আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০–১২৫৮ সাল) ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির এক অসাধারণ যুগ। এর কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগদাদ। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসলামি বিজ্ঞানের প্রসার এবং জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান ও ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখার সমন্বয়ের ফলে সুশৃঙ্খল শিক্ষার চাহিদা বেড়ে যায়।
মুসতানসিরিয়ার আগে বাগদাদে প্রায় ৩০টি মাদ্রাসা ছিল। তার মধ্যে নিজামিয়া মাদ্রাসা (১০৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত) ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। (দাউদ, নাবিলা আবদুল মুনিম, আল-ইদারাতুত তারবাবিয়্যা ফিল মাদারিস ফিল আসরিল আব্বাসি, পৃ.
তবে মুসতানসিরিয়া তার বিশালতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যায়।
রাজনৈতিকভাবেও মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠা ছিল তখনকার খলিফার ক্ষমতা ও প্রভাবকে শক্তিশালী করার এক প্রচেষ্টার অংশ। খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহ জ্ঞানের প্রতি গভীর আগ্রহ পোষণ করতেন এবং প্রতিষ্ঠানটির উদ্বোধন ও তদারকিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। (ইবন আল-জাওযি, শামসুদ্দিন ইউসুফ, মিরআতুজ জামান, ৮/৭২৯, হায়দারাবাদ দখন, ১৯৫১-১৯৫২)।
মুসতানসিরিয়ার আগে বাগদাদে প্রায় ৩০টি মাদ্রাসা ছিল। তবে মুসতানসিরিয়া তার বিশালতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার কারণে পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে যায়।আরও পড়ুননারীদের প্রতিষ্ঠা করা মসজিদ ও মাদ্রাসা০৯ মে ২০২৩স্থাপত্যিক গুরুত্বমাদ্রাসায় ছিল ছাত্রদের জন্য থাকার ব্যবস্থা, একটি গ্রন্থাগার, একটি হাসপাতাল ও একটি মসজিদ। দজলা নদীর পূর্ব তীরে খলিফার প্রাসাদের বিপরীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ১২২৭ থেকে ১২৩২ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এবং ১২৩৪ সালে উদ্বোধন করা হয়। (আল-ফুতি, আবদুর রাজ্জাক বিন আহমদ, আল-হাওয়াদিস আল-জামিয়া ওয়াত তাজারিব আন-নাফিয়া ফিল মিয়াতিস সাবিয়া, পৃ. ৫৮, মাতবাআত আল-আনি, বাগদাদ, ১৯৫৯)
স্থাপত্য–পরিকল্পনায় মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা এক অসাধারণ কীর্তি। এর নকশা কার্যকারিতা ও নান্দনিকতার এক অনন্য সমন্বয় ঘটিয়েছিল। মাদ্রাসাটি ছিল একটি কেন্দ্রীয় উঠানের চারপাশে চারটি ইওয়ান (বড় খিলানযুক্ত হল) দ্বারা গঠিত, যা ইসলামি স্থাপত্যের একটি স্বীকৃত বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি ইওয়ান ছিল চারটি সুন্নি মাজহাবের (হানাফি, শাফেয়ি, মালিকি, হাম্বলি) শিক্ষার জন্য নিবেদিত। (আল-ফুতি, পৃ. ৫৬)
স্থাপত্যের জটিল টাইলকাজ, ক্যালিগ্রাফি আর জ্যামিতিক নিদর্শন প্রমাণ করে যে সেখানে শিল্পের বেশ কদর ছিল। ইতিহাসবিদ সিবত ইবন আল-জাওযি বর্ণনা করেছেন, ‘পৃথিবীতে আগে এ রকম কোনো কাঠামো নির্মিত হয়নি। অবয়ব, সুবিধা, হল, সজ্জা, অবস্থান ও ভূমির পরিমাণের দিক থেকে অত্যন্ত মার্জিতভাবে নির্মিত।’ (ইবন আল-জাওযি, শামসুদ্দিন ইউসুফ, মিরআতুজ জামান, ৮/৭২৯, হায়দরাবাদ দখন, ১৯৫১-১৯৫২)
মুসতানসিরিয়ার ভবন ছিল তখন আব্বাসীয় শাসনের গৌরব ও সমৃদ্ধির প্রতীক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিপুল জনসমাগম ঘটে। ৬ এপ্রিল, ১২৩৪ সালে (৫ রজব, ৬৩১ হিজরি) উদ্বোধন উপলক্ষে মন্ত্রী নাসিরুদ্দিন ইবন আল-নাকিদ, বিচারক, পণ্ডিত, কবি, সুফি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে একটি বিশাল ভোজসভার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে নির্মাণকারী, কারিগর, গ্রন্থাগারিক এবং তাদের সহযোগীদের ‘শিক্ষাগত’ পোশাক প্রদান করা হয়। (আল-ফুতি, পৃ. ৫৫)
আরও পড়ুন ইমাম গাজালি ও তাঁর শিক্ষাদর্শন১২ এপ্রিল ২০২৫মাদ্রাসার একটি দেয়ালউৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
রোহিঙ্গাদের সিম দিতে চায় সরকার
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বৈধভাবে সিম পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে তাদের অনেকের কাছেই বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিভিন্ন মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সিম রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নিরাপত্তা প্রশ্নে উদ্বেগ রয়েছে সরকারের। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বৈধভাবে সিম ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবছে অন্তর্বর্তী সরকার।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই রোহিঙ্গাদের সিম ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে অপারেটরদের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে।
