যে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল এবং গত শতাব্দীর একটা বড় অংশজুড়ে দেশটি যে ব্যবস্থার পক্ষে গর্বের সঙ্গে কথা বলে এসেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সেই ব্যবস্থার প্রতিটি স্তম্ভকে কীভাবে এক এক করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, তা গত জানুয়ারির পর থেকে বিশ্ব হতবাক হয়ে দেখছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল নীতিগুলো হলো বাণিজ্য অংশীদারদের প্রতি বৈষম্যহীন আচরণ করা; স্থানীয় আদালতে বিদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধ মামলা হলে সেই প্রতিষ্ঠানের ন্যায়সংগত বিচার পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করা এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সনদে বেঁধে দেওয়া আইনের শাসন মেনে চলা।

এই নিয়মগুলো মানার ফলে গত ৮০ বছরে বিশ্বে বড় ধরনের উন্নয়ন হয়েছে এবং দারিদ্র্য অনেক কমেছে। এখনো অর্থনীতিবিদেরা তর্ক করেন—বিশ্ব অর্থনীতি এগোনোর প্রধান কারণ কি সত্যিই বাণিজ্য ছিল, নাকি বাণিজ্য শুধু সাহায্য করেছে?

তবে যে ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত, তা হলো বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া বা শিথিল করা (ট্রেড লিবারেলাইজেশন) এই উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আরও পড়ুনট্রাম্প তাঁর ভূ-অর্থনৈতিক যুদ্ধে হেরে যাচ্ছেন ০৭ অক্টোবর ২০২৫

এই ইতিহাস ট্রাম্পের প্রশাসন জানে। এরপরও তারা ডব্লিউটিওতে সর্বসম্মত সর্বোচ্চ শুল্কসীমা লঙ্ঘন করে দেশভিত্তিক নতুন শুল্ক আরোপ করেছে।

এটি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের বিস্মিত করাই স্বাভাবিক।

ট্রাম্প বিভিন্ন দেশকে আলাদাভাবে ডেকে বলছেন, ‘চলো, আমাদের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা করো, তাহলেই আমরা তোমার দেশের ওপর শুল্ক কমাব।’

কাজটি ভুল, কারণ আন্তর্জাতিক নিয়ম বলে, বাণিজ্যের নিয়ম সবাইকে একসঙ্গে বসে (মাল্টিলেটারালি) ঠিক করতে হবে, একেক দেশকে আলাদা করে চাপ দিয়ে নয়।

ডব্লিউটিওর নীতি অনুযায়ী, কোনো দেশ এক সদস্যকে কম শুল্ক দিলে একই নিয়ম অন্য সব সদস্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য হবে, যদি না আনুষ্ঠানিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি থাকে।

অর্থাৎ সবার জন্য সমান নিয়ম থাকতে হবে। কাউকে বাড়তি সুবিধা বা বাড়তি অসুবিধা দেওয়া যাবে না। কিন্তু ট্রাম্প একেক দেশের জন্য আলাদা শুল্কহার ঠিক করছেন, যা এই নীতির পুরোপুরি বিরোধী।

এ ছাড়া ডব্লিউটিওতে যত শুল্ক বাড়ানোর সর্বোচ্চ সীমা আগে থেকেই ঠিক করা আছে, ট্রাম্প সেই সীমা ভেঙে শুল্ক বাড়িয়েছেন।

এ কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানে না ভবিষ্যতে নিয়ম কী হবে, ফলে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

আরও পড়ুনট্রাম্প ও ব্লেয়ার গাজায় আসলে কি করতে চান০৫ অক্টোবর ২০২৫

দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনাও শুরু হয়েছে তখনই, যখন জাপানের সঙ্গে আলোচনায় পৌঁছানো হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র জাপানি গাড়ি আমদানির শুল্ক ১৫ শতাংশে নামাতে রাজি হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার গাড়ির ওপর শুল্ক এখনো ২৫ শতাংশই রাখা হয়েছে।

এমনকি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি থাকলেও সেটা কোনো নিরাপত্তা দেয়নি। ওয়াশিংটনের সঙ্গে এই আঞ্চলিক অংশীদারদেরও আলাদা করে আলোচনার টেবিলে বসতে হয়েছে।

আইনের বিকৃতি এখানেই শেষ হয়নি। শুল্ক ছাড়াও ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনায় বসা দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) করার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে।

একইভাবে ইউএস স্টিল কোম্পানিটি জাপানের নিপ্পন স্টিলকে বিক্রির অনুমোদন দেওয়ার শর্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি ‘গোল্ডেন শেয়ার’ নিয়েছে, যার মাধ্যমে করপোরেট সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভেটো দেওয়ার অধিকার পেয়েছে।

সব মিলিয়ে ট্রাম্পের বাণিজ্য দাঁড়িয়ে আছে ‘ভাগ করো শাসন করো’ কৌশলের ওপর। বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি চোখের সামনে দেখে বেশির ভাগ দেশের নেতাই মনে করেছেন, তাঁদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দসই শর্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।

আরও পড়ুনট্রাম্পের শুল্ক এক যুক্তিহীন ও ভয়াবহ উন্মাদনা২৮ জুলাই ২০২৫

এ সবকিছুই দেখিয়ে দিচ্ছে, ডব্লিউটিও সদস্যদের সমন্বিতভাবে এখনই জবাব দেওয়া জরুরি।

এ লক্ষ্যেই কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি প্রস্তাব দিয়েছেন—বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য ব্লকগুলো, বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ট্রান্সপ্যাসিফিক অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত সিপিটিপিপি একজোট হয়ে নতুন একটি বহুপক্ষীয় জোট গঠন করতে পারে।

