‘সারা জীবনের লক্ষ্য হলো মৃত্যু’
Published: 23rd, September 2025 GMT
১৯৩৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। লন্ডন। অস্ট্রীয় মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড খুব অসুস্থ। মুখের ক্যানসার। তাঁর বন্ধু ও চিকিৎসক ম্যাক্স শুরের হাত ধরে অনুরোধ করেন, ‘অহেতুক আর বেশি কষ্ট দিয়ো না। এখন আর যন্ত্রণা ছাড়া কিছু নেই, অর্থহীন লাগে। মুক্তি দাও।’ এরপর ওই দিনই মারা গেলেন ফ্রয়েড।
এর বহু বছর আগে অস্ট্রিয়ার আল্পসের পর্বত সেমারিংয়ের বাড়িতে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন জি এস ভিরেক। ভিরেকের মনে অনেক জিজ্ঞাসা। ফ্রয়েড মৃত্যুকে কীভাবে দেখেন, তাঁর মধ্যে মৃত্যুচিন্তা কাজ করে কি না—এসব বিষয়ে। সেদিন একটা সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন ফ্রয়েডের। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল সাইকোঅ্যানালাইসিস ডটকমে।
এখানে ফ্রয়েড বেশ কিছু কথা বলেছেন, যা একটু খাপছাড়া মনে হলেও চিন্তার রাজ্যে খুবই সুসংবদ্ধ। যেমন তিনি ওই আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘আমি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে আছি। আমার খাবারের অভাব নেই। আমি অনেক কিছু উপভোগ করেছি। আমার স্ত্রীর বন্ধুত্ব ও প্রেম পেয়েছি। সন্তানদের মুখ দেখেছি। তাদের বেড়ে ওঠা দেখেছি। সূর্যাস্ত ও বসন্তকালও দেখেছি। চারপাশের পরিবর্তন দেখেছি। এখন আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। মানুষ মরে যেতে চায় বলেই মারা যায়। সারা জীবনের লক্ষ্য হলো মৃত্যু।’
জার্মানি ও ইহুদির ভাষায় ফ্রয়েড শব্দের অর্থ আনন্দ। তাঁর কেসস্টাডিগুলোতে দেখা যায়, জীবনে অনেক রোগীকে তিনি পুরোপুরি সুস্থ করতে চাননি। কারণ, রোগী সুস্থ হয়ে গেলে বাস্তবের যে জগৎ সেখানে আরও দুর্দশায় কবলিত হবে।জি এস ভিরেক জানতে চান, কিন্তু আপনার তো অনেক যশ?
জবাবে ফ্রয়েড বলেন, ‘যশ আমাদের কাছে আসে কেবল মৃত্যুর পরেই। আর সত্যি বলতে, এরপর যা আসে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। মরণোত্তর গৌরবের কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই। আমার মধ্যে বিনয় কোনো গুণ নয়।’
জার্মানি ও ইহুদির ভাষায় ফ্রয়েড শব্দের অর্থ আনন্দ। তিনি জীবনে আনন্দই চাইতেন। তাঁর কেসস্টাডিগুলোতে দেখা যায়, জীবনে এমন অনেক রোগীকে তিনি পুরোপুরি সুস্থ করতে চাননি। কারণ, রোগী সুস্থ হয়ে গেলে বাস্তবের যে জগৎ সেখানে আরও দুর্দশায় কবলিত হবে। ফ্রয়েড ‘আনন্দ নীতির বাইরে’ (বিয়ন্ড দ্য প্লেজার প্রিন্সিপাল) নামের একটি বই লেখেন। এখানে বলেন, যৌন আকাঙ্ক্ষা বেঁচে থাকার জন্য খুবই জরুরি। যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে গেলে বেঁচে থাকার ইচ্ছাও কমে যায়। এই যে বেঁচে থাকার চালিকাশক্তি, তাকে তিনি বলেন, ‘ইরোস’ (জীবনপ্রবৃত্তি)।
অন্যদিকে তিনি দেখান এই ইরোস শুধু সুখের দিকে চালিত করে না, বরং কিছু ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক আচরণ করতেও বাধ্য করে। জীবনে ঘটনার পুনরাবৃত্তি, বাধ্যবাধকতা ও আত্মধ্বংস। এগুলোকে ফ্রয়েড বলেন ‘ডেথ ড্রাইভ বা থানাটোস’ (মৃত্যুপ্রবৃত্তি)।
ফ্রয়েডকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল অন্য এক ইন্টারভিউতে, জীবন নিয়ে কি আপনি হতাশ?
