শাহরিয়ার কবিরের মুক্তি দাবি ৫ সংগঠনের
Published: 6th, October 2025 GMT
কারাবন্দী সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবিরকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে এবং তাঁর নিরাপত্তা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পাঁচটি সংগঠন।
সংগঠনগুলো হলো সাউথ এশিয়া ডেমোক্রেটিক ফোরাম, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম, ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ ইন জার্মানি, আর্থ সিভিলাইজেশন নেটওয়ার্ক (গ্লোবাল নেটওয়ার্ক), ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস অ্যালায়েন্স (গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম)।
রোববার একটি যৌথ বিবৃতিতে সংগঠনগুলো বলেছে, এক বছর ধরে ‘মিথ্যা’ হত্যা মামলায় শাহরিয়ার কবির কারাগারে বন্দী রয়েছেন। তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার রক্ষার জন্য নিবেদিত ছিলেন।
কারাগারে শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে ‘অমানবিক আচরণ’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, সম্প্রতি তাঁকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে। তিনি নিয়মিত অপমানজনক আচরণ ও মানবেতর পরিবেশের সম্মুখীন হচ্ছেন।
বন্দী অবস্থায় সাবেক মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘হুমায়ুনের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, বন্দীদের চিকিৎসা দিতে অবহেলা করলে কী ভয়াবহ ফল হতে পারে। আমরা কারাগারে এ ধরনের আরও মৃত্যু দেখতে চাই না।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কোম্পানি–সংস্কৃতি বদলাতে চাইলে আগে যার খোলনলচে বদলাতে হবে
করপোরেট অঙ্গনে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি হলো ‘সংস্কৃতি পরিবর্তন’। ব্যাংক, টেলিকম, এনজিও কিংবা নতুন স্টার্টআপ—প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই দাবি করছে যে তারা কর্মীদের জন্য আধুনিক, ইতিবাচক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করপোরেট কালচার গড়ে তুলছে।
এ উদ্দেশ্যে অফিসে ঝুলছে প্রেরণামূলক পোস্টার, ই–মেইলে আসছে অনুপ্রেরণার বার্তা, চলছে ওয়ার্কশপ, সেমিনার, এমনকি বদলের স্লোগানও উচ্চারিত হচ্ছে নানা উপলক্ষে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এসব প্রচারণা আসলেই কি সংস্কৃতি বদলায়, নাকি কেবল বাহ্যিক ইমেজ ম্যানেজমেন্টের এক সাজানো আয়োজন হয়েই থাকে?
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর ‘অর্গানাইজেশন কালচার’ বিভাগে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণায় আন্তর্জাতিক গবেষকেরা দেখিয়েছেন, সংস্কৃতি কেবল কথার মাধ্যমে গড়ে ওঠে না, এটি গড়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম বা অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ভেতর দিয়ে।
আরও পড়ুনদেশে ‘কোম্পানি শাসনের’ অবসান হবে কবে১৮ জুলাই ২০২৩প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত, পুরস্কার ও শাস্তির ধরন, নেতৃত্বের আচরণ ও নীতিমালা—এসবের মধ্য দিয়েই প্রতিফলিত হয় কোনো প্রতিষ্ঠানের আসল সংস্কৃতি।
তাই শুধু যোগাযোগ বা ঘোষণানির্ভর প্রচেষ্টা সংস্কৃতি পরিবর্তনে কার্যকর হয় না; বরং বাস্তব কাঠামোগত পরিবর্তনই হতে পারে এর প্রধান চালিকা শক্তি।
অনেক প্রতিষ্ঠান ভ্যালু-ওয়ার্কশপ আয়োজন করে, যেখানে সততা, উদ্ভাবন বা সেবার মতো মূল্যবোধ শেখানো হয়। কিন্তু একই প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদোন্নতি বা সুযোগের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিগত প্রভাব বা ঘনিষ্ঠতা কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, তখন কর্মীরা বুঝে ফেলেন, প্রতিষ্ঠানের কথার সংস্কৃতি আর বাস্তবতার সংস্কৃতি এক নয়।
