সুন্দরবনের কেয়াখালী এলাকা থেকে হরিণ শিকারের জন্য পাতা ৬০০ ফাঁদ উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের কেয়াখালীর খাল এলাকা থেকে এসব উদ্ধার করেন বনরক্ষীরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হরিণ শিকারের উদ্দেশ্যে চোরাশিকারিরা কেয়াখালীর খালের পাশে বিশেষ কৌশলে এসব ফাঁদ পেতে রেখেছিলেন। টহল দলের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁরা পালিয়ে বনের গহিনে ঢোকেন। পরে সেখান থেকে ৬০০টি ফাঁদ উদ্ধার করা হয়।

সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, সারা বছর হাজার হাজার বনজীবী সুন্দরবন থেকে মাছ, কাঁকড়াসহ গোলপাতা ও মধু আহরণ করেন। তাই সুন্দরবনের বিশ্রাম দেওয়ার মাধ্যমে সেখানকার প্রকৃতি-প্রতিবেশসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছর সুন্দরবনে ঢোকা ও সম্পদ আহরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। তার অংশ হিসেবে চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাস জেলে ও বাওয়ালির পাশাপাশি পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময় সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে কেউ যাতে কোনো ধরনের সম্পদ আহরণ করতে না পারেন, তাই এই বিশেষ টহলের ব্যবস্থা।

বুড়িগোয়ালিনী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জানান, সুন্দরবন ও সুন্দরবনের সম্পদ রক্ষায় টহল জোরদার করা হয়েছে। হরিণ শিকারের বিরুদ্ধে তাঁদের কঠোর অবস্থান রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশের পর উদ্ধার করা ফাঁদগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র

এছাড়াও পড়ুন:

আত্মসমর্পণকারীরা দস্যুতায় ফিরছে , ‘দুলাভাই বাহিনী’সহ ১৪ দল সক্রিয়

চোখ মুছছিলেন ফয়েজ আলী (ছদ্মনাম)। বললেন, ‘ছেলেকে ফিরে পেয়ে মনে হলো আমি আবার জন্ম নিলাম।’ কয়রার এই বৃদ্ধের মুখে স্বস্তির সঙ্গে আতঙ্কের ছাপ। ডাকাতেরা বলেছিল, ৩০ হাজার টাকা না দিলে ঘরে ফিরবে ছেলের লাশ।

গত ১৮ আগস্ট গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাকবাড়িয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ‍বাবা বলেন, ‘অনেক কষ্টে ধারদেনা করে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করে ছেলেকে ফিরিয়েছি।’ তাঁর ছেলে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে আটক ছিলেন তিন দিন। ঠিকমতো খাওয়া জুটত না, দিনরাত ডাকাতদের নৌকা বাইতে হতো।

ছেলেকে জিম্মি করেছিল ‘দুলাভাই বাহিনী’র ডাকাতেরা। ডাকাত দলের এই নাম কোনো তামাশার বিষয় নয়। এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়, নির্যাতন আর মুক্তিপণের আতঙ্ক।

একসময় সুন্দরবনের ত্রাস ছিল ‘ইলিয়াস বাহিনী’, বঙ্গোপসাগর থেকে সুন্দরবনের গভীর পর্যন্ত ছিল তার দাপট। ইলিয়াস আত্মসমর্পণ করেন, ইতিমধ্যে মারাও গেছেন। গত বছরের আগস্টে ইলিয়াসের বোনের স্বামী রবিউল নতুন দল গড়ে তুললে স্থানীয় লোকজন এর নাম দেন ‘দুলাভাই বাহিনী’।

ছেলেকে জিম্মি করেছিল ‘দুলাভাই বাহিনী’র ডাকাতেরা। ডাকাত দলের এই নাম কোনো তামাশার বিষয় নয়। এর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়, নির্যাতন আর মুক্তিপণের আতঙ্ক।

২০১৮ সালের নভেম্বরে ৩২টি দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, গত বছর সরকার পতনের ডামাডোলের সুযোগে দুলাভাই বাহিনীসহ সুন্দরবনে আবার সক্রিয় হয়েছে অন্তত ১৪টি দস্যুদল। তারা নিয়মিত অস্ত্রের মুখে বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। আত্মসমর্পণকারীদের অন্তত ১১ জন আবারও দস্যুতায় ফিরেছেন।

এ কাজে দস্যুদের পৃষ্ঠপোষক উপকূলের প্রভাবশালী একশ্রেণির মাছ ব্যবসায়ী, যাঁরা এলাকায় ‘কোম্পানি মহাজন’ নামে পরিচিত। তাঁদের নির্দেশে জেলেরা নদীতে বিষ ছিটিয়ে মাছ ধরেন। তাঁরাই দস্যুদের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে দেন, প্রায় সময় মুক্তিপণও পাঠান। এতে দস্যুদের হাতে যায় টাকার জোগান, অস্ত্রের মজুত আর বিষে নষ্ট হয় সুন্দরবনের পরিবেশ।

