নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে স্পষ্ট বার্তা
Published: 28th, September 2025 GMT
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, সেটা জোরালো ও তাৎপর্যপূর্ণ বলেই প্রতীয়মান হয়। জাতিসংঘের মতো সর্বোচ্চ বৈশ্বিক ফোরামে দাঁড়িয়ে তিনি যখন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আসেন, তখন এ নিয়ে সংশয়ের আর কোনো অবকাশ থাকার সুযোগ নেই। ভাষণে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ ও সংস্কার উদ্যোগ, রোহিঙ্গা সংকট, বাণিজ্যযুদ্ধ, জলবায়ু সংকট, গাজা যুদ্ধসহ আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেন, সংকট উত্তরণের উপায় নিয়েও পরামর্শ দেন।
শুক্রবার রাতে সাধারণ পরিষদে অধ্যাপক ইউনূসের ভাষণকালে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নজির বিরল। এটা বহির্বিশ্বের কাছে আমাদের জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে একটা ইতিবাচক ধারণা তৈরি করবে।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। গতবারের ভাষণে তিনি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন বাংলাদেশের গণমানুষ, বিশেষ করে তরুণসমাজের অফুরান শক্তি কীভাবে বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। এবারের ভাষণে তিনি রূপান্তর–যাত্রায় বাংলাদেশ কতটা অগ্রসর হতে পেরেছে, সংক্ষেপে সেই খতিয়ান তুলে ধরেন।
সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়নে ধীরগতি কেন, তার একটা ব্যাখ্যা মেলে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে। সরকারপ্রধানের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার যে সংস্কার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশের মতো ‘সহজ’ পথে না গিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে এমন একটি কঠিন পথ বেছে নিয়েছে, যেন সেটা টেকসই হয়। সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন এবং কমিশনগুলোর প্রস্তাব নিয়ে ৩২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের যে দীর্ঘ সংস্কার ও ঐক্য প্রচেষ্টা, সেটা সত্যিই এক ঐতিহাসিক এবং কঠিনতম যাত্রা।
বাংলাদেশে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রত্যাবর্তনের পথ যাতে বন্ধ হয়, সেটাই প্রত্যাশা করেন নাগরিকেরা। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যে দলই জনগণের সমর্থন পাক না কেন, সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আর কোনো অনিশ্চয়তার অবকাশ থাকবে না। আমরা মনে করি, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার প্রশ্নে যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তাতে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সংস্কার বাস্তবায়ন করাটাই তাদের মূল দায়িত্ব হবে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে সম্পদ পাচার যে একটি বড় আন্তর্জাতিক সমস্যা, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে সেটা স্পষ্ট করেছেন। যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের পাচার করা সম্পদ গচ্ছিত আছে, সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। উন্নয়নশীল দেশ থেকে পাচার বন্ধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়নের যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছেন, সেটা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতা রোহিঙ্গা সংকটের মাত্রা ও বিস্তৃতি কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তাতে বাংলাদেশ কতটা ভুক্তভোগী হয়েছে, অধ্যাপক ইউনূসের ভাষণে সেটা আবারও স্পষ্ট হয়েছে। রাখাইনের সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক সমাধান যে অপরিহার্য, সেটা তিনি বিশ্বনেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তহবিল–সংকটের কারণে রোহিঙ্গা শিবিরের মানবিক সংকট নিরাপত্তাঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে জানিয়ে তিনি দাতাদের সাহায্য বাড়াতে ও নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানান।
গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে এখনই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানান। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানই ফিলিস্তিন সমস্যার একমাত্র সমাধান।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে দেশবাসী ও বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে স্পষ্ট একটা বার্তা পেয়েছে বলেই আমরা মনে করি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পাহাড় থেকে পৃথিবীর পথে
পিঠে থুরুং (ঝুড়ি) বাঁধা এক জুমিয়া নারী। মাথায় পাগড়ির বা শিরস্ত্রাণের মতো একটা ট্যাংক। ছবির পরিসরজুড়ে বিশালাকৃতির সেই নারীর চারপাশে বন্দুকধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। তাদের আকৃতি নারীর তুলনায় বহুগুণ খর্বকায়। ট্যাংকের নল দিয়ে সেসব ছায়ামূর্তির ওপর পড়ছে পাতা আর ফুল।
