বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) কতটা কার্যকর হবে?
Published: 2nd, July 2025 GMT
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হওয়ার পর বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার প্রসঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিএনপিসহ অনেক দল ও গোষ্ঠী বর্তমান সহজ সংখ্যাধিক্য পদ্ধতি চালু রাখার পক্ষে শক্ত অবস্থান তুলে ধরেছে। কিন্তু জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও বামপন্থী কয়েকটি দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) চালুর প্রস্তাব করেছে। কেউ কেউ শিগগিরই আনুপাতিক চালু না হলে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এ পদ্ধতিতে ভোটের পথে হাঁটতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
সম্প্রতি রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক মহাসমাবেশ থেকে সব ক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন চালুর জোর দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এরপর পিআর পদ্ধতি নিয়ে আবার আলোচনায় সরব হন রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও নেটিজেনরা। প্রশ্ন হলো, আসলেই কি বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতি চালু করা সম্ভব?
আমরা জানি, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় বিভিন্ন ধরনের সরকার পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। তবে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য দুটি সরকার ব্যবস্থা হচ্ছে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি ও সংসদীয় পদ্ধতি। সংসদীয় পদ্ধতিতে আবার দুটি ভিন্ন নির্বাচন পদ্ধতি রয়েছে। একটি হলো সহজ ভোটাধিক্য পদ্ধতি, অর্থাৎ ভোট প্রাপ্তির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণের নির্বাচন, যাকে ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) পদ্ধতির নির্বাচন বলা হয়। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটিকে ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ ভিত্তিক নির্বাচন বলা হয়।
আরো পড়ুন:
ট্রলি টাগের আঘাতে বোয়িং বিমান ক্ষতিগ্রস্ত
ব্যাংক লেনদেন বন্ধ আজ
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ‘একক নির্বাচনী আসন’ ও সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। যদিও বিভিন্ন মহল দেশে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণের দাবি করছে। কারণ এ পদ্ধতিতে ভোটের অনুপাতে দেশের ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দল ও শ্রেণীর প্রতিনিধিদের জাতীয় সংসদে আসার সুযোগ তৈরি হয়, যা সংসদকে আরো কার্যকর ও সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতিতে প্রতিটি সংসদীয় বা নির্বাচনী এলাকায় ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংসদ ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত হয়। শুনতে সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার মনে হলেও আদতে এ ব্যবস্থার মাধ্যমে, এমনকি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলেও ‘সংখ্যালঘিষ্ঠের’ সরকারই গঠিত হয়। উদাহরণস্বরপ, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সপ্তম ও নবম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩৭ দশমিক ৪৪ ও ৪৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ভোটপ্রাপ্ত হয়ে যথাক্রমে ১৪৬ ও ২৩০টি আসন নিয়ে সরকার গঠন করে। উপরোক্ত দুই নির্বাচনে বিএনপি শতকরা ৩৩ দশমিক ৬০ ও ৩২ দশমিক ৫০ ভাগ ভোট পেয়ে যথাক্রমে ১১৬ ও ৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮৪ ও ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। কিন্তু আসনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এ ব্যবধান গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১০ ও ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশে। যেহেতু বাংলাদেশে বিদ্যমান এফপিটিপি নির্বাচনী ব্যবস্থায় ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে তার কোনো সীমা নেই, সেহেতু ১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়েও যে কেউ নির্বাচিত হতে পারেন।
