বিমান দুর্ঘটনা: অপসাংবাদিকতা, ভাইরালের নেশা ও গুজবের গজব
Published: 22nd, July 2025 GMT
গতকাল উত্তরায় একটি স্কুলভবনে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ঘন কালো ধোঁয়া, মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা আর প্রিয়জন হারানো পরিবারের কান্না দেখে পুরো দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমন দুঃসময়ে মনে হয় যেন সব থেমে গেছে, অথচ কাজ না করলে বিপদ আরও বাড়ে। পুরো পরিস্থিতি বুঝে উঠতে সময় লাগছে, কিন্তু একটা কথা সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল: এমন বিপদে কী বলতে হবে বা কী করতে হবে, তার জন্য আমাদের সংস্থাগুলো তৈরি ছিল না। আমরাও কি নাগরিক হিসেবে তৈরি ছিলাম?
ঘটনার পরের কয়েক ঘণ্টা বোঝা গেল, বাংলাদেশে বিপদ সামলানোর ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি আছে। আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে একটা এক্স পোস্ট (টুইট) দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে, অথচ বিপদ নিয়ে কথা বলার আমাদের পদ্ধতি এখনো অনেক পুরোনো।
এই দুঃখজনক ঘটনাটা আমাদের জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশের এখনই দরকার ভালো পরিকল্পনা করে কথা বলা এবং বিপদ কমানোর ব্যবস্থা তৈরি করা—বিপদ হওয়ার পর তা নিয়ে ভাবলে হবে না, বরং এগুলো দেশের পরিচালনার এবং নাগরিকের দায়িত্বের মূল অংশ হতে হবে।
সময়মতো সুনির্দিষ্ট সরকারি তথ্যের আদান-প্রদানে না হওয়ায় ভুল তথ্য ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। যাচাই না করা ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশি ষড়যন্ত্র, পাইলটের আত্মহত্যা, এমনকি অদ্ভুত সব গুজবও মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। সামাজিক মাধ্যমে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, ভালো মানুষ আর সুযোগসন্ধানী—সবাই মিলে তা ছড়াচ্ছিল। যখন সত্যি খবর দ্রুত পাওয়ার সুযোগ থাকে না, তখন মানুষ আবেগী হয়ে পড়ে, মানুষ আতঙ্কিত হয়। যখন বিপদ আসে, তখন সবার আগে বিশ্বাস ভেঙে যায় না—তথ্য না থাকলেই বিশ্বাস মরে যায়।
একটা খুবই খারাপ বিষয় ছিল মৃতদের ছবি—যাদের মধ্যে কিছু শিশুও ছিল—ফেসবুক, টিকটক এবং হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া। কিছু ক্ষেত্রে, দুর্ঘটনার জায়গায় শোকাহত পরিবারের মুখের ওপর জুম করে ছবি তোলা হয়েছিল, যেন তাদের কষ্ট দেখানো একটা খেলা। এটা সাংবাদিকতা নয়। এটা কৌতূহলের আড়ালে নিষ্ঠুরতা।
ইউনিসেফের নিয়ম খুব স্পষ্ট: শিশুদের ছবি কোনো দুঃখজনক ঘটনার প্রতীক হিসেবে খুব সাবধানে, তাদের সম্মান বজায় রেখে এবং তাদের অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করতে হবে। তাদের পরিচয় গোপন রাখতে হবে, তাদের গল্প সাবধানে বলতে হবে। অথচ, টিক-টকারদের ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতায় এই সাধারণ নিয়মগুলো মানা হয়নি। পরিবারের মানসিক কষ্ট শুধু তোলা হয়নি; তা সারা দুনিয়াতে দেখানো হয়েছে, শেয়ার করা হয়েছে, মন্তব্য করা হয়েছে এবং টাকা আয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
