তফসিল ঘোষণা না হলেও ভারতের বিহার রাজ্যের বিধানসভা ভোটের বাকি বড়জোর দুই মাস। অথচ শাসকগোষ্ঠী এনডিএ ও তার প্রধান শরিক বিজেপির কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলেছে ত্রিমুখী সমস্যা।

২৯ নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যের নতুন বিধানসভা গড়ে তুলতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তার আগেই ভোটপর্ব ও গণনা শেষ করা বাধ্যতামূলক। ২০২০ সালে ২৪৩ আসনবিশিষ্ট বিধানসভায় তিন দফার ভোট শুরু হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। শেষ দফার ভোট হয় ৭ নভেম্বর। গণনা হয়েছিল ১০ নভেম্বর।

এবার এখনো নির্বাচন কমিশন ভোট নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেনি। সব পক্ষের তৎপরতা তুঙ্গে। আজ বুধবার কংগ্রেস নেতৃত্ব ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের জন্য এই রাজ্যের রাজধানী পাটনাকে বেছে নিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না। তা সত্ত্বেও বিজেপির কপালের ভাঁজ গাঢ় করে তুলেছে তাদের শরিক, রাজ্যস্তরের দলীয় নেতারা এবং বিরোধী জোটের ভোট চুরি প্রচার। ত্রিমুখী এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, এখনো তার স্পষ্ট দিশা নেই।

ত্রিমুখী সমস্যার প্রথমটি তৈরি করেছেন বিজেপিরই শরিক লোক জনশক্তি পার্টির (এলজেপি) নেতা চিরাগ পাসোয়ান। গত ভোটে নিজেকে নরেন্দ্র মোদির ‘হনুমান’ বলে পরিচয় দেওয়া এই দলিত নেতা এবার ৪০টি আসনের দাবিতে অনড়। বারবার তিনি বলে চলেছেন, ৩৮টি জেলার প্রতিটিতে অন্তত ১টি করে আসন তাঁর চাই।

চিরাগের প্রয়াত বাবা রামবিলাস পাসোয়ান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব পেতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ছেলে চিরাগের নজর সেদিক থেকে ভিন্ন। তাঁর বয়স মাত্র ৪২। তিনি পাখির চোখ করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রিত্বে। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে যা যা করণীয়, সেই দিকেই তিনি ধীরে হলেও এগোতে চাইছেন।

চিরাগ জানেন, বিজেপিতে এমন কোনো নেতা নেই, গোটা রাজ্যে যাঁর প্রভাব ও পরিচিতি আছে। সুশীল কুমার মোদির মৃত্যুর পর রাজ্য বিজেপি কার্যত নেতৃত্বহীন। একই হাল কংগ্রেসেরও। রাহুল গান্ধীর প্রতি সমর্থন যতই থাকুক, রাজ্যস্তরে কংগ্রেসও বিজেপির মতোই নেতৃত্বহীন। জেডিইউয়ের হালও তথৈবচ। নীতীশ কুমার অশক্ত। অসুস্থও।

নীতীশের পর জেডিইউতে আর কেউ নেই, যিনি শূন্যস্থান পূরণ করার যোগ্য। চিরাগ মনে করেন, নেতা বলতে তাঁর প্রতিপক্ষ একজনই। আরজেডির তেজস্বী যাদব। এই রাজনৈতিক শূন্যতায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। সেই কারণে বিজেপির সঙ্গে আসন নিয়ে দর–কষাকষিতে নেমেছেন।

পাঁচ বছর আগে নীতীশের সঙ্গে বিবাদের জেরে এনডিএর শরিক হয়েও চিরাগ বেছে বেছে সেই ১৩৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছিলেন, যেগুলো জেডিইউকে ছাড়া হয়েছিল। যদিও জিতেছিলেন মাত্র ১টিতে। কিন্তু দুই বছর পর ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে পাঁচটি আসন জিতেছিল চিরাগের দল এলজেপি।

বিজেপিকে চিরাগ জানিয়েছেন, আসন সমঝোতা অবশ্যই করবেন। এলজেপিকে খুশি করতে গেলে জেডিইউ ও বিজেপির ভাগে কম আসন আসবে। তাহলে কী উপায়? এখনো কেউ জানেন না।

বিজেপির দ্বিতীয় চিন্তা দলের নেতা রাজকুমার সিংকে নিয়ে। এই সাবেক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব (২০১১–১৩) বিজেপিতে যোগ দিয়ে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের ভোটে বিহারের আরা থেকে জিতে লোকসভার সদস্য হন।

নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ রাজকুমারকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করেছিলেন। ২০২৪ সালের ভোটে তিনি হেরে যান সিপিআই (এমএল) প্রার্থীর কাছে ৬০ হাজার ভোটে। সেই থেকে রাজ্য রাজনীতিতে তিনি কোণঠাসা। বিজেপির বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বিরোধও চরমে উঠেছে।

রাজকুমার সিং প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, একদা ভোটকুশলী বর্তমানে জন সুরাজ পার্টির নেতা প্রশান্ত কিশোর যে অভিযোগ করেছেন, এর জবাব বিজেপির উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরী ও বিজেপির প্রদেশ সভাপতি দিলীপ জয়সোয়ালকে দিতে হবে।

গণমাধ্যমকে দেওয়া একের পর এক সাক্ষাৎকারে রাজকুমার সিং এই দাবি জানিয়ে বলছেন, অভিযোগ নিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী ও প্রদেশ সভাপতির নীরবতা দলের ক্ষতি করছে।

সম্রাট চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক মামলায় আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর বিদ্যা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মানে ক্লাস সেভেন ফেল।

