সীতাকুণ্ডে প্রাকৃতিক ঝরনা ও সমুদ্র দর্শনে এসে অসতর্কতায় গত দুই প্রাণ হারিয়েছেন ৯ পর্যটক, তাদের মধ্যে সাতজনই শিক্ষার্থী। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হওয়ায় অবশেষে টনক নড়েছে বন বিভাগের। ঝরনাগুলোয় নিরাপত্তা জোরদারে উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

নৌ-পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত দুই বছরে দুর্গম পাহাড়ে ঝরনা দেখতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ জন, গোসলে নেমে সমুদ্রের পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন তিনজন। 

গত বছর সহস্রধারা-২ ঝরনায় এক পর্যটক মারা যাওয়ার পর দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় ৬টি পরামর্শ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। সেগুলো হলো–যেসব পর্যটক একদম সাঁতার জানেন না কিংবা কম সাঁতার জানেন, তাদের অবশ্যই পানিতে নামতে না দেওয়া, ঝরনার ওপরে উঠতে না দেওয়া, বিপজ্জনক গর্ত কিংবা বেশি গভীরতার জলাশয়ের সামনে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন, ইজারাদারের লোক বাড়ানো ও অনুমোদনহীন পর্যটন স্পট বন্ধ করে দেওয়া। তবে এসব পরামর্শের বেশির ভাগ আমলে না নেওয়ার অভিযোগ ওঠে বন বিভাগের বিরুদ্ধে।

সীতাকুণ্ডে মোট সাতটি ঝরনা রয়েছে। ঝরনাগুলো হলো ঝরঝরি, মধুখায়া, সহস্রধারা-২, সহস্রধারা-১, সুপ্তধারা, অগ্নিকুণ্ড ও বিলাসী। সীতাকুণ্ড-মিরসরাই সীমান্তের ওয়াহেদপুরে রয়েছে রূপসী ঝরনা। এর মধ্যে যাতায়াত সহজ হওয়ায় পর্যটকরা সহস্রধারা-২ ঝরনায় বেশি যান। যারা একটু পাহাড়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে চান, তারা ঝরঝরি, রূপসী ও বিলাসী ঝরনায় গা ভাসান।

বনবিভাগ চারটি ঝরনা ইজারা দিয়েছে। এগুলো হলো সহস্রধারা-১, সহস্রধারা-২, রূপসী ও সুপ্তধারা ঝরনা। সহস্রধারা-২ ঝরনায় যাতায়াত সহজ হলেও পর্যটকদের নৌকায় চেপে একটি বড় হ্রদ পার হতে হয়। কখনও কখনও নিয়ম অমান্য করে হ্রদে গোসল করতে নেমে পড়েন পর্যটকেরা। ফলে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। আবার কখনো নৌকা থেকে পড়েও মৃত্যু হয়। হ্রদটি কমপক্ষে ৩০ ফুট গভীর। সাঁতার না জানা পর্যটকদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। 

সহস্রধারা ঝরনা-২ এর বিভিন্ন পয়েন্টে সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়,  ইউনিফর্ম পড়া ইজারাদারের লোক পর্যটকদের দিকে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। হ্রদের পাড়ে একজন ইউনিফর্ম পড়ে হাতে হ্যান্ড মাইক নিয়ে মাইকিং করতে দেখা গেছে। ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঝরনার একেবারে কাছে থেকে পর্যটকদের সরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন দুইজন ইউনিফর্ম পরিহিত কর্মী। 