আমাদের এটা নিয়ে কথা বলতে হবে, রাগ করে নয়, বরং দায়িত্ব নিয়ে। সম্পাদকদের তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সামাজিক মাধ্যমগুলোকে খারাপ ছবি বা তথ্য সরিয়ে দিতে হবে, আর নাগরিকদের পোস্ট করার আগে ভাবতে হবে। একটা ছবি শেয়ার করা হয়তো সচেতনতা বাড়াচ্ছে মনে হতে পারে, কিন্তু যখন তা কারও সম্মান নষ্ট করে, তখন তা এক ধরনের শোষণ হয়ে যায়।
এখানে সমস্যাটা শুধু একটা প্রতিষ্ঠানের নয়। উত্তরার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, বিশেষ করে যখন সামরিক বিষয় জড়িত থাকে, তখন দ্রুত, স্বচ্ছ এবং মানবিক যোগাযোগ জরুরি। চুপ থাকলে তদন্ত সুরক্ষিত থাকে না; বরং সন্দেহ বাড়ে। সংবাদমাধ্যমগুলো, যদিও কিছু সংবাদমাধ্যম সংযম দেখিয়েছিল, কিন্তু চাঞ্চল্যকর খবরের পেছনে ছুটেছিল। শোকাহত বাড়ি থেকে সরাসরি দেখানো, অনুমানভিত্তিক খবর এবং একে অপরের উল্টো খবর শুধু বিভ্রান্তি বাড়িয়েছিল।
বিপদে সাংবাদিকতার প্রথম কাজ হলো খবর যাচাই করা, ভাইরাল হওয়া নয়। অনেক সংস্থারই আগে থেকে তৈরি যোগাযোগ পরিকল্পনা ছিল না। কী প্রশ্ন আসতে পারে, কী উত্তর দিতে হবে—এমন মৌলিক কোনো প্রস্তুতি ছিল না।
২০২৫ সালে এটা মানা যায় না। নাগরিক এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা, যদিও তাদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু তারা অনেক ভুল তথ্য ছড়িয়েছে। খারাপ ছবি, ভুল খবর, ভুয়া উদ্ধারের খবর এবং মনগড়া হতাহতের তালিকা অবাধে ছড়িয়ে পড়েছে । আগুন লাগলে কী করতে হয় বা ভূমিকম্প হলে কী করতে হয়, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণের মতোই সংকটকালে কী করে যোগাযোগ করতে হয় সে বিষয়ে মানুষের শিক্ষা দরকার। কখন কিছু শেয়ার করা উচিত নয়, তা জানা, কী শেয়ার করা উচিত তার মতোই জরুরি।
পরিকল্পিত যোগাযোগ (স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন) মানে মিথ্যা বলা বা শুধু প্রচার করা নয়। এটি হলো একটি বিপদের আগে, চলাকালীন এবং পরে তথ্য ব্যবস্থাপনার একটি চিন্তাভাবনা করে করা, স্বচ্ছ এবং মানুষের জন্য তৈরি পদ্ধতি। যদি বাংলাদেশের এমন একটি ব্যবস্থা থাকত, তাহলে আমরা দেখতাম যে ৬০ মিনিটের মধ্যে একজন প্রশিক্ষিত ব্যক্তি সংবাদমাধ্যমকে বলছেন, যাচাই করা খবর সহ একটি লাইভ তথ্য বোর্ড থাকছে, বাংলা ও ইংরেজিতে নিয়মিত খবর দেওয়া হচ্ছে, সঠিক খবর ছড়ানোর জন্য সবার সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে এবং গুজব বন্ধ করার জন্য প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে।
ঝুঁকি কমানো শুধু একটি ফাইলে রাখা কাগজপত্রের মতো নয়। এর মানে হলো আবাসিক এলাকার খুব কাছে থাকা প্রশিক্ষণের জায়গাগুলো চিহ্নিত করা, উড়োজাহাজের পথের নিয়মিত নিরাপত্তা পরীক্ষা করা, শুধু উদ্ধারের জন্য নয়, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যও নকল মহড়া দেওয়া এবং বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে কীভাবে দায়িত্বের সঙ্গে খবর প্রকাশ করতে হয় সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। এর মানে হলো বিপদ মোকাবিলার প্রস্তুতিতে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করা। উত্তরার মানুষ যদি বিমান দুর্ঘটনার সময় কী করতে হবে সে বিষয়ে আগে থেকে প্রশিক্ষণ পেত, তাহলে হয়তো সেখানকার অনেক বিশৃঙ্খলা কমানো যেত।
