‘স্বদেশ এখন মানচিত্রে আঁকা/ সুশ্রী রঙিন পতাকায় লেখা,/ তবু খুঁজে ফিরি সবার স্বদেশ/ জানি না সে চাওয়া কবে হবে শেষ।’—বাঙাল স্বদেশ, আহমদ রফিক

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ৯৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। আগস্টের ১৭ তারিখ থেকে প্রথমে ল্যাবএইডে প্রায় তিন সপ্তাহ, পরে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ১৬ দিন এবং শেষে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ২ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন। বাঙালির গড়পড়তা বয়সের হিসাবে তিনি পরিপূর্ণ বয়সে জগতের মায়া কাটালেন।

ভাষা আন্দোলন সংঘটনে তাঁর যে অবদান, তাতে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক আহমদ রফিক কিন্তু কেবল একজন সংগঠক নন, স্রষ্টাও। বিপুল এবং বিচিত্র তাঁর সৃষ্টিজগৎ। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট যেকোনো পেশায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। বাল্যকাল থেকে বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত আহমদ রফিক সে পথে যাননি। তিনি বেছে নিয়েছেন জটিল এক পথ—লেখালেখি।

এখানে বলে রাখা ভালো, আহমদ রফিক ভালো ফল নিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে স্নাতক করলেও তিনি চিকিৎসক হতে পারেননি। ভাষা আন্দোলনে যুক্ততার ‘অপরাধে’ তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ইন্টার্নশিপের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। ফলে পেশাদার চিকিৎসক তিনি হতে পারেননি।

তাই তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। এক.

পূর্ণকালীন রাজনীতি করার মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। দুই. পূর্ণকালীন লেখালেখি করার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শাণিত করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে স্বাক্ষর রাখা। কঠিন হলেও তিনি দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছিলেন। সেই তাগিদ থেকেই পঞ্চাশের দশকে রচনা করেন শিল্প সংস্কৃতি জীবন–এর মতো সাহিত্য-সমালোচকমূলক গ্রন্থ। সমকালের আর কোনো লেখকের প্রবন্ধের বই পঞ্চাশের দশকে প্রকাশিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে অ্যাকটিভিস্ট আহমদ রফিক ভাষা আন্দোলনের সংগঠক পরিচয়ে নিজেকে আর সীমাবদ্ধ রাখেননি, নিজেকে নিয়োজিত করেছেন আরও বিস্তৃত পথে।

বিপুল এবং বিচিত্র তাঁর সৃষ্টিজগৎ। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট যেকোনো পেশায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। বাল্যকাল থেকে বামপন্থী রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত আহমদ রফিক সে পথে যাননি। তিনি বেছে নিয়েছেন জটিল এক পথ—লেখালেখি।

ভাষা আন্দোলনের অনালোকিত ইতিহাস রচনা, তাত্ত্বিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ, শহরকেন্দ্রিকতার বাইরে ভাষা আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততার কথা এবং ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার মতো গবেষণামূলক কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এখানেও তিনি নিজের জ্ঞানচর্চা ও লেখালেখিকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। আমৃত্যু প্রগতিশীল চিন্তার এই মানুষের জ্ঞানপিপাসা ছিল বিপুল। তাই ভাষা আন্দোলনের একজন সৈনিক নয়, নিজেকে সংগ্রামী মনে করতেন তিনি।

সৈনিকের কাজ লড়াই শেষে ফলাফল যা–ই হোক, তা সমাপ্ত করা। একজন সংগ্রামীর কাজ জীবনভর চলতে থাকে। তাই ভাষাকে ঘিরে তাঁর যে সাহিত্যচর্চা, তাতে রয়ে গেছে সংগ্রামের তেজ, সমাজ বিনির্মাণের নিরন্তর সাধনা। সুতরাং ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর নিজস্ব গবেষণার বাইরে তিনি বিচিত্র এক সৃষ্টিভুবন নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছেন। এমন অনেক কাজ তিনি করে গেছেন, যে কাজগুলো মূলত বিদ্যায়তনিক অধ্যাপক-গবেষকদের কাজ। এর বাইরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য নিয়ে রচনা করে গেছেন বিশের অধিক গ্রন্থ, যা দুই বাংলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভুবন যেমন বিচিত্র, তেমনি রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণার জগৎও বিচিত্র। যেমন ১৯৭৭ সালে আহমদ রফিক রচিত প্রথম রবীন্দ্রসাহিত্য-বিষয়ক গ্রন্থ আরেক কালান্তরে দিয়েই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তাদের রবীন্দ্র–সাহিত্যবিষয়ক বই। কুষ্টিয়া, শাহজাদপুরের পাশাপাশি নওগাঁর পতিসরেও ছিল রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি। তাঁর রবীন্দ্রভুবনে পতিসর গ্রন্থ প্রকাশের আগে বাংলাদেশের খুব কম মানুষের কাছেই তা পরিচিত ছিল। এভাবে পদ্মাপারের সেই গাল্পিক জাদুকর, ছোটগল্পের শিল্পরূপ: পদ্মাপর্বের রবীন্দ্রগল্প, রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ, রবীন্দ্রভাবনায় গ্রাম: কৃষি ও কৃষক, রবীন্দ্রসাহিত্যের নায়িকারা দ্রোহে ও সমর্পণে প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণয়ন।