উত্তরে ফ্রয়েড বলেন, ‘মোটেই না। আমি খুব তুচ্ছ কারণেই সুখবোধ করি। সেটি একটি বই পড়ে হোক বা প্রকৃতির পরিবর্তন দেখে হোক বা আরও অনেক কিছু। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ভাবি, আমার যৌনশক্তি হ্রাস পাবে। আমি বুড়ো হব। প্রেমহীন হব।’
ফ্রয়েড বলেন, যৌন আকাঙ্ক্ষা বেঁচে থাকার জন্য খুবই জরুরি। যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে গেলে বেঁচে থাকার ইচ্ছাও কমে যায়। এই যে বেঁচে থাকার চালিকাশক্তি, তাকে তিনি বলেন, ‘ইরোস’ (জীবনপ্রবৃত্তি)।ফ্রয়েডকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে ভরসা পান না?
উত্তরে ফ্রয়েড বলেন, ‘আমি এ বিষয়টা নিয়ে ভাবি না। জীবিত সবকিছুই ধ্বংস হয়। আমি কেন বেঁচে থাকব। জীবন অবশ্যই আপসের একটি সিরিজ।’
ফ্রয়েড বলেন, ‘মৃত্যু হলো প্রেমের সঙ্গী। একসঙ্গে তারা বিশ্বকে শাসন করে। এটি আমার বই, বিয়ন্ড দ্য প্লেজার প্রিন্সিপাল-এর বার্তা। শুরুতে মনোবিশ্লেষণ ধরে নিয়েছিল যে প্রেমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আজ আমরা জানি যে মৃত্যুও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপর ফ্রয়েড হেসে বলেন, ‘আমরা বলতে পারি যে সব মৃত্যুই ছদ্মবেশে আত্মহত্যা।’
ফ্রয়েডের আনকনশাস ডেথ উইশেস চ্যাপ্টারে আছে, ফ্রয়েডের অনুমোদিত জীবনীকার জোন্স জানিয়েছেন, ফ্রয়েড তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী মার্থার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন একসময়। এই উদ্বেগ থেকে মার্থাকে হত্যাও করতে চেয়েছিলেন। এটাকে মৃত্যুর অচেতন ইচ্ছার প্রকাশ বলে ধারণা করা হয়। মার্থার কাছে লেখা ফ্রয়েডের চিঠিগুলো পড়ার মাধ্যমে জীবনীকার জোন্স জানতে পারেন, ফ্রয়েডের আবেগ কতটা শক্তিশালী ও স্থির ছিল। মার্থার কাছে লেখা তাঁর চিঠিগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ফ্রয়েডের আবেগ স্বাভাবিক প্রেমময় ধরনের ছিল না। তাই মার্থা যখন ফ্রয়েডের বাগদত্তা তখন একটি চিঠিতে ফ্রয়েড স্বীকার করেছেন যে তিনি এক ভয়াবহ আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেছেন। ফ্রয়েড বিয়ের পর যৌন সম্পর্কের ওপর খুবই গুরুত্ব দিতেন। একদিন মধ্যরাতের পর ফ্রয়েডের ঘুম ভেঙে গেলে অস্থির হয়ে ঘরময় পায়চারি করেন। মার্থা ঘুমিয়ে। নিজের লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়তে বসেন। তারপরও যেন তাঁর অজানা অস্থিরতা কমছিল না। শেষমেশ ফ্রয়েড এসে ডেকে তোলেন মার্থাকে এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। মার্থার সে সময় আগ্রহ ছিল না বলে ফ্রয়েড প্রায় মিনতি করেই বলেছিলেন, ‘না হয় আমি মারা যাব আজ ভোরের আগেই।’
জোন্সের বর্ণনা অনুযায়ী, ফ্রয়েড তাঁর প্রিয় বাগদত্তার স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় খুব চিন্তিত থাকতেন। ১৮৮৫ সালের গ্রীষ্মে খবর আসে যে তাঁর স্ত্রী পুরোপুরি সুস্থ নন। পরিবারের কোনো সদস্য অসুস্থ হলে বেশির ভাগ মানুষই চিন্তিত হন। কিন্তু স্পষ্টতই, ফ্রয়েডের উদ্বেগের কারণ ভিন্ন।
