সংসদে নারী কোটা, না দলের সংস্কার জরুরি
Published: 29th, June 2025 GMT
জনপরিসরে জাতীয় সংসদে নারী কোটা নিয়ে তর্কবিতর্ক থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকগুলোতে নারী নেতৃত্বের অনুপস্থিতি পীড়াদায়ক। দলের নীতিনির্ধারণী কমিটিতে সদস্য বা সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁদের অভিজ্ঞতা থাকায় সব বিষয়েই তাঁদের সরব উপস্থিতি কাম্য। নিঃসন্দেহে তাঁরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যোগ করতেন। জাতি লাভবান হতো।
জাতীয় সংসদে নারী কোটাবিষয়ক সাধারণত তিনটি অনুমিতিকে বিবেচনা করা হয়। প্রথমত, সংসদে নারী রাজনীতিবিদদের উপস্থিতি দরকার বিধায় ইতিবাচক বৈষম্যের প্রয়োজন আছে। দ্বিতীয়ত, সংসদে নারী কোটা রাখলে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, নারী কোটা নিয়ে দেশে একটি স্বাভাবিক ঐকমত্য রয়েছে বিধায় কোটার পরিমাণ বা বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েই কেবল আলোচনা হতে হবে।
বেশি মাত্রায় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ অতীব জরুরি। জনসংখ্যার অনুপাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামোয় তাঁদের অংশগ্রহণ খুবই কম। প্রশ্ন হলো জাতীয় সংসদে নারী কোটাব্যবস্থা আসলে কতটা কাজ করছে? বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের নিজস্ব বাস্তবতা কী? কোটা পদ্ধতি আসলে নারীকে কি রাজনৈতিক ক্ষমতায়িত করছে?
সংখ্যা বনাম বাস্তবতা১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রথম ১৫টি সংরক্ষিত আসন চালু হওয়ার পর এই সংখ্যা বেড়ে ৫০ হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে দেখা গেছে, সংখ্যাগত বৃদ্ধি নারীর প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সমার্থক হয়নি।
বাস্তবতা হলো সংরক্ষিত আসনগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের নারী আত্মীয়স্বজনকে সংসদে আনার একটি পথ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাঁরা আলংকারিক ভূমিকা পালন করেছেন। মনোনয়ন-বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে। ক্ষমতাসীন দল সংরক্ষিত আসনের সিংহভাগ দখল করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রাধান্যও কায়েম করেছে।
কোটা পদ্ধতি ‘ক্ষমতায়ন’ নয়, ‘আত্মীয়পোষণ’-এর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ নারী এমপি শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়স্বজন ছিলেন। স্থানীয় সরকারে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব থাকলেও, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্বাচিত নারী সদস্যকে স্বামী বা পুরুষ আত্মীয়দের পরামর্শে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
২০২২ সালের তথাকথিত জেলা পরিষদ নির্বাচনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের ৯০ শতাংশই প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।
আরও পড়ুননারী সংসদ সদস্য: সংরক্ষিত নাকি সরাসরি ভোটে?০২ জুন ২০২৫রাজনৈতিক কাঠামোর সংকটবাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কাঠামোই নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বে আরোহণের মূল প্রতিবন্ধক। পুরুষতান্ত্রিকতার শিকড় নারীকে আষ্টেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। সমাজ-লোকাচার-রেওয়াজ নারীর অগ্রযাত্রায় প্রতি পদে পদে বাধা দিচ্ছে।
ফলে ৩৩ শতাংশের নিয়ম থাকলেও রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের অংশগ্রহণ ১৫ শতাংশের বেশি নয়। দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী নেতৃত্বের প্রভাব সামান্য। তাঁদের ভূমিকা শুধু আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৫ শতাংশ নারী এমপি কখনোই সংসদে স্বতন্ত্রভাবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান না।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতাদক্ষিণ এশিয়ার ভারতে স্থানীয় সরকারে ৩৩ শতাংশ নারী কোটা রয়েছে। কিছু রাজ্যে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এই কোটা নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ালেও অনেক ক্ষেত্রে ‘প্রক্সি পলিটিশিয়ান’ জাত সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ আত্মীয়দের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন। এটা নিঃসন্দেহে নারীর প্রকৃত ক্ষমতায়নের অন্তরায়। কোটার মাধ্যমে নারী নেতৃত্ব তৈরির পাকিস্তানি উদাহরণও আত্মীয়তোষণের। পাকিস্তানে ১৭ শতাংশ সংসদীয় আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। অধিকাংশ নারী সংসদ সদস্য রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। নারী কোটা নেতৃত্ব তৈরি করেনি, বরং রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর ক্ষমতা পুনরুৎপাদন করেছে।
ইউরোপের ফ্রান্স ২০০০ সালে সংসদে নারী কোটা চালু করলেও দলগুলো জরিমানা দিয়ে কোটা এড়িয়ে চলত। ২০১৭ সালে এমানুয়েল মাখোঁ প্রশাসন ‘জিপার সিস্টেম’ চালু করেন, যেখানে দলগুলোকে সমানসংখ্যক নারী-পুরুষ প্রার্থী দিতে হয়। এরপরও নারী এমপির হার ৩৯ শতাংশে আটকে আছে, কারণ ফ্রান্সের রাজনৈতিক নেটওয়ার্কিং এখনো পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় আবদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকায় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) ৫০ শতাংশ নারী কোটা চালু করায় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ৪৬ শতাংশে পৌঁছেছে।