বাংলাদেশে বিদ্যমান এফপিটিপি পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের একটা বড় দুর্বলতা হলো, এ পদ্ধতিতে সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হওয়া। এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন এবং বাকিরা সবাই গৌণ। এর ফলে যেকোনো পন্থায় বিজয়ী হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন প্রার্থীরা। যখন বিশেষ দল বা ব্যক্তির জয়ই মুখ্য হয়, তখন সমাজের পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয় না। এ পদ্ধতিতে কোনো দলের তাদের সামগ্রিক ভোটের সংখ্যা বা পপুলার ভোট পরাজিত দলের চেয়ে কম হলেও বেশি আসনে জয়ী হওয়ায় বা ইলেকটোরাল কলেজের ভোট বেশি পাওয়ায় তারা সরকার গঠন করতে পারে।
এফপিটিপি পদ্ধতির এসব সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে। এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি নয়, বরং দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারা দেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায়, আনুপাতিক হারে সংসদে সে সেই পরিমাণ আসন পায়। এ পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোটই মূল্যায়ন করা হয় এবং যে দল কম ভোট পায়, সংসদে তাদেরও প্রতিনিধিত্ব থাকে। আমাদের সংসদে এখন সংরক্ষিত নারী আসনের বণ্টনও এ আনুপাতিক হারে হয়। অর্থাৎ মূল নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলো যে আসন পায়, সেই অনুপাতে ৫০ জন সংরক্ষিত আসনের এমপি নির্বাচিত হন। অথচ মূল নির্বাচন হয় অন্য পদ্ধতিতে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে প্রতিটি দলই সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে একটি প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনে দেয় এবং তালিকাটি গোপন রাখা হয়। প্রতিটি দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই আলোকে ওই তালিকা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রতিনিধি পায়। যেমন বিদ্যমান ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচনে যদি কোনো দল ১ শতাংশ ভোট পায়, তাহলে আনুপাতিক হারে তারা সংসদে তিনটি আসন পাবে। এরপর প্রকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠনের জন্য মোট প্রাপ্ত ভোটের ৫১ শতাংশ যে দল পাবে তারা সরকার গঠন করবে। কোনো দল এককভাবে ৫১ শতাংশ না পেলে একাধিক দল মিলে জোট গঠন করেও সরকার গঠন করতে পারে। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে ভোটাররা ভোট দেন দলকে, কোনো ব্যক্তিকে নয়।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যেকোনো মূল্যে বিজয়ী হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা কমে আসবে। ব্যক্তির বদলে মানুষ যখন দলকে ভোট দেবে, তখন স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব ও হানাহানি বন্ধ হবে। যে দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাবে, তারা যেমন সংসদে থাকবে, তেমনি ১০ শতাংশ ভোট পেলে সেই দলেরও প্রতিনিধিত্ব থাকবে। অর্থাৎ সংসদ হয়ে উঠবে সর্বদলীয়।
আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির কার্যকারিতা বিবেচনায় নিয়ে অনেক রাষ্ট্রে এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আনুপাতিক পদ্ধতির কতটুকু প্রয়োগ করা যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত দেশে আইনসভার সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। অন্যদিকে স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজ হয়ে থাকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশে সংসদ সদস্যরা মূলত এলাকার উন্নয়নমূলক কাজকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। দেখা যায়, ওই সংসদ সদস্যের আইন প্রণয়নে দক্ষতার পরিবর্তে এলাকার উন্নয়নের মাপকাঠিতে ভোটাররা তাকে পরবর্তী নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলের কেন্দ্রীয় তালিকার ভিত্তিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে কোনো একটি নির্দিষ্ট উপজেলা বা বর্তমান সংসদীয় আসনে বিভিন্ন দল থেকে একাধিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন। আবার কোনো প্রত্যন্ত এলাকা বা জেলা থেকে কোনো প্রতিনিধিই নির্বাচিত নাও হতে পারেন। ফলে ওসব এলাকার উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হলে ভিন্ন কথা।
আরেকটি বিষয় হলো, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন করা হলে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতারা শুরুর দিকে জায়গা করে নেবেন। সেক্ষেত্রে জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতারা পিছিয়ে পড়বেন। তখন প্রতিনিধিত্ব অঞ্চলভিত্তিক না হয়ে আরো বেশি রাজধানীকেন্দ্রিক হয়ে যাবে। ফলে নির্বাচিত এসব নেতার নির্দিষ্ট কোনো এলাকার প্রতি আলাদা দায়বদ্ধতা তৈরি হবে না এবং তুলনামূলক প্রত্যন্ত এলাকাগুলো উন্নয়নকাজে অনেক পিছিয়ে পড়বে। জনগণের প্রতিনিধি হলেও তারা একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন, প্রত্যেকটি দলের অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম দুর্বল হয়ে শুধু কেন্দ্রীয় তৎপরতা বেড়ে যাবে এবং দলের প্রার্থী তালিকায় শুরুর দিকে থাকতে আন্তঃকোন্দল বেড়ে যাবে।