১৮ কোটি ডিজিটাল নাগরিকের একটি সাধারণ নীতিবোধ থাকা উচিত। ডিজিটাল সহানুভূতির ওপর একটি দেশের নীতি অনেক আগেই দরকার ছিল। স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র—সব জায়গায় অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণ শেখাতে হবে। শেয়ার করার আগে ভাবুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন: এটা কি সত্যি? এটা কি সাহায্য করবে? এটা কি সম্মান বাড়াবে না ক্ষতি করবে? যদি আমার পরিবার কষ্টে থাকত তাহলে কি আমি এটা শেয়ার করতাম? ভুল তথ্য মানুষকে মারে। মিথ্যা তথ্য কষ্ট দেয়। কিন্তু চুপ থাকলে দুটোই বাড়ে। ইন্টারনেট সবাইকে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। এখন সময় এসেছে আমরা যেন বিবেক দিয়ে তা ব্যবহার করতে শিখি।
এই লেখাটা কোনো অভিযোগ নয়; এটা একটা অনুরোধ। আমাদের সম্মিলিত কষ্টকে সংকল্পে পরিণত করার একটা অনুরোধ। উত্তরায় যা ঘটেছে, তা আমরা পাল্টাতে পারব না। কিন্তু আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে পরের বার যখন কোনো বিপদ আসবে, তখন আমরা বিশৃঙ্খলা নয়, বরং স্পষ্টতা দিয়ে তার মোকাবিলা করব।
আমরা সরকারকে বলছি দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য একটি জাতীয় কৌশলগত যোগাযোগ ইউনিট তৈরি করতে, কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষকে বিপদকালে যোগাযোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে, এবং শিশু-কিশোরদের ছবি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তথ্য সুরক্ষা ও নৈতিক নিয়মকানুন মেনে চলতে। আমরা সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ করছি অনলাইনে মানুষের কষ্টের কথা ভেবে তাদের নৈতিক নিয়মগুলো আবার দেখতে এবং যাচাই না করা খবর বা মানুষের কষ্টকে কাজে লাগানো থেকে বিরত থাকতে। আর আমরা নাগরিকদের বলছি অনলাইনে সম্মান বজায় রাখতে, ভুয়া খবর রিপোর্ট করতে, এবং মনে রাখতে যে প্রতিটি ছবির পেছনে একটি পরিবার আছে যারা বাঁচার চেষ্টা করছে।
একটি জাতিকে কোনো দুঃখজনক ঘটনা দিয়ে চেনা যায় না। এর প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়াই আমাদের পরিচয় তুলে ধরে। কৌশলগত যোগাযোগ এবং বিপদ কমানো শুধু কিছু কাজের অংশ নয়—এগুলো আমাদের সবার দায়িত্ব। আমাদের আকাশ ভরে দেওয়ার জন্য যেন আরেকটা সাইরেনের অপেক্ষা করতে না হয়।
রিজওয়ান-উল-আলম সহযোগী অধ্যাপক, মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব দম ধ শ য় র কর ব যবস থ ব যবহ র দ র ঘটন আম দ র পর ব র র জন য ঘটন র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্তের আহ্বান সিপিজের
খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক মিলন ত্রিপুরার ওপর হামলার অভিযোগ তদন্ত করতে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে বলে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার সিপিজের এক টুইটে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিবিসি নিউজের প্রতিনিধি মিলন ত্রিপুরা ১৭ জুলাই একটি বিক্ষোভের সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে মারধর করেন ও ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ মুছে ফেলতে বাধ্য করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।