রাজশাহীতে যুবদল ও ছাত্রদলের দুই নেতার নামে এক আবাসন ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ, নির্যাতন, চাঁদা দাবি এবং ভয় দেখিয়ে ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্পে সই নেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলায় দুই নেতাসহ ৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে নাম উল্লেখ রয়েছে ৩৬ জনের।

গত বুধবার (২৩ জুলাই) দিবাগত রাতে নগরের বোয়ালিয়া থানায় মামলাটি হয়েছে। মামলার বাদীর নাম মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম গ্রীন প্লাজা রিয়েল এস্টেট লিমিটেড। এজাহারে প্রধান আসামি করা হয়েছে রাজশাহী জেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক মোজাদ্দেদ জামানী ওরফে সুমনকে (৪৮)। ২ নম্বর আসামি রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ ছাত্রদলের সদস্যসচিব এমদাদুল হক ওরফে লিমন (২৬)।

মামলার কথা শুনে ছাত্রদল নেতা এমদাদুল হক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, এর পেছনে কোনো ইন্ধনদাতা রয়েছে। মামলাটি ষড়যন্ত্রমূলক। তাঁরা শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে সব বলবেন। যুবদলের সাবেক নেতা মোজাদ্দেদ জামানীও মামলার প্রতিবাদে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছেন।

মামলার এজাহারে বাদী দাবি করেছেন, গত ১৭ মে রাত সাড়ে ৮টায় আসামিরা বাদীর কার্যালয়ে গিয়ে প্রথম দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এরপর ৩১ মে তাঁরা বিভিন্নভাবে চাঁদার দাবিতে ফোন দিয়ে বিভ্রান্ত করে ও ভয়ভীতি দেখান। ১৪ জুন ১ নম্বর আসামি মোজাদ্দেদ জামানী অজ্ঞাতনামা আসামির হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট থেকে ফোন করে হুমকি দেন। ব্যবসার অবস্থা ভালো না বলে তিনি (বাদী) এখন কোনো চাঁদা দিতে পারবেন না বলেন।

এজাহারে বলা হয়েছে, গত ৩০ জুন বেলা ৩টার সময় বোয়ালিয়া মডেল থানার সাহেব বাজার সোনাদিঘীর উত্তর পূর্ব কর্নারে বিএনপি কার্যালয়ের সামনের সড়কে এমদাদুল হক পিস্তল ঠেকিয়ে মোজাদ্দেদ জামানীর মোটরসাইকেলে উঠতে বাধ্য করেন ৩ নম্বর আসামি বিশাল রহমান (২৪) পেছনে বসে জাপটে ধরে রাখেন, যাতে তিনি পালাতে না পারেন। অন্য আসামিরা সামনে ও পেছন থেকে পাহারা দিয়ে বোয়ালিয়া থানার দরগাপাড়া এলাকায় মোজাদ্দেদ জামানীর বাড়ির নিচতলার টর্চার সেলে নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ–ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ রেখে নির্বিচার অসহনীয়ভাবে শারীরিক নির্যাতন করেন।

এজাহারে দাবি করা হয়েছে, তাঁকে পিস্তল ঠেকানোর কারণে প্রাণভয়ে ডাকচিৎকার করতে পারেননি। (যা ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পাওয়া যাবে)।
টর্চার সেলে বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত আটকে রেখে টাকা আনার জন্য লাঠি দিয়ে পিটুনি, লাথি, কিলঘুষি ও চড়-থাপ্পড় মারা হয় উল্লেখ করে এজাহারে বাদী আরও অভিযোগ করেছেন, তিনি রাজি না হলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ১০০ টাকা মূল্যের তিনটি পূরণ করা স্ট্যাম্প ও একটি ডামি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়। এ ছাড়া ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের একটি ফাঁকা চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। তাঁর পাসপোর্টও আসামিরা রেখে দিয়েছে বলে মামলায় দাবি করা হয়।

এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, একপর্যায়ে তাঁকে বোয়ালিয়া থানার মোড়ে এনে রাত ৯টার পর ছেড়ে দেয় এবং বলে যে ‘দেখ তোকে থানা মোড়ে ছাড়লাম পুলিশসহ কেউ আমাদের কিছু করতে পারল না এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। আর এই বিষয় নিয়ে কোনো সময় থানা–পুলিশ করলে তোকে জীবনে শেষ করে দিব।’

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রদল নেতা এমদাদুল হক এটিকে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দাবি করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা তাকে ইন্ধন দিচ্ছে, সে বিষয়টি খুঁজ বের করা হবে। শনিবার আমরা এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করব। সবার মুখোশ উন্মোচন করা হবে।’ তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘৫ আগস্ট–পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে মোস্তাফিজুর রহমান নামের একজন প্রতারক কোন সাহসে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে নির্বিচার বিএনপির এতগুলো নেতা–কর্মীর নামে মামলা করেছেন!’ তিনি বলেন, একটি ফ্ল্যাট কেনাবেচা নিয়ে থানার ওসির সামনে একটি মীমাংসা বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকের তিনি একজন প্রতিনিধি মাত্র। বিষয়টা মীমাংসাও হয়ে গেছে। অথচ সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি এই চাঁদাবাজির মামলা করেছেন।

এমদাদুল হক বলেন, ‘এই মোস্তাফিজুর রহমান হচ্ছে স্বৈরাচারের দোসর। খায়রুজ্জামান লিটন (সাবেক সিটি মেয়র) ভাইয়ের স্ত্রী রেনী ভাবির ছেলেখ্যাত এই প্রতারক বিভিন্ন মানুষের কাছে একই ফ্ল্যাট কয়েকবার বিক্রি করেছে। এখন তাদের রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য তিনি এই মামলা করেছেন।’

জেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক মোজাদ্দেদ জামানীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে বলেছেন, ‘রাজশাহী চিহ্নিত প্রতারক টাউট–বাটপার, ফ্যাসিস্ট পতিত আওয়ামী লীগের চিহ্নিত এজেন্ট, গ্রীন প্লাজা ডেভেলপার কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো.