আনুপাতিক পদ্ধতিতে আপাতদৃষ্টিতে ছোট দলগুলোর লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। কিন্তু আইনে যদি বলা হয়, ৩ কিংবা ৫ শতাংশের নিচে ভোট পেলে সেসব দল কোনো আসন পাবে না, তখন ছোট দলগুলোর আম ও ছালা দুটোই যাবে। যেমন সাইপ্রাসে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেলেই সে দেশের কোনো দল ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধি পাঠানোর সুযোগ পেত। যুক্তরাজ্যে তা ছিল ৫ শতাংশ। তবে বড় দল যদি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তখন জোট সরকার গঠনের সময় ছোট দলগুলোর দৌরাত্ম্য বেড়ে যেতে পারে এবং তাদের অনেক অন্যায্য দাবি বড় দলগুলোকে মেনে নিতে হবে। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে যে সরকার গঠন হবে সে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়েও জটিলতা তৈরি হবে। বর্তমানে যেসব দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি চালু আছে, সেসব দেশে সরকারের স্থিতিশীলতা নিয়ে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। যার বড় উদাহরণ নেপাল।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন পিআর পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেনি। তবে দুটো কমিশনই দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের সুপারিশ করেছে এবং উচ্চকক্ষে পিআর চালুর প্রস্তাব করেছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদনে পিআর পদ্ধতির অনেকগুলো ভালো দিক উল্লেখ করার পাশাপাশি এটিও লিখেছে যে, ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা হলো সরকারের সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা। উল্লেখিত চারটি নির্বাচনে যেহেতু কোনো দলের পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব হতো না, তাই বড় দলগুলো ক্ষুদ্র দলগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে যেতে পারত এবং ‘টিরানি অব দ্য স্মল মাইনোরিটি’ বা ছোটদের আাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারত। এছাড়াও সরকার গঠনে ভাঙ্গাগড়ার খেলা প্রকট হয়ে উঠতে পারত। এমনকি সরকার গঠনে লেনদেনের প্রভাবও ঘটতে পারত। এছাড়াও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলের আধিপত্য বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নিম্নকক্ষ অর্থাৎ সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিকভাবে) উচ্চকক্ষের ১০০ আসন বণ্টনের সুপারিশ করেছে। কমিশন প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০% দলের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং অবশিষ্ট ৫০% আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ইত্যাদির মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করারও সুপারিশ করেছে। উচ্চকক্ষ সকল দল ও মতের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে।
পরিশেষে, যেসব দল নিম্নকক্ষে পিআর চালুর প্রস্তাব করেছে উচ্চকক্ষে পিআর হলে কিছুটা হলেও তাদের দাবি পূরণ হবে এবং উচ্চকক্ষে পিআর চালুর মাধ্যমে এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়েও এক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ হয়ে যাবে। আর ভবিষ্যতে নিম্নকক্ষে পিআর চালু করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নতি করার ওপর জোর দিতে হবে।
নেসার আমিন: লেখক ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর সরক র গঠন কর স প র শ কর ব যবস থ র প আর চ ল দলগ ল র সরক র প এফপ ট প র প রস এল ক র অর থ ৎ আসন প আসন র দশম ক হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে
পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।
শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।
১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে।
একনজরে জয়দেবচারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।
ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ।
পাহাড় আর ঝিরির পথে পথেখাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।
জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে।
সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে।
জয়দেব রোয়াজা