বিহারের বিধানসভা ভোটের আগে ত্রিমুখী সমস্যায় জেরবার মোদির বিজেপি
Published: 24th, September 2025 GMT
তফসিল ঘোষণা না হলেও ভারতের বিহার রাজ্যের বিধানসভা ভোটের বাকি বড়জোর দুই মাস। অথচ শাসকগোষ্ঠী এনডিএ ও তার প্রধান শরিক বিজেপির কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ ফেলেছে ত্রিমুখী সমস্যা।
২৯ নভেম্বরের মধ্যে রাজ্যের নতুন বিধানসভা গড়ে তুলতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, তার আগেই ভোটপর্ব ও গণনা শেষ করা বাধ্যতামূলক। ২০২০ সালে ২৪৩ আসনবিশিষ্ট বিধানসভায় তিন দফার ভোট শুরু হয়েছিল ২৮ অক্টোবর। শেষ দফার ভোট হয় ৭ নভেম্বর। গণনা হয়েছিল ১০ নভেম্বর।
এবার এখনো নির্বাচন কমিশন ভোট নির্ঘণ্ট ঘোষণা করেনি। সব পক্ষের তৎপরতা তুঙ্গে। আজ বুধবার কংগ্রেস নেতৃত্ব ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের জন্য এই রাজ্যের রাজধানী পাটনাকে বেছে নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চেষ্টায় ত্রুটি রাখছেন না। তা সত্ত্বেও বিজেপির কপালের ভাঁজ গাঢ় করে তুলেছে তাদের শরিক, রাজ্যস্তরের দলীয় নেতারা এবং বিরোধী জোটের ভোট চুরি প্রচার। ত্রিমুখী এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে, এখনো তার স্পষ্ট দিশা নেই।
ত্রিমুখী সমস্যার প্রথমটি তৈরি করেছেন বিজেপিরই শরিক লোক জনশক্তি পার্টির (এলজেপি) নেতা চিরাগ পাসোয়ান। গত ভোটে নিজেকে নরেন্দ্র মোদির ‘হনুমান’ বলে পরিচয় দেওয়া এই দলিত নেতা এবার ৪০টি আসনের দাবিতে অনড়। বারবার তিনি বলে চলেছেন, ৩৮টি জেলার প্রতিটিতে অন্তত ১টি করে আসন তাঁর চাই।
চিরাগের প্রয়াত বাবা রামবিলাস পাসোয়ান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চেয়ে কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব পেতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ছেলে চিরাগের নজর সেদিক থেকে ভিন্ন। তাঁর বয়স মাত্র ৪২। তিনি পাখির চোখ করেছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রিত্বে। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হলে যা যা করণীয়, সেই দিকেই তিনি ধীরে হলেও এগোতে চাইছেন।
চিরাগ জানেন, বিজেপিতে এমন কোনো নেতা নেই, গোটা রাজ্যে যাঁর প্রভাব ও পরিচিতি আছে। সুশীল কুমার মোদির মৃত্যুর পর রাজ্য বিজেপি কার্যত নেতৃত্বহীন। একই হাল কংগ্রেসেরও। রাহুল গান্ধীর প্রতি সমর্থন যতই থাকুক, রাজ্যস্তরে কংগ্রেসও বিজেপির মতোই নেতৃত্বহীন। জেডিইউয়ের হালও তথৈবচ। নীতীশ কুমার অশক্ত। অসুস্থও।
নীতীশের পর জেডিইউতে আর কেউ নেই, যিনি শূন্যস্থান পূরণ করার যোগ্য। চিরাগ মনে করেন, নেতা বলতে তাঁর প্রতিপক্ষ একজনই। আরজেডির তেজস্বী যাদব। এই রাজনৈতিক শূন্যতায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন। সেই কারণে বিজেপির সঙ্গে আসন নিয়ে দর–কষাকষিতে নেমেছেন।
পাঁচ বছর আগে নীতীশের সঙ্গে বিবাদের জেরে এনডিএর শরিক হয়েও চিরাগ বেছে বেছে সেই ১৩৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছিলেন, যেগুলো জেডিইউকে ছাড়া হয়েছিল। যদিও জিতেছিলেন মাত্র ১টিতে। কিন্তু দুই বছর পর ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে পাঁচটি আসন জিতেছিল চিরাগের দল এলজেপি।
বিজেপিকে চিরাগ জানিয়েছেন, আসন সমঝোতা অবশ্যই করবেন। এলজেপিকে খুশি করতে গেলে জেডিইউ ও বিজেপির ভাগে কম আসন আসবে। তাহলে কী উপায়? এখনো কেউ জানেন না।
বিজেপির দ্বিতীয় চিন্তা দলের নেতা রাজকুমার সিংকে নিয়ে। এই সাবেক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব (২০১১–১৩) বিজেপিতে যোগ দিয়ে ২০১৪ ও ২০১৯ সালের ভোটে বিহারের আরা থেকে জিতে লোকসভার সদস্য হন।
নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ রাজকুমারকে কেন্দ্রের মন্ত্রী করেছিলেন। ২০২৪ সালের ভোটে তিনি হেরে যান সিপিআই (এমএল) প্রার্থীর কাছে ৬০ হাজার ভোটে। সেই থেকে রাজ্য রাজনীতিতে তিনি কোণঠাসা। বিজেপির বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর বিরোধও চরমে উঠেছে।
রাজকুমার সিং প্রকাশ্যে দাবি করেছেন, একদা ভোটকুশলী বর্তমানে জন সুরাজ পার্টির নেতা প্রশান্ত কিশোর যে অভিযোগ করেছেন, এর জবাব বিজেপির উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরী ও বিজেপির প্রদেশ সভাপতি দিলীপ জয়সোয়ালকে দিতে হবে।
গণমাধ্যমকে দেওয়া একের পর এক সাক্ষাৎকারে রাজকুমার সিং এই দাবি জানিয়ে বলছেন, অভিযোগ নিয়ে উপমুখ্যমন্ত্রী ও প্রদেশ সভাপতির নীরবতা দলের ক্ষতি করছে।
সম্রাট চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এক মামলায় আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছিলেন, তাঁর বিদ্যা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত। সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছিলেন। মানে ক্লাস সেভেন ফেল।
পরে আবার সম্রাট নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে ডক্টরেট পেয়েছেন। প্রশান্ত কিশোরের তোলা এই অভিযোগই খোলসা করার দাবি রাজকুমার জানিয়েছেন।
প্রশান্ত কিশোরের আরও অভিযোগ, সম্রাট চৌধুরী নাকি তিন–তিনবার নাম বদলেছেন। সেই অভিযোগ সামনে এনে রাজকুমার দাবি জানিয়েছেন, সম্রাট চৌধুরীকে জানাতে হবে অভিযোগগুলো ঠিক নাকি মিথ্যা।
রাজকুমারের অভিযোগ, দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ জয়সোয়াল খুনের মামলায় অভিযুক্ত। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, কিষেনগঞ্জে একটি মেডিকেল কলেজ তিনি দখলে নিয়েছেন, যা নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা করার কথা শিখ সম্প্রদায়ের।
অন্য বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে প্রশান্ত কিশোর সরব। যেমন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মঙ্গল পান্ডে। জেডিইউ নেতা ও রাজ্যের মন্ত্রী অশোক চৌধুরীর বিরুদ্ধেও তাঁর অভিযোগ, ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি তিনি নাকি দখল করেছেন।
জন সুরাজ পার্টি নেতা প্রশান্ত কিশোর এবার বিহার বিধানসভার ভোটে প্রার্থী দেবেন। তাঁরও লক্ষ্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রিত্ব। তাঁর তোলা অভিযোগ নিয়ে বিজেপি নেতা রাজকুমারের প্রকাশ্য দাবি বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে দিশেহারা করে তুলেছে।
রাজকুমার সিংয়ের ক্ষোভ প্রশমনে দলের সভাপতি জেপি নাড্ডা এখনো সফল হননি। গণমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, সভাপতি নাড্ডাকে বলে দিয়েছেন, তাঁর দাবি না মানা হলে আরা ও বরহরা কেন্দ্রের বিজেপি–প্রত্যাশীদের বিরোধিতা তিনি করবেনই।
বিজেপির তৃতীয় দুশ্চিন্তা বিরোধী জোটের তোলা ভোট চুরির স্লোগান নিয়ে। রাহুল গান্ধী, তেজস্বী যাদব, দীপংকর ভট্টাচার্যদের ভোটাধিকার যাত্রার জবাব বিজেপি–জেডিইউ জোট এখনো দিতে পারেনি। বিজেপি নেতারাও স্বীকার করছেন, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে বিজেপির হয়ে পক্ষপাতিত্বের যে অভিযোগ রাহুল তুলেছেন, তা রাজ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।
এ অবস্থায় আজ বুধবার পাটনায় বসছে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। একদিকে জোটের অশান্তি, অন্যদিকে বিরোধীদের জোটবদ্ধতার মোকাবিলা বিজেপি কীভাবে করবে, সেই দুশ্চিন্তা বিজেপিতে ছায়া ফেলছে। রাজ্য নেতৃত্ব চেয়ে আছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে।
