বাঁ হাত মোড়ানো ব্যান্ডেজে, তা বুকের কাছাকাছি রেখে হাসপাতালের শুয়েছিল মো. আলী হোসাইন (১৫)। চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র অনুসারে, তার বাঁ হাতের কনুই ভেঙেছে। তার চিকিৎসা চলছিল রাজধানী ঢাকার জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)।

৯ অক্টোবর তার হাতে অস্ত্রোপচার হয়। সেদিন হাসপাতালে তার মা গোলাপি বেগমও ছিলেন। তিনি বলেন, শিক্ষক গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়ে তাঁর ছেলের হাত ভেঙে ফেলেছেন।  দুই মাস ধরে ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন তাঁরা। প্রথমে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে নিয়েছিলেন, সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শে ১৬ সেপ্টেম্বর নিটোরে আসেন।

আলী হোসাইনের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার শৈলদাহে (গুচ্ছগ্রাম)। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে সে সবার ছোট। গ্রামের চর শৈলদাহ কাসেমুল মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে সে।

ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আলী হোসেনের মা বলেন, গত ৪ আগস্ট শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে মাদ্রাসার শিক্ষক শহীদুল মোল্লা তাঁর সন্তানের ওপর রুষ্ট হন এবং কচার লাঠি (একপ্রকার গাছের মোটা ডাল) দিয়ে পেটান। এতে তাঁর ছেলের বাঁ হাত ভেঙে যায়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা জারি করে ২০১১ সালে। কোনো শিক্ষক তা করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, নীতিমালায় তা–ই বলা আছে।

শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি তাঁর হেফাজতে, দায়িত্বে বা পরিচর্যায় থাকা কোনো শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলা, বর্জন, অরক্ষিত অবস্থায় পরিত্যাগ, ব্যক্তিগত পরিচর্যার কাজে ব্যবহার বা অশালীনভাবে প্রদর্শন করে এবং এতে শিশুর অহেতুক দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও মানসিক বিকৃতি হয়, তাহলে ওই ব্যক্তি অপরাধ করেছেন বলে ধরা হবে। এ অপরাধের শাস্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড।

গোলাপী বেগম জানান, ঘটনার পর স্থানীয়ভাবে সমঝোতার একটি চেষ্টা করা হয়েছিল। গ্রামের ‘গণ্যমান্য ব্যক্তি’ ও  মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে কবিরাজের কাছে চিকিৎসা করানো হয়। এতে তাঁর ছেলের অবস্থার আরও অবনতি হয়। স্থানীয় একজন চিকিৎসক ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় ‘মুরব্বি’ মোতাহের মোল্লা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটির বাবা আমাকে জানায় যে শিক্ষক গাছের ডাল দিয়ে মেরে তাঁর ছেলের হাত ভেঙে দিয়েছে। তবে কারও কারও কাছে শুনেছিলাম, তার কয়েক দিন আগে গাছ থেকে পড়ে ছেলেটির হাত ভেঙে গিয়েছিল। এর সত্য-মিথ্যা জানি না। তবে যেহেতু ছেলেটিও আমাদের গ্রামের, আর মাদ্রাসাও আমাদের গ্রামের। তাই আমরা চাই, যা ঘটে গেছে, তার সুরাহা হোক।’

আলী হোসাইনের হাত আগেই ভেঙেছিল বলে দাবি করছেন চর শৈলদাহ কাসেমুল মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মো.

আলমগীর হোসাইনও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনা যতটা বড় করে বলা হচ্ছে, ততটা বড় নয়। মারধরের ঘটনা ঘটেনি। শিশুটির হাত আগেই ভাঙা ছিল।’ তার মাদ্রাসায় কোনো বেত নেই, কোনো শিশুর গায়ে হাত তোলা হয় না বলে দাবি করেন তিনি।

তবে শিশুটির বাবা অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হয় দাবি করে প্রধান শিক্ষক বলেন, ওই শিক্ষক ঘটনার পর পলাতক। তাঁকে আর চাকরিতে বহাল না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

হাত আগেই ভাঙা ছিল—এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন আলী হোসাইনের মা। তিনি বলেন, নির্যাতনের ঘটনার আগে তাঁর ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল।

বাগেরহাট জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী রাকিবুল ইসলাম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুটিকে মারধর করা হয়েছে বলে প্রাথমিক অবস্থায় আমাদের মনে হয়েছে। যদি শিশুটির হাত আগেই ভেঙে থাকে এবং শিক্ষকের কারণে ওই হাতে আবার আঘাত পেয়ে থাকলে, তা–ও অপরাধ হিসেবেই ধরতে হবে। কোনো শিক্ষক কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের মারধর বা নির্যাতন করতে পারেন না।’

ঘটনার ১৯ দিন পর পরিবারের পক্ষ থেকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮–এ যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়। ওই দিনই জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহায়তায় আলী হোসাইনকে বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮-এর সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই কিশোরের ঘটনা জানার পর পরই তারা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেন। আইনি সহায়তাও দেওয়া হয়।

ঘটনার তিন সপ্তাহ পর গত ২৬ আগস্ট চিতলমারী থানায় শিশু আইন ২০১৩–এর ৭০ ধারায় দুজনকে আসামি করে অভিযোগ করেন আলী হোসেনের বাবা মো. এসকেন্দার খান। আসামিরা হলেন মাদ্রাসার শিক্ষক মো. শহিদুল মোল্লা (৪৮) ও কর্মচারী মো. আসলাম শেখ (৪৫)।

চিতলমারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রোকেয়া খানম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তারা নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন। তবে মূল আসামি মাদ্রাসা শিক্ষক শহিদুল মোল্লা পলাতক রয়েছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

অন্য আসামি মো. আসলাম শেখকে গ্রেপ্তার করা হলেও তিনি পরে জামিনে ছাড়া পান।

অস্ত্রোপচার শেষে গত ১৪ অক্টোবর ছেলেকে নিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে গেছেন গোলাপী বেগম। অস্ত্রোপচারের স্থানের সেলাই কাটতে আবার ঢাকায় আনতে হবে ছেলেকে। এই চিকিৎসার অর্থ জোগাড় নিয়েও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন তিনি। গোলাপী বেগম বলেন, বাড়ির হাঁস ও সুপারি বিক্রির কিছু টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে সেই অর্থও খোয়ান। বড় মেয়ে সাভারে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। মেয়ে ও জামাতার সহায়তা নিয়েই চলছে চিকিৎসা।

আলী হোাসেনের মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক বলেন, এখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য শিশুটির বাবার হাতে দুই দফায় সাত হাজার এবং সমাজসেবা কার্যালয়ের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ ত আগ ই ভ ঙ প রথম আল ক ব গ রহ ট হ স ইন অপর ধ ঘটন র র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

কারাবন্দী সাংবাদিকদের মুক্তির আহ্বান জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসকে সিপিজের চিঠি

বাংলাদেশে কারাবন্দী সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)। সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংগঠনটি মুহাম্মদ ইউনূসকে লেখা এক চিঠিতে এ আহ্বান জানিয়েছে। সিপিজের ওয়েবসাইটে চিঠিটি প্রকাশ করা হয়েছে।

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে সিপিজের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় পরিচালক বেহ লি ইয়ি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠিটি লিখেছেন।

চিঠিতে বলা হয়, সিপিজের কাছে থাকা তথ্য-উপাত্ত অনুসারে বাংলাদেশে বর্তমানে হত্যার অভিযোগে চার সাংবাদিক কারাগারে বন্দী আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের ঘাটতি আছে। মনে হচ্ছে, তাদের সংবাদ প্রতিবেদন ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে প্রতিহিংসামূলকভাবে এসব মামলা করা হয়েছে।

সিপিজের চিঠিতে নাম উল্লেখ করা চার সাংবাদিক হলেন ফারজানা রূপা, শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু ও শ্যামল দত্ত। এতে বলা হয়েছে, বারবার এই সাংবাদিকদের জামিনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, সাংবাদিকদের পরিবারের সদস্যরা কাশিমপুর কারাগারের পরিস্থিতি নিয়ে যে ধরনের বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে বন্দীদের মানবাধিকার নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। তাঁরা (বন্দী সাংবাদিকেরা) ৩৬ বর্গফুট (৩ দশমিক ৩৪ বর্গমিটার) আকারের অত্যন্ত ছোট কক্ষে বন্দী আছেন। কক্ষগুলোতে দরজার পরিবর্তে ধাতব বেষ্টনী দেওয়া। এতে তাঁদের ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়, সঙ্গে রয়েছে মশার উপদ্রব। তাঁরা কংক্রিটের মেঝেতে ঘুমান, কোনো ম্যাট্রেস নেই। কারাগার থেকে সরবরাহ করা খাবারের পরিমাণ অপর্যাপ্ত। প্রায়ই সেগুলো খাওয়ার উপযোগী থাকে না।

কারাগারের চিকিৎসাসেবা পর্যাপ্ত নয় উল্লেখ করে চিঠিতে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, কারাগারে কোনো স্থায়ী চিকিৎসক নেই, নিয়মিত পরীক্ষার সুবিধা নেই এবং পরিবার থেকে সরবরাহ করা না হলে বন্দীরা ওষুধ পান না। যাঁরা ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ এবং স্লিপ অ্যাপনিয়ার (ঘুমের সময় শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা) মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের কয়েক মাস ধরে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।

২০২৪ সালের নভেম্বরে দ্য ডেইলি স্টারকে মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ওই সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচার হত্যা মামলা দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর সরকার তা বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। মামলাগুলো পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অথচ গত বছর প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার পরই ওই চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদ এবং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টির উল্লেখ করে সিপিজের চিঠিতে বলা হয়, বিচারব্যবস্থা বারবারই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্বাধীন সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার–সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা পূরণ করার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়েছে সিপিজে।

আরও পড়ুনসাংবাদিকদের নিরাপদে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করার আহ্বান সিপিজের১৭ জুলাই ২০২৪

চিঠিতে মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলা হয়, ‘আমরা আপনাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি, যা বাংলাদেশে কারাবন্দী সব সাংবাদিককে তাঁদের পরিবারের কাছে ফেরার এবং নতুন করে কাজ শুরু করার সুযোগ দেবে।’

সিপিজে মনে করে, বাস্তব সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য অতীতের চর্চাগুলো থেকে একেবারে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। অতীতের দমনমূলক কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি করা যাবে না।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যখন আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, তখন সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে সংবাদ সংগ্রহের অধিকারের প্রতি সম্মান রাখাটা সব রাজনৈতিক দলের জন্য জরুরি।

আরও পড়ুনঅধ্যাপক ইউনূসের সংস্কারের অঙ্গীকারের এক বছর পরেও কারাগারে সাংবাদিকেরা: সিপিজে০১ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