এর ফলেই ভেঙে যায় আস্থা। কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। সংস্কৃতি পরিবর্তনের প্রকল্প ধীরে ধীরে ব্যর্থতার দিকে যায়। সফল সংস্কৃতি পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সিস্টেম বদলানো।
এর প্রথম ধাপ হলো নীতি ও প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা। কর্মীদের মূল্যায়ন ও পুরস্কারের প্রক্রিয়া যদি অস্পষ্ট থাকে, তাহলে আস্থা তৈরি হয় না।
কিছু ব্যাংক ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে স্বচ্ছ কেপিআই-ভিত্তিক মূল্যায়ন এবং গ্রেড-ভিত্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু করে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আরও পড়ুনপ্রতিষ্ঠান ‘ঠিকঠাক’ করতে ৫৩ মাসই কি যথেষ্ট নয়?২৪ মে ২০২৪দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বের আচরণই প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি গঠনে মুখ্য ভূমিকা রাখে। হার্ভার্ডের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, সিনিয়র নেতৃত্বের কর্মকাণ্ড প্রায়ই তাদের ঘোষিত মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
নেতৃত্ব যদি নিয়ম মেনে চলে, অভিযোগ শোনে এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখে, তাহলে কর্মীরাও বিশ্বাস করে, পরিবর্তন সম্ভব।
পুরস্কার ও শাস্তির কাঠামোও সংস্কৃতি নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক প্রতিষ্ঠান বলে তারা দলগত কাজকে গুরুত্ব দেয়, কিন্তু বাস্তবে পুরস্কৃত হয় কেবল টার্গেট পূরণকারীরা। এতে বোঝানো হয়, ‘সংস্কৃতি মানে টার্গেট অর্জন।’
বিপরীতে কিছু স্টার্টআপ টিমওয়ার্ক, উদ্ভাবনী চিন্তা, এমনকি ব্যর্থ প্রচেষ্টাকেও স্বীকৃতি দেয়, যা কর্মীদের ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা ও সৃজনশীলতা বাড়ায়।
আরও পড়ুনকোচিং বাণিজ্য থামানো কি কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪অভ্যন্তরীণ নর্মস বা রীতিনীতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অনেক প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র ও জুনিয়রের পেশাদার আচরণ এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়। কোথাও জুনিয়ররা মুখ খুলতে পারেন না, কোথাও সিনিয়ররা শুনতে অনিচ্ছুক।
হার্ভার্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, এমন পরিবেশে ৬৯ শতাংশ কর্মী ভয় ও হতাশার কারণে নেতৃত্বকে সত্য কথা বলতে এড়িয়ে চলেন। একটি ইউরোপীয় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান বেনামি ফোরাম চালু করলেও প্রান্তিক লেভেলের ৮৩ শতাংশ কর্মী সেখানে অংশ নেননি।
কারণ, তাঁরা মানসিক নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছেন এবং প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় চুপ থেকেছেন। অর্থাৎ ফরম্যাট বদলেছে, কিন্তু ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায়নি।
বিপরীতে, কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়ম রয়েছে, প্রতিটি মিটিংয়ে সবাইকে মতামত দিতে হয়। এ বাধ্যবাধকতাই অংশগ্রহণমূলক সাহসী সংস্কৃতি তৈরি করে।
সংস্কৃতি পরিবর্তন হঠাৎ ঘটে না, এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। নিয়মিত কর্মী সার্ভে, মুক্ত মতপ্রকাশের সুযোগ, গোপন মতামত সংগ্রহ এবং ফিডব্যাকের ভিত্তিতে নীতিমালা সংশোধন—এসবই ধীরে ধীরে স্থায়ী পরিবর্তন আনে।
হার্ভার্ডের গবেষণায় দেখা গেছে, সংস্কৃতি উন্নয়নের নামে নতুন সুবিধা চালুর পর ৫৭ শতাংশ কর্মী আরও হতাশ হয়েছেন। কারণ, এতে তাঁদের মনে হয়েছে, নেতৃত্ব হয়তো গভীর সমস্যাগুলো জানে না কিংবা জানলেও সেগুলো সমাধানের প্রকৃত আগ্রহ নেই।