তাই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বলতে রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলাই যায়, ‘যে-পথ দেখায়/ সে যে তার অন্তরের পথ,/ সে যে চিরস্বচ্ছ,/ সহজ বিশ্বাসে সে যে/ করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।’

রবীন্দ্র-সাহিত্যচর্চার একক নৈপুণ্যের পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে রবীন্দ্রচর্চারও পথিকৃৎ তিনি। আশির দশকে একঝাঁক তরুণসহ বিভিন্ন বয়সী রবীন্দ্র–অনুরাগীকে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র। যার মধ্য দিয়ে দুই বাংলায় সেমিনার, গবেষণামূলক প্রবন্ধপাঠসহ নানা আয়োজন করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্রের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দের কবিতা নিয়ে যেমন তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তেমনি বাংলাদেশের পঞ্চাশের দশকের বাংলা কবিতা থেকে শুরু করে শূন্য দশকের কবিদের কবিতা নিয়েও তাঁর প্রবন্ধ-আলোচনা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রচনা করেছেন বাংলাদেশের কবিতা: দশকভাঙা বিচার, কবিতার বিচিত্র ভাষ্য, কবিতা আধুনিকতা ও বাংলাদেশের কবিতা প্রভৃতির মতো সমৃদ্ধ বই।

সমাজ-রাজনীতিবিষয়ক লেখালেখিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সংগত কারণে আশি–উত্তীর্ণ বয়সে রচনা করতে পারেন দেশ বিভাগ: ফিরে দেখা, কিংবা বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল কলেবরের বই। তাই কেবল ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে নয়, ভাষামাধ্যমে সৃষ্টিশীল ও স্বকীয় ভুবন গড়ার কারণেও আহমদ রফিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক-পাঠকের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বলে বিশ্বাস করি। তাই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে বলতে রবীন্দ্রনাথের শরণ নিয়ে বলাই যায়, ‘যে-পথ দেখায়/ সে যে তার অন্তরের পথ,/ সে যে চিরস্বচ্ছ,/ সহজ বিশ্বাসে সে যে/ করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রব ন দ র স হ ত য শ র দশক রন থ র র জন ত গ রন থ

এছাড়াও পড়ুন:

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার দাবি নাগরিক কোয়ালিশনের

আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দাবি জানিয়েছে নাগরিক কোয়ালিশন। শনিবার কোয়ালিশনের এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত প্ল্যাটফর্ম নাগরিক কোয়ালিশন। বিবৃতিতে এই কোয়ালিশন বলেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়াত সম্মেলনে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য ও হুমকি দেওয়া হয়েছে। দেশের কিছু বড় ও মূলধারার রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে ভোটের প্রতিযোগিতায় তুষ্টিবাদী রাজনীতির অংশ হিসেবে আহমদিয়াদের প্রতি বিষোদ্‌গার করছে। এটি খুবই আশঙ্কাজনক ব্যাপার।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অনুরোধ করছি, এই সংকটকালে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন যেকোনো গোষ্ঠীর ব্যাপারে উচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে; বিশেষ করে যারা ধর্মকে অবলম্বন করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করে।’

দেশের অন্য যেকোনো নাগরিকের মতোই সংবিধানে আহমদিয়াদের ধর্ম পালনের অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত রয়েছে বলে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সব নাগরিকের জন্য এই অধিকার রক্ষায় আমরা অবিচল থাকব।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিসত্তা এবং ধর্মীয় পরিচয়–নির্বিশেষে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষা বিষয়ে সরব থাকা। আমরা বিশ্বাস করি, এই মৌলিক সাম্যই হতে হবে জুলাই ২০২৪–পরবর্তী বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর।’

আরও পড়ুনখতমে নবুওয়তের মহাসম্মেলন থেকে ১ দফা দাবিতে বছরজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা৮ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দক্ষ শিক্ষক নিয়োগে পিটিআইয়ে চালু হচ্ছে ১০ মাসের ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম
  • রায়ে ন্যায়বিচার হয়েছে, স্বৈরতন্ত্র রোধে মাইলফলক হয়ে থাকবে: ইসলামী আন্দোলন
  • এ রায় সামনের দিনের জন্য উদাহরণ: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • আন্দোলন যমুনা থেকে সরে গেছে, কিছুদিন পর গ্রামে নির্বাচনের কাছে দাঁড়াবে: সালাহউদ্দিন
  • ন্যায়বিচার হয়েছে, এই রায় সামনের দিনের জন্য একটা উদাহরণ: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • একই দিনে নির্বাচন-গণভোট সঠিক পদক্ষেপ: হাফিজ উদ্দিন আহমদ
  • বিএনপির প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক আটকে বিক্ষোভ
  • সিলেটে মোটরসাইকেলে এসে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দিল দুর্বৃত্তরা
  • সিলেটে মধ্যরাতে অ্যাম্বুলেন্স ও বাসে আগুন
  • আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার দাবি নাগরিক কোয়ালিশনের