একসঙ্গে কাজ করলে এ ধরনের জোটের দর–কষাকষির ক্ষমতা যেকোনো একক দেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি হবে।

তবে কার্নির এই প্রস্তাব বাস্তবায়নে সময় লাগবে। কারণ, দুটি বড় বাণিজ্য ব্লক আলাদা নিয়মকানুন ও মানদণ্ডে চলে।

তাই সেগুলো আগে সমন্বয় করতে হবে। ট্রাম্প যখন তাঁর প্রথম প্রেসিডেন্সির শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রকে টিপিপি থেকে সরিয়ে নেন, তখন বাকি দেশগুলো মিলে যে সিপিটিপিপি গঠন করে, সেটিই এ ক্ষেত্রে একটি কার্যকর মডেল হতে পারে।

অন্যদিকে ডব্লিউটিও সদস্যরা চাইলে নতুন একটি গ্লোবাল ট্রেড অর্গানাইজেশন (জিটিও) গঠন করতে পারে, যেখানে ডব্লিউটিওর বিদ্যমান চুক্তি-দলিল গ্রহণ করা হবে এবং বর্তমান বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

এই নিয়ম মেনে চলতে রাজি হওয়া যেকোনো দেশকে সদস্যপদ দেওয়া যাবে। যদি ইইউ ও সিপিটিপিপি দেশগুলো এতে যোগ দেয়, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়াসহ অন্য আরও অনেক দেশ এতে যুক্ত হবে বলে ধরে নেওয়া যায়।

বিশ্বব্যাপী রপ্তানির ১০ থেকে ১২ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর চীনের অংশ প্রায় ১৫ শতাংশ। যদি নতুন প্রস্তাবিত জিটিও বিশ্ববাণিজ্যের অন্তত ৬০ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তাহলে তাদের যৌথ দর–কষাকষির শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি হবে। ফলে ট্রাম্পের ‘ভাগ করো দখল করো’ কৌশল অকার্যকর হয়ে পড়বে। এমন ঐক্য হয়তো শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকেও আবার নিয়মভিত্তিক সহযোগিতায় ফিরতে বাধ্য করতে পারে।

গুরুত্বপূর্ণ হলো নতুন সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণের শর্ত যেন খুব সহজ রাখা হয়, যাতে ডব্লিউটিওর নিয়মগুলো অব্যাহত রাখা যায়। বিশ্বের বড় অংশের বাণিজ্যকারী দেশগুলো যদি একসঙ্গে দাঁড়ায়, তাহলে ডব্লিউটিওর বাস্তব কার্যকারিতা অনেকটাই টিকে থাকবে।

বিশ্বব্যাপী রপ্তানির ১০ থেকে ১২ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর চীনের অংশ প্রায় ১৫ শতাংশ।

যদি নতুন প্রস্তাবিত জিটিও বিশ্ববাণিজ্যের অন্তত ৬০ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, তাহলে তাদের যৌথ দর–কষাকষির শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি হবে।

ফলে ট্রাম্পের ‘ভাগ করো দখল করো’ কৌশল অকার্যকর হয়ে পড়বে। এমন ঐক্য হয়তো শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকেও আবার নিয়মভিত্তিক সহযোগিতায় ফিরতে বাধ্য করতে পারে।

অ্যান ও.

ক্রুগার বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক প্রথম উপব্যবস্থাপনা পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র প রস ত ব ব যবস থ ব শ বব ধরন র সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

‘নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে একদল আরেকদলকে আক্রমণ করছি’

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ঘটনাটি ঘিরে মন্তব্য করলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফারুকী এ প্রসঙ্গে আজ একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “জুলাইতে ওরা শত শত স্বাধীনতাকামী মানুষকে খুন করেছে। তারপর ভারতে পালিয়ে গিয়েও খুনের হুমকি দিচ্ছে, খুন করছে। ওদের ‘খুনের জুলাই’ চলমান। আর আমরা কি করছি? নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে একদল আরেকদলকে আক্রমণ করছি, রেটোরিকের লড়াই চালাচ্ছি। মনে রাখবেন, আমাদের অনৈক্যই খুনীদের শক্তি।’’

“এখনই সময় আবার ঘন হয়ে আসার, গোল হয়ে আসার। ফ‍্যাসিবাদীরা বিচারের মুখোমুখি হওয়া তো দূরের কথা কোনো অনুশোচনা বোধ করে নাই। বরং খুনের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এখনই সময় সিদ্ধান্ত নেয়ার-ফ‍্যাসিবাদীদের আর এক চুলও ছাড় নয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে বিনয়ের সাথে একটু খেয়াল করিয়ে দিতে চাই-আপনারা যদি কেবল ইলেকশনকেই পুলসিরাত মনে করেন মহা ভুল করবেন। বাংলাদেশের পুলসিরাত আগামী দশ বছরের লম্বা পথ। বি ওয়াইজ। অ‍্যাক্ট রেসপন্সিবলি। অ‍্যান্ড প্রটেক্ট দ‍্য ভেরি স্পিরিট অব জুলাই। লং লিভ বাংলাদেশ।” লিখেছেন ফারুকী।

তিনি আরো লিখেছেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী শক্তির প্রতি একটাই বার্তা- জুলাই আমাদের বদলে দিয়েছে চিরতরে। বাংলাদেশ আর কারো দাসত্ব করবে না। হাদী একজন না। হাদীরা হাজারে হাজার, কাতারে কাতার।’’
 

ঢাকা/রাহাত//

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ২০২৬ সালে নিজের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান? এখনই এই ৫ বিষয়ে নজর দিন
  • ‘নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে একদল আরেকদলকে আক্রমণ করছি’