এরকম ঘটনা ঘটতে পারে ধারণা করেছিলাম, কিন্তু এমন বীভৎসভাবে ঘটবে, এটা অনুমান করতে পারিনি। ভার্সিটিতে কনসার্ট হবে। বন্যার্তদের সহযোগিতার জন্য কনসার্ট। ওপেন ফর অল। আয়োজন করেছে ‘স্কাই ইজ নো লিমিট’ নামে ভার্সিটির এক কালচারাল ক্লাব। কনসার্টে ব্যান্ড দল আসবে। ব্যান্ডের নাম ‘এলেবেলে’। তারাই মূল আকর্ষণ। নিতা নামের এক ব্যান্ডশিল্পী এলেবেলে ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট। তার সব গান মেটাল টিউনে গাওয়া। গানের কথা সবটা বোঝা না গেলেও গানের মিউজিক আর নিতার নাচে পুরো অডিয়েন্স উন্মাতাল হয়ে যায়।
এলেবেলে ব্যান্ড দল স্টেজে পারফর্ম করার আগে ভার্সিটির ছেলেমেয়েদের গানের আয়োজন করেছে স্কাই ইজ নো লিমিট। সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেখানে ভার্সিটির পরিচিত কোনো গানের শিল্পী গান গাইবে না। গাইবে অপরিচিত শিল্পী। অডিশনের জন্য যোগাযোগ করতে বলে পোস্টার লাগিয়েছে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
অডিটরিয়ামের সামনে খোলা জায়গা। জনাপাঁচেক ছেলেমেয়ে সেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসে আছে। তারা চা খাচ্ছে। এখানেই গানের অডিশন হওয়ার কথা। আশপাশে সে রকম কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আমি গিয়েছিলাম গিটারের স্ট্রিংয়ের খোঁজে। গত রাতে কেউ একজন আমার গিটারের স্ট্রিং ছিঁড়ে ফেলেছে।
অডিটরিয়ামের খোলা জায়গায় বসে যারা চা খাচ্ছে, তাদের মধ্যে যে মেয়েটি কালো ড্রেস পরে আছে, সে এগিয়ে এল। ভরাট গলায় বলল, ‘অডিশন দিতে এসেছেন?’
ওপর–নিচ মাথা ঝাঁকালাম, ‘আমি গানের অডিশন দিতে এসেছি।’
মেয়েটি পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘আদি, গান শুনবি ওর?’
আদি বলে যে ছেলেকে ডেকেছে, সে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফ্লোরে কাপ নামিয়ে রাখল। চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন সেমিস্টার?’
বললাম, ‘সেকেন্ড সেমিস্টার।’
‘কোন ডিপার্টমেন্ট?’
‘কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ।’
পাশ থেকে একজন আচমকা ‘তুই’ করে কথা বলল। আমার ভালো লাগেনি। কিছু বললাম না। ছেলেটা বলল, ‘গান গাইতে পারিস নাকি গিটার নিয়ে মেয়েদের ইমপ্রেস করার জন্য ফ্লেক্স মারিস!’
আদি নামের ছেলেটা বলল, ‘কাম অন, অভ্র। লেট হিম কুক ফার্স্ট। গানটা আগে গাইতে দে।’
আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী নাম তোমার?’
নাম বললাম, ‘তিহান।’
বলল, ‘তিহান শোনো, তুমি আসতে অনেক লেট করেছ। আধা ঘণ্টা আগে আমরা কাজ শেষ করে ফেলেছি। চা খেয়ে চলে যাচ্ছিলাম।’
কালো ড্রেস পরা মেয়েটি বলল, ‘এসেই যখন পড়েছে, গান শোনাক। চলে তো আমরা যাইনি।’
অভ্র দুবার কাশি দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, ‘মিতি যখন বলেছে, আদি আর সে কথা ফেলে কীভাবে!’
