আহরণ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়কে দায়ী করছেন এ দেশের মৎস্য কর্মকর্তারা। তা ছাড়া অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণেও মাছের মজুত কমে আসছে বলে জানান তাঁরা।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট সামুদ্রিক মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৬ হাজার টন। পরের অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৯ হাজার টনে। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ২৮ হাজার টনে। অর্থাৎ ২০২২–২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে মাছ আহরণ প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। গত জুনে শেষ হওয়া ২০২৪–২৫ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও কমেছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তবে এখনো অনুষ্ঠানিকভাবে গত অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।
সমুদ্র খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কয়েক বছর ধরে সাগরে অতিরিক্ত মাছ আহরণের কারণে মাছের মজুত কমে গেছে। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক শাখার সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ২০ বছর আগেও সাগরে বাণিজ্যিক ট্রলারের সংখ্যা ছিল এক শর কম। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬৫টিতে। তিনি জানান, সাগরের ৪০ মিটারের ভেতরে মাছ না ধরার কথা থাকলেও এসব নৌযান তা মানছে না। আবার ছোট নৌযানের সংখ্যা এখন ২৯ হাজার ছাড়িয়েছে। এসব নৌযানেও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তাদের ব্যবহার করার কথা নয়। পাশাপাশি অবৈধ জালও ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি উপকূলের ৫ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে মাছ ধরা হচ্ছে। এতে ডিম থেকে নতুন পোনা তৈরির সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।
বিশ্বে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে চীন। এ ছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ভারত ৬ষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ভারতের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১–২২ সালে সাগর থেকে দেশটির মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৪১ লাখ ২৭ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৪৪ লাখ ৯৫ হাজার টন মাছ আহরণ করেছে ভারত।
মিয়ানমারের মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২০-২১ সালে সাগর থেকে মাছ আহরণের পরিমাণ ছিল ৩২ লাখ ৯৫ হাজার। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ লাখ ১৪ হাজার টনে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের মধ্যেও দেশটির সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়ছে।
এদিকে বাংলাদেশে সাগরে সবচেয়ে বেশি আহরণ কমছে ইলিশ ও চিংড়ির। মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে সাগর থেকে ইলিশ আহরণ তার আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। আর চিংড়ির আহরণ কমেছে প্রায় ৪৪ শতাংশ। কাঁকড়া আহরণও কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।
সাগর থেকে মাছ আহরণ কমে যাওয়া এবং এ বিষয়ে করণীয় প্রসঙ্গে সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের উপপরিচালক মোহাম্মদ শরিফুল আজম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সাল থেকেই চিংড়ি আহরণ কমে যাওয়ার তথ্য পাচ্ছিলাম। তাই সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালায় চিংড়ি ধরার ট্রলারের লাইসেন্স আর না বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করি। ২০২৮ সাল পর্যন্ত এসব ট্রলাররের লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।’
সাগর থেকে মাছ আহরণ বাড়াতে হলে বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণহীন মৎস্য আহরণকে নজরদারির মধ্যে আনার কথা বলছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জিয়া হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে পাঁচটি ট্রলারে স্যাটেলাইট ট্রেকার বসিয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সব ট্রলার ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনার পরামর্শ তাঁর।
এদিকে মাছ আহরণ কমতে থাকায় সাগরের ওপর নির্ভরশীল জেলেরাও বিপাকে পড়ছেন। ঋণের দাদনের টাকা শোধ করে লাভের অঙ্ক মিলছে না তাঁদের। কক্সবাজারে পাঁচ হাজারের বেশি মাছ ধরার কাঠের নৌযান আছে। এসব নৌকায় এখন মাছ ধরা পড়ছে কম। কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, টানা ছয় থেকে সাত মাস তেমন মাছ ধরা পড়ছে না। কয়েক বছর ধরেই মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। এক সপ্তাহের জন্য সাগরে গেলে দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। কিন্তু মাছ কম পাওয়ায় দাদন পরিশোধ করাই এখন কষ্টকর হয়ে গেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের ব্লু ইকোনমি সেলের পরিচালক মো. সাজদার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সাগরে এখন ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। সাগরের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। তা ছাড়া জেলিফিশের প্রকোপ বেড়েছে। আর অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে মাছের মজুত কমছে। তাই মাছ আহরণ আরও কমিয়ে আনতে হবে।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতির এক সভায় গণমাধ্যমে সঙ্গে কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, ‘ভারতের জেলেরা যাতে বাংলাদেশে এসে মাছ ধরতে না পারেন, সেটা আমাদের বন্ধ করতে হবে।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সারা বিশ্বে সাগর থেকে ৭ কোটি ৯৭ লাখ টন মাছ ধরা হয়। যার মধ্যে অর্ধেক মাছ আহরণ করেছে এশিয়ার দেশগুলো। ওই বছর বিশ্বের মোট সামুদ্রিক মাছের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশই আহরণ করেছিল চীন, যার পরিমাণ ১ কোটি ১৮ লাখ ১৯ হাজার টন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়া ওই বছর আহরণ করেছে ৬৮ লাখ ৪৩ হাজার টন মাছ। আর ভারত আহরণ করেছে ৩৫ লাখ ৯৭ হাজার টন। যেখানে বাংলাদেশের হিস্যা ছিল বৈশ্বিক মাছ আহরণের মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।