সংস্কৃতি পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বাধা হলো কথার সঙ্গে কাজের অমিল। ২০২২ সালের পর আনুষ্ঠানিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৭২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এক বছর পরও কর্মীদের আস্থা, সম্পৃক্ততা বা ধরে রাখার হার—কোনোটিতেই উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি।
প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি কেবল কথায় বদলায় না। কর্মীরা প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত, পুরস্কার-শাস্তি, ন্যায়বিচার ও নেতৃত্বের আচরণের মধ্য দিয়েই আসল সংস্কৃতি অনুধাবন করে। তাই যোগাযোগ নয়, সঠিক সিস্টেম বদলানোই সংস্কৃতি পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। কথার বাইরে কাজেই লুকিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানের আসল পরিচয়।অনেক প্রতিষ্ঠান অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের বদলে বাহ্যিক ইমেজ ম্যানেজমেন্টে মনোযোগ দিয়েছে, ফলে কর্মীরা পরিবর্তনের বার্তাকে নিছক ‘পিআর ক্যাম্পেইন’ হিসেবে দেখেছেন।
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সংস্কৃতিও একটি বড় বাধা। অনেক প্রতিষ্ঠানে সম্পর্কভিত্তিক পদোন্নতি, সিনিয়রের কথাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়া, অযৌক্তিক চাপ ইত্যাদি প্রথা দীর্ঘদিন ধরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে স্থায়ী হয়ে আছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বৈশ্বিক সেবা প্রতিষ্ঠানে ৬৯ শতাংশ মধ্যস্তরের ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন যে সংস্কৃতি পরিবর্তনের দায়িত্ব তাঁদের ওপর চাপানো হয়েছে, অথচ মাত্র ১৪ শতাংশ মনে করেন, সিনিয়র নেতৃত্ব নিজেরাই সেই সংস্কৃতি অনুসরণ করছেন।
বাংলাদেশের পটভূমিতে সিস্টেম পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কৃতি উন্নয়নের কিছু বাস্তব দিক হলো—প্রথমত, সিস্টেম অডিট চালু করা; অর্থাৎ নীতি, মূল্যায়ন ও পুরস্কার পদ্ধতিগুলো নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করা।
দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা; শীর্ষ কর্মকর্তারা নিয়ম মেনে চললে কর্মীরা পরিবর্তনে আস্থা পাবে।
তৃতীয়ত, টিমওয়ার্কে উৎসাহ দেওয়া; ব্যক্তিগত নয়, বরং দলগত সাফল্যকেও পুরস্কৃত করা।
চতুর্থত, অংশগ্রহণমূলক নীতি গ্রহণ; কর্মীদের মতামত গুরুত্ব সহকারে শোনা এবং তা নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা।
সর্বশেষ, নিয়মিত ফলোআপ করা; কারণ, সংস্কৃতি পরিবর্তন এক দিনের বিষয় নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
অবশেষে বলা যায়, প্রতিষ্ঠানের সংস্কৃতি কেবল কথায় বদলায় না। কর্মীরা প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত, পুরস্কার-শাস্তি, ন্যায়বিচার ও নেতৃত্বের আচরণের মধ্য দিয়েই আসল সংস্কৃতি অনুধাবন করে।
তাই যোগাযোগ নয়, সঠিক সিস্টেম বদলানোই সংস্কৃতি পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি। কথার বাইরে কাজেই লুকিয়ে আছে প্রতিষ্ঠানের আসল পরিচয়।
যদি প্রতিষ্ঠানগুলো এই বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পারে, তবে তারা শুধু আকর্ষণীয় স্লোগান নয়; বরং আস্থাভাজন, বিশ্বাসযোগ্য ও স্থায়ী করপোরেট সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারবে।
এম এম মাহবুব হাসান ব্যাংকার, উন্নয়ন গবেষক ও লেখক
ই-মেইল: [email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)