অজস্রধারা ঝরনার প্রবেশ মুখে আরও দুইজন কর্মীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। হ্রদের পারে থাকা কর্মী জয়নাল আবেদীন হ্যান্ড মাইকে বলছিলেন, ‘এই লেক অত্যন্ত গভীর। পানি ঠাণ্ডা। লেকে নামা কিংবা সাঁতার কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ। কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে লেকে নামলে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সমুদ্রসৈকত ঘিরে প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাব, প্রয়োজনীয় উদ্ধার সরঞ্জামের সংকট ও  পর্যটকদের অসতর্কতার কারণে ঘটছে প্রাণহানি। সৈকতে আসা পর্যটকদের মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে বৈরি আবহাওয়া ও ভাটার সময় পানিতে না নামতে সতর্ক চিহ্ন সংবলিত দিকনির্দেশনা প্রবেশদ্বারগুলোতে দেওয়া প্রয়োজন। তা দেখে পর্যটকেরা সতর্ক হলে কমে যেত প্রাণহানী। এ ছাড়া পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে নেট বা জাল দেওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিমুক্ত গোসলের স্থান নির্ধারণের দাবি জানান তাঁরা।

পর্যটকদের অভিযোগ, সৈকতে সতর্কতামূলক কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় তারা ঘুরতে এসে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন। সৈকতে নিরাপত্তাকর্মী দেওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো জরুরি বলে তাঁদের অভিমত। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিকভাবে সাগর প্রতিনিয়ত তার আচরণ পাল্টায়। জোয়ারের সময় সাগরের যে স্থানে সমতল থাকে, ভাটার সময় সেই স্থানে খাদের সৃষ্টি হয়, ফলে ঘূর্ণিপাকে সেখানে চোরাবালির সৃষ্টি হয়। তাই সৈকতে গোসল করতে নামতে হবে নিরাপদ জায়গায়। নয়তো বিপদ থাকে। 

সীতাকুণ্ডের বারৈয়াঢালা বনবিভাগের অধীনে থাকা ইজারা দেওয়া সবকয’টি ঝরনায় দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দর্শনার্থীদের সচেতন করতে ব্যবহার করা হচ্ছে হ্যান্ড মাইক, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে কর্মীর সংখ্যা, দায়িত্বে থাকা কর্মীদের দেওয়া হয়েছে ইউনিফর্ম ও ওয়াকিটকি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বনবিভাগের বারৈয়াঢালা রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম। 

গত ১৪ জুন বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের ছোট দারোগাহাট এলাকায় সহস্রধারা-২ ঝরনায় গোসলে নেমে এক শিক্ষার্থী মারা যান। এর পরদিন ওই ঝরনা থেকে ২ কিলোমিটার উত্তরে থাকা সীতাকুণ্ড–মিরসরাই সীমানায় থাকা রূপসী ঝরনায় আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মারা যায়। ঝরনার দুটি বারৈয়ারঢালা বনবিভাগের অধীন। এরপর অভিযোগ উঠে ঝরনাগুলোতে পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। 

ঢাকা থেকে আসা পর্যটক শান্তা আলম বলেন, সন্ধ্যা হওয়ার ফলে  ইজারাদারের লোকজন তাদের দ্রুত ঝরনা এলাকা ছাড়তে তাগাদা দিচ্ছেন। এটা একটা ভালো দিক। যারা ঝরনা–প্রেমী, তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝরনায় থাকলেও তৃপ্তি মেটে না। ফলে কখন সময় চলে যায় তা তাদের মনে থাকে না। 

নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লিটন ও কামরুল বলেন, ‘ঝরনার উপরের দিকে পাহাড় বেয়ে উঠতে গেলে বা ঝুঁকিপূর্ণ কোন স্থানে যেতে চাইলে দর্শনার্থীদের বাধা দিচ্ছি। এখন কাউকে আর লেকে নেমে সাঁতার কাটতে দেওয়া হয় না। ঝরনায় এখন ৮ জন কর্মচারী, একজন বোট চালক ও ৬ জন নিরাপত্তাকর্মী কাজ করছেন।’

ঝরনার ইজারাদার ওহিদুল ইসলাম শরীফ বলেন, ‘আমরা ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করেছি। সতর্কতামূলক ব্যানার–ফেস্টুন বাড়ানো হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে পর্যটকদের উঠতে নিষেধ করা হচ্ছে। লেকে নৌকা ভ্রমণের জন্য লাইফ জ্যাকেটও বাড়ানো হয়েছে।’ 

রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, ‘গত দুই বছরে যারা ঝরনায় এসে মারা গেছেন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তাদের প্রায় সবাই ৩০ বছরের কম বয়সী। এই বয়সের পর্যটকরা অত্যন্ত বেপরোয়া। তারা ঝরনায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজনের কথা শুনতে চান না। তবুও আমরা ঝরনাকে নিরাপদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইউন ফর ম ইজ র দ র বনব ভ গ পর যটক ঝরন য ২ ঝরন ঝরন য় সতর ক ঝরন র

এছাড়াও পড়ুন:

মার্কিন পর্যটকদের ওপর ১০ হাজার ডলার ভিসা বন্ড আরোপ করল মালি

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালি ঘোষণা দিয়েছে যে, এখন থেকে দেশটিতে ভ্রমণ বা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক মার্কিন নাগরিকদের ১০ হাজার ডলার জামানত বা বন্ড দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন মালিসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাগরিকদের ওপর একই ধরনের শর্ত আরোপের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা এই পদক্ষেপ নিয়েছে মালি।  

আরো পড়ুন:

টেনেসির সামরিক কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত ১৬

ট্রাম্প-সিসির সভাপতিত্বে সোমবার মিসরে ‘গাজা শান্তি সম্মেলন’

মালিতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস শুক্রবার (১০ অক্টোবর) এক ঘোষণায় বলেছিল, ওয়াশিংটনের ‘আমেরিকার সীমান্ত রক্ষা ও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি’ জোরদার করার জন্য এই ফি চালু করা হয়েছে।

মালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রবিবার (১২ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে জানায়, “যুক্তরাষ্ট্র এই বন্ড একতরফাভাবে আরোপ করেছে, তাই আমরা মার্কিন নাগরিকদের জন্য একই ধরনের ভিসা কর্মসূচি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

এই নতুন ভিসা নীতি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের চলমান প্রচেষ্টার মধ্যেই এসেছে। গত জুলাই মাসে মার্কিন কর্মকর্তারা মালি সফর করেছিলেন সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে- বিশেষ করে মালির সোনা ও লিথিয়াম খনির সম্ভাবনা নিয়ে।

২০২১ সালে একটি অভ্যুত্থানের পর মালির সেনা প্রধান জেনারেল আসিমি গোইতা ক্ষমতা দখল করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। জিহাদিদের ক্রমবর্ধমান বিদ্রোহ দমন করার জন্য জেনারেল আসিমি রাশিয়ার দিকে ঝুঁকি পড়েন। 

তিনি ফরাসি সেনাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেন এবং রুশ ভাড়াটে যোদ্ধা সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপকে দেশে আনার অনুমতি দেন। বর্তমানে সেই বাহিনীকে ‘আফ্রিকা কর্পস’ নামের একটি নতুন কাঠামো প্রতিস্থাপন করেছে।

শুধু মালি নয়, সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্য পশ্চিম আফ্রিকান দেশেও মার্কিন অভিবাসী নীতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। গত সপ্তাহে বুরকিনা ফাসোর সামরিক সরকার যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো অভিবাসী প্রত্যাবাসন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, যার জবাবে ওয়াশিংটন দেশটিতে ভিসা ইস্যু স্থগিত করে।

বুরকিনা ফাসোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কারামোকো জ্যাঁ-মারি ত্রাওরে প্রশ্ন তোলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ‘ব্ল্যাকমেইল’ কিনা। তিনি বলেন, “আমরা তৃতীয় দেশের অভিবাসীদের গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি- এ কারণেই কি তারা আমাদের ওপর এই চাপ দিচ্ছে?”

ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন বিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়িত করার জন্য আফ্রিকান দেশগুলোকে একটি সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মার্কিন পর্যটকদের ওপর ১০ হাজার ডলার ভিসা বন্ড আরোপ করল মালি