আমাকে গান গাইতে বলা হলো। আমি লালনের গান গাইলাম, ‘লালন বলে জাতের কী রূপ, দেখলাম না এই নজরে।’
অভ্র অদ্ভুত শব্দ করে হেসে বলল, ‘গানটা পুরাই স্কিবিড।’
স্কিবিড মানে আমি জানি—হাস্যকর। লালনের গান কেন তার কাছে হাস্যকর মনে হলো, বুঝতে পারলাম না। নাকি আমি গাইতে পারিনি ঠিকমতো! চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম।
মিতি বলল, ‘হি হ্যাজ দ্য রিজ। তার গলায় ক্যারিশমা আছে, সেটা অস্বীকার করতে পারবি না।’
অভ্র ঘাড় কাত করে মিতির মুখের কাছে চোখ ঝুলিয়ে বলল, ‘সাস লাগতেছে, বাহ্। ঘটনা কী?’
সাস লাগা শব্দটাও আমার পরিচিত। সাসপেক্ট আর সাসপিশিয়াস মিলিয়ে বানানো।
আদি বলল, ‘তুমি আমাদের কনসার্টে গাইবে।’
অভ্র ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, ‘ওকে পুকি, গাইবে।’
কনসার্ট শুরু হয়েছে। আগের চারজন চলতি মুভির চটুল গান গেয়ে অডিয়েন্সকে অস্থির করে দিয়েছে। স্টেজে উঠে হট্টগোলের ভেতর পড়ে গেলাম। এলেবেলে ব্যান্ড দল চলে এসেছে। সবাই নিশ্চিত হতে চাইছে, নিতা এসেছে কি না। স্টেজের দিকে কারও মনোযোগ নেই। অভ্র চিৎকার করছে, ‘কী রে, গান গা। তুই চুপ করে আছিস কেন? তোর গান তুই গেয়ে যা। নাকি নিতার সাথে নেচে নেচে গাইবি?’
গান শুরু করলাম। আমার লেখা গান। সুর নিজে করেছি। ‘মানুষ বাঁচাও, বাঁচাও মানুষ। মানুষ কাঁদছে খুবই।’
খেয়াল করলাম সামনের দর্শক শ্রোতা অমনি শান্ত হয়ে এসেছে। ফোক সুরের গান। বি ফ্ল্যাটে ধরে সি শার্পে উঠে গেছি। ইচ্ছা করে করেছি। হইচইয়ের ভেতর এমন না করে আর কিছু করার ছিল না। আমার ভোকালের জন্য হোক আর বন্যায় যে মানুষ ডুবছে, সে জন্য হোক, সবাই আমার গানের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। এবার শান্তভাবে গাইলাম, ‘মানুষ বাঁচাও, বাঁচাও মানুষ। মানুষ কাঁদছে খুবই।’
শান্ত হয়ে এসেছে সবাই। গান ধরে এগিয়ে গেলাম, ‘রাতের ভোটে দেশ ডুবেছে, হারিয়েছি সবই। মেরুদণ্ড হারিয়ে গেছে, হারিয়েছি কথা।’
এ পর্যন্ত গাইতে পেরেছি। তখুনি শুনলাম দর্শক-শ্রোতাদের ভেতর থেকে কয়েকজন চিৎকার করে ছুটে আসছে। তাদের হাতে লাঠি। তারা কেন লাঠি নিয়ে কনসার্টে এসেছে, জানি না। চিৎকার করছে, ‘মার শালাকে, শালা রাজাকার। ছুপা রুস্তম।’
উন্মত্ত ছেলেরা স্টেজে উঠে পড়েছে। তারা আমার হাত থেকে গিটার কেড়ে নিয়েছে। লাথি দিয়ে মাইক্রোফোন ফেলে দিয়েছে। সামনে দর্শক-শ্রোতাদের ভেতর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। আমাকে ধরে সবাই পেটাচ্ছে। এলোপাতাড়ি কিল–ঘুষি মেরে যাচ্ছে আমার গালে, চোখে–মুখে, পেটে। আমি মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছি। কেউ আমার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। আরেকবার কাঁধে মেরেছে জোরে লাঠি দিয়ে।
মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ করছে। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। মিছিলের আওয়াজ আসছে। কয়েকজন স্লোগান দিচ্ছে, ‘সব অন্যায়ের প্রতিকার, ছাত্রলীগের অঙ্গীকার। ছাত্রলীগ দিচ্ছে ডাক, সন্ত্রাস নিপাত যাক।’