উল্লেখযোগ্যভাবে, যদিও বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারে না যে ফ্রয়েড কী বলছেন এবং কেন। ফ্রয়েড তাঁর বাগদত্তা মার্থাকে পাঠানো চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যখন আমি তোমার জন্য বিরক্ত হই, তখন আমি সত্যিই অস্থির হয়ে পড়ি। আমি তৎক্ষণাৎ সব মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলি এবং মুহূর্তের মধ্যে একটা ভয়ংকর ভয় আমার ওপর এসে পড়ে, যখন তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ো। আমি এতটাই উন্মাদ যে আমি আর বেশি কিছু লিখতে পারি না।’
এটি একজন চিন্তিত প্রেমিকের স্বীকারোক্তি নয় বরং এক বিকারগ্রস্তের স্বীকারোক্তিরই কাছাকাছি। পরের এক চিঠিতে ওই বছরই মার্থার কাছ থেকে একটি কার্ড পাওয়ার পর ফ্রয়েড লিখেছিলেন, ‘তোমাকে অসুস্থ বলে কল্পনা করা আমার সম্পূর্ণ ভুল ছিল। হয়তো তোমাকে পাচ্ছি না বলে আমিই অসুস্থবোধ করছিলাম। আমি খুব পাগল ছিলাম। প্রেমে পড়লে মানুষ খুব পাগল হয়ে যায়।’
কেউ রাগ দমন করলে তার দীর্ঘস্থায়ী চাপ তৈরি হতে পারে, যা অমীমাংসিত মানসিক দ্বন্দ্বের একটি শারীরিক প্রকাশ। তাহলে দমন ক্ষতিকর। কিন্তু সমাজের জন্য যেগুলো ক্ষতিকর, সেগুলো কি তবে দমন করা জরুরি নয়?ফ্রয়েডের প্রেম ও মৃত্যু নিয়ে প্যারাডক্স এমন যে মানুষ প্রেম চায়। প্রেমহীন বাঁচতে পারে না। আবার যখন মন প্রেমে পড়ে, তখন নিজেই নিজের সবচেয়ে খারাপ শত্রু হয়ে ওঠে। কল্পনা করুন, আপনি তীব্রভাবে কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা করছেন—সাফল্য, প্রেম, একটি সুস্বাদু মিষ্টি অথবা ফল। এর যেকোনোটিই কেবল যখন আপনার নাগালের মধ্যে আসবে, তখনই নিজেরা ধ্বংস হবে বা ‘প্রেমময় সম্পর্ক’টি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়াবে। পর্যবসিত হবে অতি ব্যবহারে। এটি মানুষের মানসিকতার সঙ্গে জড়িত একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব।
ফ্রয়েড যুক্তি দেন যে অবদমিত আকাঙ্ক্ষাগুলো অদৃশ্য হয় না আবার পেয়ে গেলে আকাঙ্ক্ষা আরও বাড়তে থাকে। এগুলো উদ্বেগ, স্বপ্ন বা আত্মনাশকতার রূপে পুনরুৎপাদন হয়। যেমন কেউ রাগ দমন করলে তার দীর্ঘস্থায়ী চাপ তৈরি হতে পারে, যা অমীমাংসিত মানসিক দ্বন্দ্বের একটি শারীরিক প্রকাশ। তাহলে দমন ক্ষতিকর। কিন্তু সমাজের জন্য যেগুলো ক্ষতিকর, সেগুলো কি তবে দমন করা জরুরি নয়? এ ব্যাপারে ফ্রয়েড খুব আশাবাদী নন।