মোদি ভাবছেন, আয়করে ছাড় ও জিএসটির নতুন বিন্যাস মানুষকে আর্থিক সুরাহা দিতে শুরু করেছে। এটাই হতে চলেছে মুশকিল আসান। বিহার বৈতরণী পেরোনোর কড়ি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম খ যমন ত র ব ধ নসভ হয় ছ ল মন ত র কর ছ ন সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
‘শিল্পবোধ ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটেছিল আনিস চৌধুরীর লেখায়’
‘খেয়াল খেলা কাজ’, ‘পড়বার নিয়ম’ অথবা ‘পাশের কামরার লোকটি’ এসব শিরোনামের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল চল্লিশের দশকে। আজাদ, মুকুলের মহফিল, ইত্তেহাদ বা অগত্যা পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠক সমাদৃত এসব বিষয়ের লেখক প্রয়াত আনিস চৌধুরী। সেসব লেখা একসঙ্গে করে প্রকাশিত হয়েছে ‘আনিস চৌধুরী হয়ে ওঠার লেখাজোখা’ বইটি। তাঁর লেখায় ধরা আছে সময় পরিক্রমার ইতিহাস। বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উঠে এল এসব কথা। শনিবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে আয়োজিত হয় মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানটি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন লেখক ও শিল্পসমালোচক হাসনাত আবদুল হাই। তিনি বলেন, ‘আনিস চৌধুরী আমাদের সাহিত্যিকদের পূর্বসূরি। একসময় উপন্যাস বের হওয়া ছিল আলোড়ন তোলা। তখনই তিনি আমাদের কাছে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন।’ হাসনাত আবদুল হাই আরও বলেন, আনিস চৌধুরীর লেখায় শিল্পবোধ ও আধুনিকতার সংমিশ্রণ ছিল। ডকুমেন্টেশনের ক্ষেত্রে এ বই এক দৃষ্টান্তমূলক প্রকাশনা।
কথাসাহিত্যিক পিয়াস মজিদ আনিস চৌধুরীর বইয়ের বিভিন্ন অংশ থেকে পাঠ ও আলোচনা করেন। তিনি রমনীয়তা ও রম্যতার বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেন। আনিস চৌধুরীর কবিতা নিয়ে কম আলোচনা থাকলেও তিনি যথেষ্ট সিরিয়াস কবি ছিলেন বলে উল্লেখ করেন এই আলোচক।
প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক আলম খোরশেদ বলেন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে মানুষেরা সাহিত্য দিয়ে সমাজ নির্মাণ করে দেশকে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, আনিস চৌধুরী তাঁদেরই একজন। তাঁরা স্বাধীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সম্মিলিত লড়াই করেছেন। আনিস চৌধুরীর লেখার প্রসঙ্গ ধরে আলম খোরশেদ স্মরণ করেন সদ্য প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে।
আলোচনা পর্ব শেষে মোড়ক উন্মোচন হয় ‘আনিস চৌধুরী হয়ে ওঠার লেখাজোখা’ বইটির। পুরো আয়োজনের সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। প্রয়াত আনিস চৌধুরী তাঁর বাবা।
আনিস চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন ১৯৯০ সালে। নাট্যকার, গল্পকার, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক এবং কবি আনিস চৌধুরী রেডিও, টেলিভিশনে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।
১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণকারী আনিস চৌধুরী নিজের সময়কালের টুকরো টুকরো ইতিহাস ধরে রেখেছিলেন সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও সাময়িকীতে নিজের লেখা দিয়ে। সেসব লেখাই তিনি সংরক্ষণ করতেন সযত্নে। সেই সব লেখা নিয়েই ‘আনিস চৌধুরী হয়ে ওঠার লেখাজোখা’ নামক গ্রন্থটি। বইটি প্রকাশ করেছে বেঙ্গল পাবলিকেশনস।
মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু, প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামান, শিল্পী ঢালী আল মামুন, সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফসহ আরও অনেক বিশিষ্টজন।