আমার ভাগ্য ভালো। আমাকে মেরে ফেলেনি। আমার জ্ঞান ফিরেছে ভার্সিটির মেডিকেল সেন্টারে। পরে সেখান থেকে আমাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। এখন সুস্থ। শুধু গিটার ফেরত পাইনি।
মিতির সঙ্গে আমার আবার দেখা হলো এক বৃহস্পতিবার বিকেলে, ভার্সিটির ক্যাফেতে। মিতিকে আমার আলাদাভাবে মনে ছিল না। সেই অডিশনের পর আর দেখা হয়নি। দুপুর থেকে আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে। ঘনকালো মেঘ। কয়েক দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। জোর বৃষ্টি। তবে গতকাল আর আজ এখনো বৃষ্টি হয়নি। রাতে ঝুম বৃষ্টি হবে, মনে হচ্ছে।
রুম থেকে বের হয়েছি। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতে ক্যাফেতে চলে এলাম। সম্ভবত আকাশের ভাব দেখে ক্যাম্পাস থেকে সবাই হলে ফিরে গেছে। ক্যাফে মোটামুটি ফাঁকা। কোনার দিকে দুজন বসা যায়, এমন ছোট্ট একটা টেবিলের ওপাশে গিয়ে বসে পড়লাম।
বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশভাঙা বৃষ্টি। ছেলেমেয়েরা ছুটে ক্যাফেতে ঢুকছে। জামাকাপড় ভিজিয়ে ছুটতে ছুটতে মিতি এসে ঢুকল ক্যাফেতে। তাকে চিনতে পেরেছি। চিনতে পারার কারণ হতে পারে মিতি আজও সেই কালো ড্রেসটা পরে আছে। প্রবল ঝড়বৃষ্টি আর হুড়োহুড়ির ভেতর আমার মাথায় সম্পূর্ণ অন্য রকম অদ্ভুত ভাবনা এল। এটা বুঝি আমার সঙ্গে মিতির দেখা হওয়ার ড্রেস! মনে হলো, যদি আমার দেখা করার কেউ থাকত, তাহলে প্রতিবার আমি একই রঙের শার্ট পরে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। হতে পারে সেটা সাদা কিংবা কালো। ধরা যাক কালো। আমার অনেকগুলো কালো শার্ট থাকত। প্রতিবার তার সঙ্গে কালো শার্ট পরে দেখা করতে যেতাম। হয়তো সে অবাক হয়ে বলত, ‘আচ্ছা, তোমার কি এই একটাই শার্ট?’
হেসে বলতাম, ‘একটাই রং। তোমার জন্য। তোমার কাছে আমি রং বদলাই না!’
আচ্ছা, তখন সেই মেয়ের মুখের চেহারা কেমন হতো!
মিতি সম্ভবত ক্যাফের বারান্দায় ছিল। বৃষ্টি শুরু হতেই ঢুকে পড়েছে। মনে হয় সঙ্গে আর কেউ নেই। সে–ও কোনো কর্নারে গিয়ে বসার কথা ভাবছিল। এগিয়ে এসে সামনের চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ল।
ক্যাফে ভরে উঠেছে। ঝড় শুরু হয়েছে। দুপুরবেলাতেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জোরে জোরে মেঘ ডাকছে।
মিতি বলল, ‘তিহান, হোয়াটস আপ? কখন আসছ?’
মিতি এমনভাবে কথা বলছে, যেন আমরা কত দিনের পরিচিত। প্রায় প্রতিদিন আমাদের দেখা হচ্ছে। তবে তার গলায় নিখাদ আন্তরিকতা মেশানো।
বললাম, ‘বেশ কিছুক্ষণ।’
মিতি চারদিকে তাকিয়ে আর কাউকে খুঁজছে মনে হলো। আস্তে সুরে বললাম, ‘তোমার ক্লাস ছিল, মিতি?’
মনে হলো মিতি চমকে গেছে। তার চোখে বিস্ময়। হতবাক গলায় বলল, ‘তুমি আমার নাম জানো!’