যুক্তরাজ্যে লেবার দলীয় নারী নেতৃত্ববিষয়ক কর্মসূচি নির্বাচনী রাজনীতিতে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। ডেমোক্রেটিক পার্টি ‘ন্যাশনাল উইমেন্স পলিটিক্যাল ককাস’ এর মাধ্যমে নারী প্রার্থীদের প্রশিক্ষণ ও তহবিল সরবরাহ করে থাকে। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে আমেরিকান ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক নারী কংগ্রেসে নির্বাচিত হন। অনেকেই প্রথমবারের মতো নির্বাচিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ‘এমিলিস লিস্ট’ সংগঠনটি শুধু প্রো-চয়েস ডেমোক্রেটিক নারী প্রার্থীদের জন্যই তহবিল সংগ্রহ করে গত তিন দশকে ২৫ জন সিনেটর এবং ৩৮ জন গভর্নরসহ ৭০০–এর বেশি নারী প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে সহায়তা করেছে।
কেবল সংখ্যা বাড়ানো আর নেতৃত্ব তৈরি এক কথা নয়। নরওয়ে বা সুইডেনে নারী নেতৃত্বের সাফল্যের মূল কারণ সামাজিক সমতা; কোটা নয়।
আরও পড়ুনজাতীয় সংসদে কেন নারী কোটা থাকবে?০৩ জানুয়ারি ২০২৫নারী সদস্য বাড়ানোর চার প্রস্তাবইতিমধ্যে নারী সদস্য বাড়ানোর চারটি প্রস্তাব বর্তমান পদ্ধতি, ত্রি-আসন পদ্ধতি, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ও ঘূর্ণমান পদ্ধতি পেশ করা হয়েছে।
প্রচলিত দলীয় অনুপাতে বণ্টনপদ্ধতি সবচেয়ে ব্যর্থ মডেল। নারী এমপিরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নয়, দলের আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে মনোনীত হন। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে দলীয় তালিকায় নারীদের রাখা হবে, কিন্তু মনোনয়নপ্রক্রিয়া দলের হাতেই থাকবে। ত্রি-আসন বা ঘূর্ণমান পদ্ধতি চালু করলেও দলগুলো দুর্বল বা বিভক্ত এলাকা থেকে নারী প্রার্থী দেবে। যেখানে জেতার সম্ভাবনা কম।
প্রস্তাবগুলোতে মূলগতভাবে সংখ্যাগত প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর কথা থাকলেও গুণগত ক্ষমতায়ন নিশ্চিতির সাফল্য নিয়ে যৌক্তিক সন্দেহ থেকে যায়। যেকোনো কোটা পদ্ধতিই দলীয় কাঠামোর পুরুষতান্ত্রিকতা ভাঙতে পারবে না। বরং নারীর স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তাকে বিকশিত করবে না।
প্রকৃত পরিবর্তন কীভাবেবাংলাদেশের নারী কোটার অভিজ্ঞতা জানান দিচ্ছে, ‘সংখ্যা’ আর ‘ক্ষমতায়ন’ সমার্থক নয়। বাংলাদেশের মানুষ কৃত্রিম ব্যবস্থার বদলে প্রকৃত পরিবর্তন চায়। নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য দরকার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তন এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য সমাধান খুঁজতে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক আরও বেশি তর্কবিতর্ক জরুরি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দলীয় কমিটিতে ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী সদস্যভুক্তি বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নারী নেতৃত্ব উন্নয়ন কর্মসূচি চালুর মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নারী প্রার্থীদের প্রস্তুত করা যায়। তৃতীয়ত, নারী প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী খরচের একটি অংশ সরকারি তহবিল থেকে প্রদানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সর্বোপরি, সংসদীয় কমিটিগুলোতে নারী সদস্যদের ন্যূনতম ২৫ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলে নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় তাঁদের ভূমিকা বাড়ানো সম্ভব।
কোটার নামে শুধু সংখ্যা বাড়ালে হবে না, দরকার নারী নেতৃত্ব সৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ। বাংলাদেশের নারী যখনই প্রকৃত ব্যবস্থা পেয়েছেন, তখনই তাঁরা তাঁদের সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন, এখনই সময় ব্যবস্থাগত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার।
● ড.
রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক ষমত র র জন ত ক স রক ষ ত র জন ত ত প রক র য় ক ষমত য় ব যবস থ ত পর ব থ কল ও প রক ত প রস ত র জন য সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
অস্ট্রেলিয়ার ভিসা চায় টুভালুর মানুষ
দ্বীপরাষ্ট্র টুভালুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন ভিসার জন্য আবেদন করেছেন। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশটির পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
জাতিসংঘে দেশটির স্থায়ী প্রতিনিধি তাপুগাও ফালেফোউ রয়টার্সকে বলেছেন, অভিবাসনপ্রত্যাশীর হার দেখে তিনি নিজেও হতবাক হয়ে গেছেন। অস্ট্রেলিয়া ও হাওয়াইয়ের মধ্যবর্তী এলাকায় ৯টি প্রবাল দ্বীপজুড়ে বিস্তৃত রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। চলতি মাসে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসন আবেদন শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১ হাজার ১২৪ জন আবেদন জমা দিয়েছেন। আবেদনকারীদের পরিবারের সদস্যসহ ভিসাপ্রত্যাশীর সংখ্যা ৪ হাজার ৫২ জনে গিয়ে ঠেকেছে। রয়টার্স।