কারণ, ফ্রয়েড মনে করতেন, মানুষের মন একই কাঠামোতে কখনোই স্থায়ী হয় না। এ বিষয়ে তাঁর জীবনের শেষ সময়ের কথা মনে পড়ছে। ফ্রয়েডের জীবনের শেষ সময় বেশ যন্ত্রণার। প্রিয় শহর ভিয়েনা। কিন্তু ১৯৩৩ সালে জার্মান একনায়কতান্ত্রিক অ্যাডলফ হিটলারের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। গেস্টাপো এসে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে গেল তাঁর খুবই আদরের কনিষ্ঠ সন্তান অ্যানা ফ্রয়েডকে। শান্তভাবে হুডখোলা গাড়িতে চেপে চলে গিয়েছিলেন অ্যানা। যিনি শুধু ফ্রয়েডের ভালোবাসার পাত্রীই নন, ছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য ও সচিব। নিজের সব চিন্তাভাবনা অ্যানার সঙ্গে ভাগ করে নিতেন ফ্রয়েড। সেই অ্যানাকে গেস্টাপো তুলে নিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তবে অনেক রাতে অ্যানা ফিরে আসেন। এরপর আর দেরি করেননি ফ্রয়েড। ভিয়েনা ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমান।
জীবনীকার জোন্স এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, মানুষ হঠাৎ করে যে হিটলারের ভক্ত হয়ে উঠল ও ভয়ংকর নৃশংস আচরণ করতে শুরু করল, এতে ফ্রয়েডের মানুষ সম্পর্কে ‘ধ্বংসাত্মক’ ধারণা আরও মজবুত হয়েছিল। ভিয়েনা ত্যাগের আগে বলেছিলেন, ‘অ্যানার জন্য লন্ডন যাচ্ছি, এখানে থাকলে তারা (গেস্টাপো) আমাকেও বইয়ের মতো পুড়িয়ে মারবে।’
ফ্রয়েড মনে করতেন, মানুষের মনে দুটি মৌলিক তাড়না বাস করে। যৌন তাড়না (লিবিডো) এবং আগ্রাসী তাড়না (অ্যাগ্রেশন)। যৌন তাড়নার ভেতরে বাস করে মৃত্যুপ্রবণতা। এই মৃত্যুপ্রবণতা যখন ধ্বংসাত্মক শক্তিতে পরিণত হয়, তখন তা কোনো মানুষকে মর্ষকামী করে ফেলে। অন্যদিকে কোনো মানুষকে করে তোলে ধর্ষকামী। মর্ষকামী নিজে সুখ ভোগ করলেও ধর্ষকামী নিপীড়নে আনন্দ পায়। এ বিবেচনায় তাই প্রতিটি শাসকই ধর্ষকামী। গেস্টাপো আর হিটলারও এর বাইরে নন।
তবে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বে ‘শাসক’ কোনো একক সত্তা নয়। আদিম আকাঙ্ক্ষা ও ‘সুপার ইগো’ দিয়ে তৈরি করা একটি সত্তা।
প্রসপেক্ট অনলাইন ম্যাগাজিনে আনা ব্লুনডি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েডের অন নার্সিসিজম বই থেকে। এ বইয়ে ফ্রয়েড তাঁর একটি রোগীর আচরণের বিবরণ দিয়েছেন। রোগীটি সন্ধ্যার পর ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন। ক্লিনিক্যালি বিষণ্নতায় ভুগছিলেন না। কিন্তু বিষণ্নতার ওষুধ খাচ্ছিলেন। কয়েক দিন থেকে গুরুতরভাবে তাঁর অসুস্থ হওয়ার ও মরে যাওয়ার ভয় কাজ করছিল। ফ্রয়েড টের পেয়েছিলেন, রোগী এখনো তাঁর নিজস্ব শূন্যবাদী চিন্তাভাবনা দ্বারা আটকা পড়ে আছেন। রোগীটি বলছিলেন, শেষ উইকএন্ডে তিনি তাঁর মা–বাবার গায়ে হাত তুলেছেন অথচ এ নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই। কোনো লজ্জা নেই। কোনো আত্মনিন্দা নেই।
কেন নেই? ফ্রয়েড বলেছেন, রোগীটি অধিক মাত্রায় নার্সিজমে ভুগতেন ও মরে যাওয়াকে ভয় পেতেন।
ফ্রয়েড রোগীকে শুধু বলেছিলেন, জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে মৃত্যু। নার্সিজমে ভোগার মতো আপনার কী এমন আছে যে মৃত্যু থেকে আপনি পরিত্রাণ পাবেন?