‘জানি বলেই তো বললাম।’
‘সাবজেক্ট, সেমিস্টার?’
‘জানি না।’
‘তোমার সাথে। সেকেন্ড সেমিস্টার। সাবজেক্ট তোমার অ্যাসাইনমেন্ট। খুঁজে বাইর করবা।’
মিতির সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে। বেশ স্বতঃস্ফূর্ত আর প্রাণবন্ত মেয়ে। কথায় আদর মেশানো আছে। বৃষ্টি যেমন হুড়মুড় করে শুরু হয়েছিল, সে রকম হুট করে বন্ধ হয়ে গেল। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে সাধারণত একটানা বৃষ্টি হয়। হুট করে বন্ধ হয়ে যায় না। আষাঢ় শেষ হয়ে শ্রাবণ মাস শুরু হয়েছে। তবে এখন বৃষ্টি ছেড়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ক্যাফে আবার ফাঁকা হয়ে গেছে।
মিতি বলল, ‘চা খাই। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। চা খাইতে খাইতে বলি।’
আমার সঙ্গে মিতির জরুরি কী কথা থাকতে পারে, অনুমান করতে পারলাম না। চায়ের ব্যবস্থা মিতি করে ফেলেছে। সঙ্গে পাকোড়া।
চায়ে চুমুক দিয়ে মিতি বলল, ‘তোমার কাছে আমাদের সরি বলতে যাওয়া উচিত ছিল। আমরা সরি। সেদিন কনসার্টে এমন কিছু হইতে পারে, আমরা ভাবতেও পারি নাই। তা ছাড়া আমরা ভাবছিলাম, তুমি লালনের গান গাবে। তুমি যে চান্স পাইয়া এইরাম বাউন্ডারি হাঁকবা, বুঝি নাই। রিহার্সালেও তো এই গান গাও নাই। আজিব ছেলে তুমি ব্রো। আমরা তো পুরাই টাশকি। মুহূর্তে সব আউলাইয়া দিলা।’
বৃষ্টির ভেতর গরম চা যত ভালো লাগবে ভেবেছিলাম, তত ভালো লাগছে না। আবার এমনও হতে পারে, পাকোড়া খেতে ভালো হয়নি। তাই পাকোড়াতে কামড় দিয়ে চায়ে চুমুক দিয়েছি বলে চা তেতো লাগছে।
মিতি বলল, ‘চা ঠান্ডা হইতেছে।’
বললাম, ‘ভালো লাগছে না। মনে হয় জ্বর আসবে।’
মিতি উঠে এসে কপালে হাত ছোঁয়াল। মিতির হাত ঠান্ডা। অসম্ভব ঠান্ডা। যেন হিমশীতল পানিতে হাত চুবিয়ে এসেছে। ভালো লাগছে। মাথায় যন্ত্রণা করছিল। চাপ বোধ হচ্ছিল। এখন আর মাথার ভেতর চাপ নেই। আমার ভীষণ ইচ্ছা করছে, মিতি আরও অনেকক্ষণ আমার কপাল ছুঁয়ে থাকুক। আমার জ্বর আসুক। প্রবল জ্বর।
কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মিতি বলল, ‘কিচ্ছু হয় নাই। জ্বর নাই। শোনো, আদির সঙ্গে কথা বলব নে। আমাদের ক্লাব, স্কাই ইজ নো লিমিট থেকা তোমার জন্যে গিটারের ব্যবস্থা করা হবে। উঠতেছি। চায়ের বিল আমার। তুমি আবার দিতে যাইয়ো না।’
মিতি উঠে চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে যেন কিছুই নিয়ে যাচ্ছে না সঙ্গে করে। কিন্তু রেখে গেছে অনেক কিছু। কী রেখে গেছে মিতি, বুঝতে পারছি না। মাথা ঝিমঝিম করছে। মিতি যা-ই বলুক। বুঝতে পারছি জ্বর আসছে। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসবে রাত আসার আগেই।
গিটার নিয়ে আসার পঞ্চম দিনে সরকারবিরোধী গান গাওয়ার অপরাধে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে গেল। অথচ তখন গান গাইছিলাম না। ক্যাম্পাসের বাইরে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। তিনজন ছেলে ঢুকল চায়ের দোকানে। তাদের দুজনের হাত পেছনে আর একজনের হাত পকেটে। ভার্সিটিতে এসে এসবের অর্থ শিখেছি। কোমরের পেছন দিকে গোঁজা থাকে। চাহিবামাত্র কোমরে গুঁজে রাখা অস্ত্র টান দিয়ে বের করে ফায়ার করতে পারে। পকেটেও রাখে।