পরে আবার সম্রাট নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে ডক্টরেট পেয়েছেন। প্রশান্ত কিশোরের তোলা এই অভিযোগই খোলসা করার দাবি রাজকুমার জানিয়েছেন।

প্রশান্ত কিশোরের আরও অভিযোগ, সম্রাট চৌধুরী নাকি তিন–তিনবার নাম বদলেছেন। সেই অভিযোগ সামনে এনে রাজকুমার দাবি জানিয়েছেন, সম্রাট চৌধুরীকে জানাতে হবে অভিযোগগুলো ঠিক নাকি মিথ্যা।

রাজকুমারের অভিযোগ, দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ জয়সোয়াল খুনের মামলায় অভিযুক্ত। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, কিষেনগঞ্জে একটি মেডিকেল কলেজ তিনি দখলে নিয়েছেন, যা নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা করার কথা শিখ সম্প্রদায়ের।

অন্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে প্রশান্ত কিশোর সরব। যেমন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পান্ডে। জেডিইউ নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী অশোক চৌধুরীর বিরুদ্ধেও তাঁর অভিযোগ, ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি তিনি নাকি দখল করেছেন।

জন সুরাজ পার্টি নেতা প্রশান্ত কিশোর এবার বিহার বিধানসভার ভোটে প্রার্থী দেবেন। তাঁরও লক্ষ্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রিত্ব। তাঁর তোলা অভিযোগ নিয়ে বিজেপি নেতা রাজকুমারের প্রকাশ্য দাবি বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে দিশেহারা করে তুলেছে।

রাজকুমার সিংয়ের ক্ষোভ প্রশমনে দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা এখনো সফল হননি। গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, সভাপতি নাড্ডাকে বলে দিয়েছেন, তাঁর দাবি না মানা হলে আরা ও বরহরা কেন্দ্রের বিজেপি–প্রত্যাশীদের বিরোধিতা তিনি করবেনই।

বিজেপির তৃতীয় দুশ্চিন্তা বিরোধী জোটের তোলা ভোট চুরির স্লোগান নিয়ে। রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, দীপংকর ভট্টাচার্যদের ভোটাধিকার যাত্রার জবাব বিজেপি–জেডিইউ জোট এখনো দিতে পারেনি। বিজেপি নেতারাও স্বীকার করছেন, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে পক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ রাহুল তুলেছেন, তা রাজ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।

এ অবস্থায় আজ বুধবার পাটনায় বসছে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। একদিকে জোটের অশান্তি, অন্যদিকে বিরোধীদের জোটবদ্ধতার মোকাবিলা বিজেপি কীভাবে করবে, সেই দুশ্চিন্তা বিজেপিতে ছায়া ফেলছে। রাজ্য নেতৃত্ব চেয়ে আছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে।

মোদি ভাবছেন, আয়করে ছাড় ও জিএসটির নতুন বিন্যাস মানুষকে আর্থিক সুরাহা দিতে শুরু করেছে। এটাই হতে চলেছে মুশকিল আসান। বিহার বৈতরণী পেরোনোর কড়ি।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম খ যমন ত র ব ধ নসভ হয় ছ ল মন ত র কর ছ ন সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নানা সাজিয়ে পুলিশে চাকরি

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল হককে নানা সাজিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সম্রাট হাসান তুহিন নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে। তিনি বর্তমানে রাঙামাটির কাউখালী থানায় কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। তার বিপি নম্বর ৯৪১৪১৭১২০৯।

অভিযুক্ত তুহিন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার শেখেরগাঁও গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। এ ঘটনায় তুহিনের স্ত্রী হোসনা বেগম গত ১৬ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ দুদক সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।

আরো পড়ুন:

৭১-এর মতো ২৪-এ বুক পেতে দিয়েছেন বিএনপির হাজারো নেতাকর্মী: হাফিজ

মুজিবনগর সরকারের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিলের খবর ‘মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর’

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে হোসনা বেগমের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তুহিনের বিয়ে হয়। ২০১৪ সালে পুলিশের কনস্টেবল পদে যোগদানের সময় তিনি মোহনগঞ্জ উপজেলার শেখপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল হককে নানা সাজিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সুনামগঞ্জ নোটারি পাবলিকে হলফনামা তৈরি করেন। এতে নিজেকে ওই মুক্তিযোদ্ধার দৌহিত্র পরিচয় দেন। পরে সেই নকল হলফনামা ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সুবিধায় পুলিশে চাকরি নেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল হক বলেন, ‘‘তুহিন নামে আমার কোনো নাতি নেই। হলফনামায় দেওয়া স্বাক্ষরও আমার নয়। কে বা কারা প্রতারণা করেছেন, তাদের শাস্তি চাই।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে মোহনগঞ্জেই, সুনামগঞ্জে নয়।’’

অভিযোগকারী হোসনা বেগম বলেন, ‘‘তুহিন প্রতারণা করে আমার অজান্তে বীর মুক্তিযোদ্ধা মনজুরুল হকের সনদ ব্যবহার করে চাকরি নেন। তিনি আমার নানা নন।’’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তুহিন দাবি করেন, ‘‘স্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে এমন অভিযোগ করা হয়েছে। মনজুরুল হক আমার নানা, তার সনদেই চাকরি নিয়েছি। প্রতারণা করে থাকলে এতদিন চাকরিতে থাকা সম্ভব হতো না।’’

ময়মনসিংহ দুদক সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘অভিযোগটি ঢাকায় পাঠানো হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিধিসম্মত হলে তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

ঢাকা/ইবাদ/বকুল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নানা সাজিয়ে পুলিশে চাকরি