শিল্পী জয়দেব রোয়াজা কালি ও কলমে এই ছবি এঁকেছিলেন ২০২৩ সালে। তাঁর অন্য সব ছবির মতোই এটিও পাহাড়ের সমকালীন অবস্থাই কেবল তুলে ধরে না; বরং তাকে ভীষণভাবে ছাপিয়ে যায়। বাস্তবতা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার সীমায় এসে দাঁড়ায়। মানুষের জীবন, সংগ্রাম আর প্রকৃতি সব ভেঙেচুরে কবিতার একটি পঙ্ক্তির ভেতরে যেন প্রবেশ করে।
১৯৭৩ সালে খাগড়াছড়ির খামারপাড়ার একটি ত্রিপুরা পরিবারে জন্ম জয়দেব রোয়াজার। মা নীহারিকা ত্রিপুরা আর বাবা হিরণ্ময় রোয়াজা। হিরণ্ময় মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে একটি হাসপাতালে চাকরি করতেন। শান্ত নিরিবিলি পাড়ার বাসিন্দা তাঁরা। পাহাড়, ঝিরি, ঝরনা আর জুমখেত দেখতে দেখতে বড় হওয়া। স্কুলে কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশন নকল করে খাতায় আঁকতেন। কবিতার চেয়ে ভালো লাগত ইলাস্ট্রেশন। শেষে এই ভালো লাগারই জয় হলো। বাংলাদেশের এই সময়কার এক উজ্জ্বল শিল্পী জয়দেব। তাঁর শিল্পকর্মের পরিচিতি ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে।
একনজরে জয়দেবচারুকলার নতুন মাধ্যম পারফরম্যান্স আর্ট। জয়দেব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই মাধ্যমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এই ধারার শিল্পীরা নিজের শরীরকেই করে তোলেন ক্যানভাস। সঙ্গে থাকে নানা প্রকাশভঙ্গি। পারফরম্যান্স করতে গিয়ে ছবি আঁকা ছাড়েননি তিনি। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের যেমন স্টোরিবোর্ড, তেমনি জয়দেবের পারফরম্যান্সের প্রতিটি ভঙ্গির ছবি আঁকা থাকে তাঁর স্কেচ খাতায়। এভাবেই দুই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নিজের ধরনে। পাশাপাশি বড় ক্যানভাসেও ছবি আঁকেন। কালি ও কলমেই সিদ্ধহস্ত তিনি।
ভারতের কোচি বিয়েনাল, হংকং আর্ট বেজেল, অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে এশিয়া প্যাসিফিক ট্রায়েনিয়ালে অংশ নিয়েছেন তিনি। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১১টির বেশি দেশে তিনি পারফরম্যান্স করেছেন। হয়েছে চিত্র প্রদর্শনীও। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টেট মডার্ন মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, চীনের হংকংয়ের এম প্লাস, ফ্রান্সের প্যারিসের ক্যাডিস্ট ফাউন্ডেশন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবির গুগেনহাইম, ভারতের নয়াদিল্লির কিরণ নাদার মিউজিয়ামসহ বিশ্বের খ্যাতনামা বহু জাদুঘরে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। বাংলাদেশে তাঁর শিল্পসংগ্রহ রয়েছে সামদানি আর্ট ফাউন্ডেশন এবং দুর্জয় বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনে। শিল্পবিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা আর্ট রিভিউ এশিয়া, আর্ট নিউজ, ফোর্বস এবং ভারতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু পত্রিকায় তাঁর শিল্পকর্মের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আবুধাবির গুগেনহাইম মিউজিয়াম জয়দেবের একটি শিল্পকর্ম বেশ ভালো দামে কিনে নিয়েছে। বর্তমানে তিনি মুম্বাইভিত্তিক ঝাভেরি কনটেমপোরারি গ্যালারির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ।
পাহাড় আর ঝিরির পথে পথেখাগড়াছড়ি আর রাঙামাটির ঝিরি পথে বা কাপ্তাই হ্রদের নির্জনতায় সময় কাটে জয়দেব রোয়াজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এলেও জীবন কাটান পাহাড়ি জুমিয়াদের মতো। কখনো মাছ ধরতে চলে যান জেলেদের সঙ্গে। আবার কখনো ঝিরি পথে হেঁটে হেঁটে দিন কাটে তাঁর। রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার কামিলাছড়ি গ্রামে নির্জন হ্রদের ধারে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও। সেখানে সপ্তাহের দুই দিন কাটে তাঁর। পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষজনকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা বুনে তোলেন ক্যানভাসে।
জয়দেব দেশের শিল্পীসমাজ ও শিল্পবোদ্ধাদের জগৎ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাঁর কথায়, ঢাকা তাঁকে কখনো টানে না। দু-এক দিন ঢাকা বা দেশের বাইরে থাকলে হাঁপিয়ে ওঠেন। ভাবেন, কখন ফিরবেন পাহাড়ে।
সম্প্রতি কামিলাছড়িতে তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা গেল আট ফুট দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে কাজ করছেন তিনি। তিনতলা স্টুডিওর বারান্দায় এসে দাঁড়ালে অবারিত নীল হ্রদের হাতছানি। হ্রদের পাড়ে ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। সেদিকে তাকালে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। বারান্দায় বসে কথায় কথায় জানালেন নির্জন এই পাহাড়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ছবি বিক্রির টাকায় এই স্টুডিও গড়ে তুলেছেন। স্ত্রী হাসনাহেনা পরশের সঙ্গে মিলে জঙ্গল পরিষ্কার করেছেন। একটাই চাওয়া, একটু আড়াল, একটু নির্জনতা। ছবি আঁকার জন্য এটুকু পরিসর চেয়েছেন জীবন থেকে।
জয়দেব রোয়াজা