অমনি দুজন আমাকে মারতে শুরু করল। নাটকের মতো সবকিছু যেন গোছানো ছিল। তক্ষুনি পুলিশ চলে এল। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।
আমাকে পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে এসেছে সকালে। মিতি এল দুপুরের পর। সে একা আসেনি। প্রক্টর স্যারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। প্রক্টর স্যার ওসির সঙ্গে কথা বললেন। ওসি আমাকে মুচলেকা লিখতে বললেন, ‘আমি কোনো দিন দেশবিরোধী কোনো গান গাইব না। যদি গাই, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে আমার বিচার হবে।’
থানা থেকে ছাড়া পেতে সময় লাগল। প্রক্টর স্যার চলে গেলেন। মিতি থাকল।
রাস্তার পাশ ধরে আমরা দুজন হাঁটছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। যেন আমাদের কোনো কথা নেই। কিংবা আমাদের বলার অনেক কথা আছে। সেসব উচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। নিঃশব্দতা অনেক কথা বলে যায়।
মিতি বলল, ‘অ্যাই তিহান, তুমি কি জানো আমি কবিতা লিখি? আমার লেখা কবিতার দুটো বই আছে?’
এ ঘটনা আমার জানা নেই। মনে হচ্ছে, জানা উচিত ছিল। মিতি বুঝতে পেরেছে। বলল, ‘এত অ্যামব্যারাসড হওয়ার কিছু নাই। কলেজে পড়ার সময় সবাই কবি হয়ে যায়। তুমিও হইছিলা। গান লিখতা। কলেজেই ছেলেমেয়েরা একবার হলেও প্রেমে পড়ে। প্রেম ভেঙে যায়। তখন কারও কাব্য প্রতিভা হারায়ে যায়, কারও তুঙ্গে ওঠে।’
আমার ক্লান্তি কেটে গেছে। ঝরঝরা বোধ হচ্ছে। হাসলাম। হেসে বললাম, ‘তোমার প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর তোমার কাব্যপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটল!’
মিতি হাসছে। হাসলে তাকে এমন অপূর্ব লাগে, আগে খেয়াল করিনি। মিতির পরনে আজ হলুদের সঙ্গে হালকা সবুজের কম্বিনেশনের ড্রেস। খানিকটা শর্ষেখেতের মতো দেখাচ্ছে। ভোরবেলা হলুদ শর্ষেখেতে নরম সোনামাখা রোদ পড়লে যেমন দেখা যায়, সে রকম। হাসিমুখে মিতি বলল, ‘ভীষণ ডানপিটে ছিলাম। মারকুটে টাইপ। ছেলেরা খুব ভয় পাইত। আই লাভ ইউ বলার সাহসই ছিল না। কাব্যপ্রতিভা নিজে থেকেই লেগে আছে। কবিতা আমার প্রেম।’
সেই বছর, সেই চব্বিশে আমাদের জীবনে জুলাই-আগস্ট এসেছিল। ছাত্র-জনতার উত্তাল গণ-আন্দোলনের সময়। ফ্যাসিবাদ হটানোর আন্দোলন। সেদিন অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কিশোর, তরুণ, জনতা সবাই লাল পোশাক পরে নেমে এসেছে রাস্তায়। মিতিকে দেখে চমকে গেছি। কেন জানি প্রথমেই মনে হলো আজ আমরা মৃত্যুকে বরণ করতে এসেছি। লাল অনেক দূর থেকে দেখা যায়। ভিড়ের ভেতর কানের কাছে মুখ নিয়ে মিতিকে বললাম, ‘আজ পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করবে। না হয় গুলি করবে।’
মিতি বলল, ‘তোমার মরতে ভয় লাগছে?’