মোস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের ও হয়রানির প্রতিবাদে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।’ শনিবার বেলা ১১টায় নগরের মালোপাড়ায় মহানগর বিএনপি কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাঁর কাছে মামলার সপক্ষে সব ধরনের প্রমাণপত্র রয়েছে। বোয়ালিয়া থানায় সালিসের ব্যাপারে তিনি বলেন, পরে তাদের কথামতো থানায় বসে কাগজে সই করা হয়েছে। তারও ভিডিও তাঁর কাছে রয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের দোসর প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে চেম্বারে ছিলেন। মেয়র হিসেবে তাঁর সঙ্গে তাঁকে সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হয়েছে, এর বেশি কিছু নয়।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগরের বোয়ালিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহাদত হোসেন। মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলা রেকর্ড হওয়ার দিনে তিনি সাক্ষী দিতে বাইরে ছিলেন। আবার প্রশিক্ষণে যাচ্ছেন। ফিরবেন আগস্ট মাসের শুরুতে। এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেন না। তিনি বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন।

এ বিষয়ে আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় বোয়ালিয়া থানার ওসি মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা তো ট্রেনিংয়ে গেছে। ফিরে এসে ওই তদন্ত করবে। তাছাড়া আমরা তো আছি, দেখি।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম স ত ফ জ র রহম ন ছ ত রদল ন ত কর র জন য আস ম র কর ছ ন ব এনপ য বদল ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে ‘অপহরণ’, ফেনী থেকে মিলল কাস্টমস কর্মকর্তার লাশ

২০১৯ সালের ৭ মে চট্টগ্রাম থেকে ‘অপহৃত’ হয়েছিলেন কাস্টমস কর্মকর্তা আবদুল আহাদ (৪৬)। এরপর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবারের দাবি, আবদুল আহাদের মুক্তির জন্য অপহরণকারীদের মুক্তিপণও দিয়েছিল তারা। তবে ফেরত পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত ছয় বছর পর গতকাল বুধবার আহাদের মরদেহ মিলেছে ফেনীতে।

পুলিশ জানায়, গতকাল দুপুরে ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে থেকে আহাদের মরদেহ উদ্ধার হয়। পুলিশের ধারণা ছিল, আহাদ দিনমজুরের কাজ করেন। তবে তাঁর পকেটে থাকা একটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব নম্বর থেকে আসল পরিচয় পাওয়া যায়। এরপর পরিচয় নিশ্চিত হয়ে পুলিশ পরিবারকে খবর দেয়।

নিহত ব্যক্তির পরিবার সূত্র জানায়, আবদুল আহাদ মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানার ভূইগাঁও ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের মো. ইমানি মিয়ার ছেলে। তাঁর স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তান রয়েছে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে তিনি প্রথমে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শেষে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যোগ দেন। সেখান থেকে তিনি নিখোঁজ হন।

নিহত আহাদের ছোট বোন নাঈমা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই চট্টগ্রামে একাই থাকতেন। সেখান থেকেই নিখোঁজ হন। ২০১৯ সালের ৭ মে ভোরে তাঁর ভাবিকে মুঠোফোনে জানানো হয় ভাইকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণকারীদের তাঁর ভাবি মুক্তিপণ হিসেবে দুই লাখ টাকাও দেন। তবে তাঁর ভাইকে ফেরত পাওয়া যায়নি।

নাঈমা নাসরিন দাবি করেন, তাঁর ভাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। তবে দলীয় কোনো পদে ছিলেন না। তাঁর ভাইকে কেন অপহরণ করা হয়েছে, কেন গুম করা হয়েছে তাঁরা জানেন না। এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তাঁরা।

লাশ ফেনীতে কীভাবে এল, জানে না পুলিশ

নিহত আবদুল আহাদের ফেনীর ছাগলনাইয়া কীভাবে এসেছে, তা আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি এত দিন আহাদ কোথায় ছিলেন, এর কোনো ব্যাখ্যাও তাঁরা দিতে পারেনি। পুলিশের দাবি, আহাদের শরীরে কোনো ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত কোনো কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে তাদের প্রাথমিক ধারণা।

নিহত আহাদের ভাগনে মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অপহরণের ঘটনার পর তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন। সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। তবে তাঁর মামার সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তি চান।

জানতে চাইলে ছাগলনাইয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহ আলম বলেন, নিহত কাস্টম কর্মকর্তার ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পেলে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।

ছাগলনাইয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবুল বাশার বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে ছয় বছর আগে অপহরণের যে বিষয়টি জানানো হচ্ছে, সে বিষয়ে পুলিশ খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। প্রাথমিকভাবে এটিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা তাঁরা নেবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সাতক্ষীরায় ৮ দিনেও খোঁজ মেলেনি অপহৃত কিশোরীর
  • ছয় বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে ‘অপহরণ’, ফেনী থেকে মিলল কাস্টমস কর্মকর্তার লাশ