আরও পড়ুনসুন্দরবনের নতুন হুমকি বনদস্যু নাকি মহাজন০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সুন্দরবনে দস্যুতা ফেরার বিষয়ে গত জুলাই থেকে অনুসন্ধান শুরু করে প্রথম আলো। অনুসন্ধানে নেমে কথা বলেছি বনজীবী, আত্মসমর্পণকারী সাবেক দস্যু ও গোপনে দস্যুতায় জড়ানো ব্যক্তিদের সঙ্গে। তাঁদের বয়ানে উঠে এসেছে ডাকাতদের সংগঠিত গোপন জীবন, নদীর ভেতর ভাসমান ঘাঁটি আর নৌকায় বন্দী অসহায় মানুষের গল্প।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, গত বছর সরকার পতনের ডামাডোলের সুযোগে দুলাভাই বাহিনীসহ সুন্দরবনে আবার সক্রিয় হয়েছে অন্তত ১৪টি দস্যুদল। তারা নিয়মিত অস্ত্রের মুখে বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে। আত্মসমর্পণকারীদের অন্তত ১১ জন আবারও দস্যুতায় ফিরেছেন।জিম্মি জেলে ও বনজীবীরা

ফয়েজ আলীর ছেলে সুন্দরবনের পাটাকাটা এলাকা থেকে ডাকাতের ফাঁদে পড়ে যান। বনের খালে কাঁকড়া ধরার সময় তিনি হঠাৎ দেখেন, পাঁচটি নৌকায় অস্ত্রশস্ত্রধারী বনদস্যুরা ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগোচ্ছে। ভয়ে নৌকা বেয়ে খালের মধ্য দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হয়নি। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি হেঁটে দস্যুরা তাঁকে ঘিরে ফেলেছিল।

গত ৩১ জুলাই কয়রা উপজেলার একটি বাজারে গিয়ে শুনি, স্থানীয় দরিদ্র বনজীবী জহিরুল ইসলাম (নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে ছদ্মনাম দেওয়া হলো) চার দিন ধরে বনদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে আছেন। তাঁর মেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমরা গরিব, বনে না গেলে খাবার চলে না। জিম্মির বিষয়ে কাউকে জানালে ডাকাতেরা আব্বাকে মেরে ফেলতে পারে। তাই পরিচিতদের কাছেই সাহায্য চাইছি।’

ধারকর্জ করে ২০ হাজার টাকা জুটিয়ে মুক্তিপণ দিয়ে গত ২ আগস্ট বাড়ি ফেরেন জহিরুল। পরদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করি। তাঁর কণ্ঠে তখনো ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের জোলাখালী খালে ঢুকতেই দুলাভাই বাহিনীর ১১ ডাকাত তিনটি নৌকা নিয়ে ঘিরে ধরে, সবার হাতে ছিল বন্দুক। এক সপ্তাহ ধরে আটকে ছিলাম, দিনে একবার খেতে দিত, বাকি সময় নৌকা বাইতে বাধ্য করত।’

ডাকাতেরা তাঁর কাছে ৩০ হাজার টাকা চেয়েছিল। অনেক অনুনয়ের পর ২০ হাজার টাকায় রাজি হয় এবং শর্ত দেয়, পরেরবার বনে ঢুকলে বাকি ১০ হাজার টাকা দিতে হবে।

মধু সংগ্রহে যাওয়া মৌয়াল ও গোলপাতা কাটতে যাওয়া বাওয়ালিদেরও ডাকাতদের মুক্তিপণ দিতে হচ্ছে। কয়রার একটি গ্রামের একজন মৌয়াল বলেন, সুন্দরবনের জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের সঙ্গে এখন ডাকাতেরও ভয়। তাঁদের নৌকার সাতজন মৌয়াল ডাকাত দলের হাতে ধরা পড়লে ৫২ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ডাকাতমুক্ত না হলে আগামী মধু আহরণ মৌসুমে বনে যাবেন না।

আমরা গরিব, বনে না গেলে খাবার চলে না। জিম্মির বিষয়ে কাউকে জানালে ডাকাতেরা আব্বাকে মেরে ফেলতে পারে। তাই পরিচিতদের কাছেই সাহায্য চাইছি।বনজীবী জহিরুল ইসলামের মেয়ে সুন্দরবনে ডাকাত শরীফ বাহিনীর কাছ থেকে জিম্মি জেলেদের উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। গত ১০ এপ্রিল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবন এলাকার উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় দাবি
  • সুন্দরবন ভ্রমণে এসে বিদেশি পর্যটকের মৃত্যু
  • সুন্দরবনে বিদেশি নারী পর্যটকের মৃত্যু
  • বাংলাদেশের আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা আনতে ৮টি পরামর্শ দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর
  • আত্মসমর্পণকারীরা দস্যুতায় ফিরছে , ‘দুলাভাই বাহিনী’সহ ১৪ দল সক্রিয়