বললাম, ‘না তো!’
মিতি বলল, ‘আজ তবে আমরা একসঙ্গে মারা যাব।’
আমরা মিছিলে হাঁটলাম। পায়ে পায়ে, গানে গানে। তক্ষুনি দেখলাম, মিনিট্রাকে চড়ে স্কাই ইজ নো লিমিট ক্লাবের ছেলেমেয়েরা আসছে। আদি-অভ্রও আছে। তারা গান গাইছে। স্কাই ইজ নো লিমিট ক্লাবের কালচারাল উইং খুব স্ট্রং। তারা সবাই দুর্দান্ত ভালো গান গায়। তারাও গাইছে মিতির লেখা গান, ‘নতুন সূর্য উঠবে দেখো, ফ্যাসিবাদের শেষ। হঠাও ফ্যাসিস্ট, বাঁচাও দেশ, আমার বাংলাদেশ.
সেদিন পুলিশ গুলি করে পুরো শহর তছনছ করে দিল। পুলিশের গুলি থেকে শিশু–কিশোরও রেহাই পায়নি। পুলিশ তাদেরও গুলি করে মেরে ফেলেছে।
৫ আগস্ট ২০২৪। ২১ শ্রাবণ ১৪৩১। সোমবার। সরকারপ্রধান দলের নেতা-কর্মীদের রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল। সরকারি দলের সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। ফ্যাসিস্টমুক্ত দেশে স্কাই ইজ নো লিমিট ক্লাবের কালচারাল উইংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গান গেয়ে পুরো শহর ঘুরলাম। মিতির লেখা নতুন গান, ‘বিজয়ের এ গান মোদের, শান্তির পাখি উড়বে চিরকাল।’
মিতি এসে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। গিটার থেকে এক হাত নামিয়ে মিতির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। মিতি আলতোভাবে আমার হাত ধরেছে। তবে ধরে রাখল শক্ত করে। আমরা আকাশের দিকে তাকালাম। শ্রাবণ মাসের আকাশ। কালো মেঘে ঢেকে থাকার কথা। আকাশ হয়ে আছে ঝকঝকে নীল। সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক টিয়া পাখি ট্যাট ট্যাট ট্যাট ট্যা আওয়াজ করে উড়ে গেল। মনে হচ্ছে, অনেক দিন তারা যেন আটকা ছিল। আজ মুক্ত হয়ে আনন্দে ডাকতে ডাকতে ডানা নাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে নিজের ইচ্ছেমতো।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক ই ইজ ন কনস র ট আম র গ আম দ র আম র জ র জন য পর চ ত র ভ তর এল ব ল আম র ভ বলল ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘হিলি বন্দরের অব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখা হবে’
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, “হিলি পোর্টে কিছু অব্যবস্থাপনা রয়েছে। চেয়ারম্যানকে বলেছি, বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে। ২৪টি পোর্টের মধ্যে চারটি পোর্ট বন্ধ করা হয়েছে। অনেক পোর্ট রয়েছে, যেখান থেকে তেমন রাজস্ব আদায় হয় না।”
শনিবার (৯ আগস্ট) দুপুরে হিলি স্থলবন্দর পরিদর্শন এবং ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময়ের সময় এসব কথা বলেন তিনি।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “বিভিন্ন স্থলবন্দর প্রাইভেট সেক্টরে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে বাংলাদেশ সরকার। সেই সাথে যেসব স্থলবন্দর দিয়ে সরকার কোন রাজস্ব পায় না, সেইসব স্থলবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২৪টির মধ্যে চারটি স্থলবন্দর বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও চারটি স্থলবন্দর বন্ধের প্রক্রীয়াধীন রয়েছে। হিলি স্থলবন্দরের সমস্যাগুলোও খতিয়ে দেখা হবে।”
এসময় উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান, রংপুর কাস্টমসের বিভাগীয় কমিশনার অরুন কুমার বিশ্বাস, হিলি কাস্টমসের সহকারী কমিশনার এএসএম আকরাম সম্রাটসহ অনেকে।
ঢাকা/মোসলেম/এস