রোগীটি চলে যান এবং বহু পরে জানা যায়, রোগীটি বিষণ্নতার ওষুধ খাওয়া ছেড়েছেন। মা-বাবার যত্ন নেন এবং খুবই দায়িত্বশীল সাধারণ জীবন যাপন করছেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উদ ব গ প রক শ র জন য জ বন র আনন দ র একট দমন ক
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে মাদ্রাসায় দফায় দফায় শিক্ষার্থীকে নির্যাতন
রাজশাহীতে একটি মাদ্রাসায় দফায় দফায় এক শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাদ্রাসার একটি কক্ষে জুহায়ের তাজিম (১৬) নামে ওই কিশোর শিক্ষার্থীকে পর পর দুই দিন কয়েক দফায় বেধড়ক পেটানো হয়। এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এ নিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
জুহায়ের তাজিম রাজশাহী মহানগরের কয়েরদাঁড়া খ্রিস্টানপাড়া মোড় এলাকার মাইনজ ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের হিফজ মাদ্রাসা শাখার শিক্ষার্থী। মাদ্রাসার স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ রহমানের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতিত শিক্ষার্থী তাজিম জেলার বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পৌর সদরের মুগনি শাহের ছেলে।
আরো পড়ুন:
নবীনদের বরণ করে নিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপসহ অক্সফোর্ডে পিএইচডির সুযোগ জাবি ছাত্রীর
এ ঘটনায় তাজিমের মা জাকিয়া সুলতানা রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় মাদ্রাসার পরিচালক আইরিস পারভীন এবং স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাতে এজাহার দায়ের করেছেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘‘গত ১৩ এবং ১৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ রহমান তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার ছেলেকে নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করেছেন। তিনি আমার ছেলের দুই হাত এবং দুই পায়ের উরু ও নিতম্বে বেত, পর্দার পাইপ ও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এর ফলে আমার ছেলে মারাত্মকভাবে শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতির শিকার হয়েছে।
‘‘এই ঘটনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আইরিশ পারভীনকে জানানো হয়। তবে তিনি পদক্ষেপ নেননি। বরং তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ রহমান শুধু আমার ছেলেকেই নয়, মাদ্রাসার আরো অনেক শিক্ষার্থীকে প্রতিনিয়ত শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতন করে চলেছেন।’’ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ইশতিয়াক, ইসমাইল এবং আবু সাঈদসহ অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
নির্যাতিত শিক্ষার্থী তাজিমকে নির্যাতনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ‘‘স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ রহমান আমার বিরুদ্ধে একটি নোংরা অভিযোগ আনেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে শ্রেণিকক্ষ থেকে তিনি আমাকে ডেকে নেন। এরপর একটি ছোট নির্জন কক্ষে নিয়ে যান। বেত, পর্দার পাইপ এবং লাঠি দিয়ে আমাকে বেধড়ক পেটান। পরের দিনও তিনি আমাকে একইভাবে মারধর করেছেন। কক্ষটি মাদ্রাসার টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। এখানেই অন্য শিক্ষার্থীদেরও প্রতিনিয়ত শারীরিক ও মসানসিকভাবে নির্যাতন করেন স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর।’’
তাজিমের মা জাকিয়া সুলতানা বলেন, ‘‘১৪ সেপ্টেম্বর আমরা বার বার ফোন দিলেও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ফোন ধরেনি। পরের দিন সন্ধ্যায় আমার ছেলে মাদ্রাসা থেকে গোপনে চলে আসে। এ সময় তাকে আসতে বাধা দেন পরিচালক আইরিস পারভীন এবং স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ। পরে একরকম জোর করে আমার ছেলে মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আসে। ছেলে শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যথা। খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কম কথা বলছে। তাকে নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়েছি। তার ওপর যারা নির্যাতন চালিয়েছেন, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় জোর দাবি জানাচ্ছি।’’
নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ রহমানকে ফোন দেওয়া হয়। না ধরলে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা এবং থানার এজাহার দায়েরের বিষয়টি জানিয়ে মেসেজ দিলে তিনি সাড়া দেন। তিনি লেখেন, ‘‘অভিযোগ কবে, কে করেছে, একটু বিস্তারিত বলবেন প্লিজ।’’ এরপর তিনি আর কোনো উত্তর দেননি। ফোন দেওয়া হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে অভিযোগ সম্পর্কে তার পরিপূর্ণ বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কিশোর তাজিমকে নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আইরিস পারভীন বলেন, ‘‘ঘটনাটি দুঃখজনক। আমার বাবা-মা অসুস্থ থাকার কারণে আমি বাসায় ছিলাম। এ সময় স্টুডেন্ট অ্যাম্বাসেডর ইমতিয়াজ শিক্ষার্থী তাজিমকে মারধর করেছেন। এর আগেও তিনি শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেছেন। তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি আমার কথা না মেনে আবারও নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। ইমতিয়াজকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দিয়েছি। আমি অনুততপ্ত এবং লজ্জিত। যেসব শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের পরিবারের কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছি।’’
নগরের বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘‘অভিযোগটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
ঢাকা/কেয়া/বকুল