মা ইলিশ রক্ষায় বরিশালে অভিযান শুরু
Published: 4th, October 2025 GMT
ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে শুক্রবার (৩ অক্টোবর) দিবাগত মধ্যরাত থেকে সারা দেশের মতো বরিশালের নদীতে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান শুরু হয়েছে। আগামী ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত নদী-সাগরে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। এ সময় ইলিশ আহরণ, পরিবহন, বিপণন ও মজুত নিষিদ্ধ থাকবে।
নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে জেলেদের সহায়তায় ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক জেলেকে ২৫ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে।
আরো পড়ুন:
নিষেধাজ্ঞার খবরে হাঁকডাকে মুখর চাঁদপুরে ইলিশের বাজার
পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেদের আগ্রাসন বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, ‘‘বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার আলোকে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মৎস্যজীবীদের মতামত ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরামর্শের ভিত্তিতে ২২ দিন সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।’’
উপদেষ্টা জানান, আশ্বিনী পূর্ণিমার আগের চার দিন ও অমাবস্যার পরের তিন দিনকে অন্তর্ভুক্ত করে মোট ২২ দিন ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান–২০২৫’ চলবে। এ অভিযানে মৎস্য কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নৌপুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অংশ নেবে।
এ সময় ৩৭ জেলার ১৬৫ উপজেলার ৬ লাখ ২০ হাজার জেলে পরিবারকে সরকারিভাবে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় সহায়তা দেওয়া হবে। পরিবারপ্রতি ২৫ কেজি করে চাল দেওয়া হবে, যা মোট ১৫ হাজার ৫০৩ মেট্রিক টন চালের সমান।
বরিশালের মেঘনা নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে নৌপুলিশ ও হিজলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার উদ্যোগে ড্রোন উড়িয়ে নজর রাখা হবে। মা ইলিশ নিধনকারীদের ধরতে মেঘনা নদীতে নজরদারির জন্য অন্তত চারটি ড্রোন ব্যবহার করা হবে। ড্রোন যেখানে ইলিশ ধরার তথ্য দেবে, সেখানে দ্রুত স্পিডবোট নিয়ে অভিযান চালানো হবে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, অভিযান পরিচালনার জন্য জেলায় ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
আরো বলা হয়েছে, বরিশাল জেলায় মোট জেলের সংখ্যা ৭৯ হাজার ৬২৩ জন। এর মধ্যে কার্ডধারী জেলে ৬৬ হাজার ৫২৪ জন। কার্ডধারী জেলেদের জন্য ১ হাজার ৬৬৩ দশমিক ১ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রত্যেক জেলে ২৫ কেজি করে চাল পাবে।
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ শিকার করলে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ লাখ জরিমানা করা হবে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, গত বছরের নিষেধাজ্ঞার ফলে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়তে পেরেছিল। এর ফলে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি জাটকা যুক্ত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
উদ্বেগ প্রকাশ করে উপদেষ্টা জানান, গত পাঁচ বছরে ইলিশ আহরণ প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে আহরণ আগের বছরের তুলনায় যথাক্রমে ৩৩ ও ৪৭ শতাংশ কমেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ইলিশ রপ্তানি প্রবণতার তথ্যও তুলে ধরেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এক দশক আগের তুলনায় অনুমোদিত পরিমাণের বিপরীতে প্রকৃত রপ্তানি ক্রমান্বয়ে কমছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে অনুমোদন ছিল ২ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন, কিন্তু রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫৭৪ মেট্রিক টন।
উপদেষ্টা জানান, ইলিশের রপ্তানি মূল্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ১২ দশমিক ৫০ ডলার। সে অনুযায়ী সম্প্রতি বেনাপোল ও আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানিকৃত ইলিশের বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকার বেশি।
ফরিদা আখতার আরো বলেন, অভিযান চলাকালে নদীতে ড্রেজিং বন্ধ থাকবে এবং জলসীমার বাইরে থেকে মাছ ধরা ট্রলারের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।
ঢাকা/পলাশ/বকুল
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ট র ক টন উপদ ষ ট বর শ ল বছর র মৎস য
এছাড়াও পড়ুন:
পরিবার পরিকল্পনায় নজর দিতে হবে
নারীর প্রজনন হারের হঠাৎ উল্টো যাত্রা আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও পরিকল্পনা যে ঠিক পথে নেই, তারই প্রতিফলন। অথচ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে যে অগ্রগতি, তার পেছনে একটা বড় কারণ জন্মহার কমানো ও স্থির অবস্থায় রাখতে পারা। ২০২৪ সালে যেখানে নারীদের মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ২ দশমিক ১৭ ছিল, সেখানে বর্তমানে এ হার ২ দশমিক ৪। স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে এমন উল্টো যাত্রা আর কখনো দেখা যায়নি।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গত রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ যৌথভাবে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০২৫ প্রকাশ করে। জরিপে যেমন উঠে এসেছে বিভাগভেদে নারীদের প্রজনন হারে পার্থক্য আছে, আবার দরিদ্র এবং কম শিক্ষিত ও নিরক্ষর নারীদের মধ্যে টিআরএফ বেশি। এ তথ্য আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে দারিদ্র্য ও বৈষম্য না কমালে এবং শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মোটেই সহজ নয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের টিএফআর ছিল ৬ বা তার বেশি। স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে জাতীয় সমস্যা বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। সরকার জনসংখ্যা কমানোকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী মানুষের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কর্মকৌশল নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সরকারগুলোও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। বেতার, টেলিভিশন, পথনাটক ও গানের মাধ্যমে কম সন্তান রাখার গুরুত্ব জনসাধারণের কাছে তুলে ধরে। সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমন্বিত নীতি ও পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ একত্র হলে যে বড় সফলতা মেলে, তার একটি ভালো দৃষ্টান্ত হতে পারে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। স্বাধীনতার পর পরবর্তী চার দশকে ধারাবাহিকভাবে টিআরএফ কমেছে। ২০১২-২০২২ পর্যন্ত সেটা ২ দশমিক ৩-এ স্থির অবস্থায় ছিল। দুই বছর পর সেটা কমে ২ দশমিক ১৭ হলেও এক বছরের ব্যবধানে অনেকটাই বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা নীতি, সেখানে টিআরএফ ২ দশমিক ১ নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ উল্টো যাত্রায় উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্বের অষ্টম জনবহুল দেশ, প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ১৫০ জনের বেশি মানুষ বাস করে। জনসংখ্যার চাপে কৃষিজমি ক্রমে কমছে, অন্যদিকে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতার কারণে দারিদ্র্য ও হতদরিদ্রের হার বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে। এ বাস্তবতায় জনসংখ্যা বেড়ে গেলে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—সবখানেই অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে।
জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে না। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে জোরালো দাবি ওঠে, সরকার কমিশনও গঠন করে। কমিশন তাদের প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিও ঠিক পথে এগোয়নি। গত বছরের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর মাঠপর্যায়ে জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রীর তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। সামগ্রিকভাবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিতে যে শিথিলতা, তার প্রভাব জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ওপর পড়েছে বলে আমরা মনে করি।
টিএফআর বেড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ঝুঁকির মুখে ফেলা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যে সাফল্য, তার উল্টোযাত্রা কেন, নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই সে প্রশ্নে গভীর মনোযোগ দিতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে হবে।