মিয়ানমারে অত্যাচারের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। দেশে এখন ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের সিম ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে সেখানে অবৈধভাবে দুই দেশেরই সিম ব্যবহার হচ্ছে। রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরকেন্দ্রিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী অবৈধভাবে দেশি অপারেটরের সিম ব্যবহার করে এবং মিয়ানমারের সিম ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার চিন্তা করে তৎকালীন সরকার। সে সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটক সিম ব্যবহারের আলোচনা হয়েছিল। যদিও পরে বিষয়টি আর এগোয়নি।
এখন অন্তর্বর্তী সরকার রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে। গত সোমবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) চার মোবাইল অপারেটরের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিটিআরসি ও অপারেটর সূত্রমতে, ২৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের রোহিঙ্গা শিবিরে যাওয়ার কথা। ওই তারিখের মধ্যে প্রাথমিকভাবে কিছু সিম দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
যেভাবে সিম দেওয়ার ভাবনাসিম বিক্রির বিদম্যান নীতি অনুযায়ী, ব্যক্তিকে শনাক্তকারী পরিচয়পত্র ও বায়োমেট্রিক প্রয়োজন হয়। যেহেতু রোহিঙ্গাদের সে ধরনের পরিচয়পত্র নেই, তাই তাদের সিম দেওয়ার জন্য বিকল্প উপায় ভাবা হচ্ছে। অপারেটরদের সঙ্গে আলোচনায় বলা হয়, মোবাইল অপারেটররা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ভিন্ন নম্বর সিরিজ রাখবে। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) কাছে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন নম্বর রয়েছে। যেটাকে সাধারণত ‘প্রোগ্রেস আইডি’ বলা হয়। সে আইডির বিপরীতে ১৮ বছরের বেশি বয়সীরা সিম পাবেন। ইউএনএইচসিআর সরাসরি এই সিমগুলো পাবে।
সরকারের সঙ্গে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনএইচসিআরের এই ডেটাবেজ সংরক্ষিত থাকবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ডেটা সেন্টারে। কিন্তু এই ডেটাবেজ বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ হতে আগামী নভেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে। সূত্র বলছে, যেহেতু সরকারের লক্ষ্য চলতি মাস, তাই সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের অধীনে রোহিঙ্গাদের পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রথম ধাপে ২৫ আগস্টের মধ্যে ১০ হাজার নম্বর বরাদ্দ দেওয়ার আলোচনা হয়েছে।
অপারেটররা তিন ধরনের প্যাকেজ অফার করবে। এই প্যাকেজের খরচ ও সিমের দাম দেবে ইউএনএইচসিআর বা সরকার। নতুন সিম দেওয়ার পর বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে যেসব অবৈধভাবে সিম চলছে, সেগুলো বন্ধ করে দেবে সরকার।
তবে এসবই আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের শনাক্তকরণ একটি বিষয়। এটা নিশ্চিত না হলে সিম সেখানে দেওয়া যাবে না। সরকারের দিক থেকে এই পরিচয় নিশ্চিতকরণের বিষয়টি নিয়ে কথা চলছে।
অপারেটররা যা বলছেরোহিঙ্গাদের সিম দেওয়ার বিষয়টিকে স্বাগত জানান গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (সিসিএও) তানভীর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৈধভাবে সিম বিক্রয়ের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই, যা বহু মানুষকে বৈধ উপায়ে সিম ক্রয়ের সুযোগ করে দেবে।’
তবে রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বললেন ভিন্ন কথা। তাঁর কথায়, ‘নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সিম কর বাবদ অপারেটররা ইতিমধ্যে বড় অঙ্কের যে বিনিয়োগ এ খাতে করেছে, সেটি অকার্যকর হয়ে পড়বে।’
রোহিঙ্গাদের জন্য সিমের নিবন্ধনের প্রক্রিয়াটি সহজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স তাইমুর রহমান। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সুযোগ প্রদান সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় রাখতে সহায়তা করবে।
রোহিঙ্গা শিবিরকে একটি বিশেষায়িত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রযুক্তি নীতিমালা পরামর্শক আবু নাজম মো. তানভীর হোসেন বলেন, এখানে মিয়ানমারের নেটওয়ার্কও সক্রিয়। নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারকে বাইরের দেশের নেটওয়ার্ক সম্পূর্ণভাবে বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন সিম দেওয়ার আগে আগেরগুলো জব্দ ও নথিভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।