সরকারি নার্সারি কি শুধু বাণিজ্যের জন্য
Published: 29th, October 2025 GMT
বাড়িতে লাগানো ছোট শালগাছগুলোর নতুন পাতা দেখেই বুঝলাম সাঁওতালদের পূজার সময় আসছে। গাছের ফুল ও পাতাই ষড়্ঋতুর পরিচয়। ঢাকার পাশেই বিশাল শালবন। সেই ঢাকা শহরের সড়ক বিভাজকে শাল লাগানো হয় না। ঢাকার ৩০০ ফিট এলাকায় সড়ক বিভাজকে এত গাছ লাগানো হয়েছে, তবু সেখানে শাল নেই। শাল নাহয় ধীরে বাড়ে, চাপালিশ তো লাগানো যেত।
গাছ দুভাবে বেড়ে ওঠে—নিজে থেকে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো আপনজালা। আরেকটি হচ্ছে বাণিজ্যিক পদ্ধতি। নার্সারিতে প্যাকেট করে চারা তৈরি। নার্সারির মাধ্যমে একই জাতের অনেকগুলো চারা একসঙ্গে সংগ্রহ করা যায় বলে শিকড় কাটা পড়ে না, তাই চারা মরে না। ফলে ব্রিটিশরা আগ্রাসী জাতের গাছগুলো পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং আপনজালা স্থানীয় গাছের জাত বিলুপ্ত হয়েছে।
যাঁরা বাণিজ্যিক গাছ লাগাতে চান, তাঁরা ব্যক্তিমালিকানার নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু সরকারি নার্সারিগুলোর তো গাছের জাত রক্ষার দায় আছে। সব গাছ তো আর আপনজালা হবে না। সরকারি নার্সারিগুলোয় কেন মেহগনি, আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, রেইনট্রি পাওয়া যায়? কারণ, ৫ হাজার চারা উৎপাদনের কথা বলে ২০ হাজার চারা উৎপাদন করা যায়। এতে বাকি ১৫ হাজার খোলাবাজারে বিক্রি করে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। এখানেও বাজারই নিয়ন্ত্রক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, যে গাছ ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়, সেই গাছ রক্ষা করার দায় সরকারি নার্সারিরই তো।দুই.
শালগাছ মধুপুর, দিনাজপুর, গারো পাহাড় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসী–অধ্যুষিত এলাকায় আমরা দেখতে পাই। কেন? সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডারা শালবনকে দেবতার নিবাস বা মা দেবী বলে মানে। এই বনকে ঘিরে ‘বনদেবী’ বা ‘জাহের থানে’ পূজা হয়।
সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব ‘কারাম পূজা’। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এই পূজা হয়। গাছের ডাল গ্রামের মাঝখানে পুঁতে দিয়ে পূজা শুরু হয়। এরপর মেয়েরা গান গেয়ে নাচে, ছেলেরা ঢাকঢোল বাজায়। সাঁওতাল, ওঁরাও ও মুন্ডা সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোয় এই গাছ পাওয়া যায়। যে গাছের নামে এত কিছু, তার নাম কারামগাছ। কারাম দেবতা ভাইবোনের বন্ধন, ফসলের সমৃদ্ধি ও সমাজের ঐক্যের প্রতীক। অথচ এ গাছও বিরল হয়ে পড়েছে।
হিন্দুরা অশ্বত্থগাছকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের আবাস বলে মনে করে। বট, নিম, আমলকী ও তুলসীও বিশেষভাবে পূজনীয়। মুন্ডা ও সাঁওতালরা আমগাছকে এত পবিত্র জানে, যুবকদের যুবতীকে বিয়ের আগে একটি আমগাছকে বিয়ে করতে হয়। তাদের সব অনুষ্ঠানেই আমের পাতা ও ডাল ব্যবহৃত হয়। সিলেটের মাধবপুরে চা–পাতা তুলতে যাওয়ার আগে নারী শ্রমিকেরা জবাগাছের তলে নিবেদন করেন। বন্য পশুদের আক্রমণ এড়িয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরার আশায় তঁাদের এই নিবেদন।
চাপালিশগাছ রেইনট্রির মতোই বিশাল হয়। বাঁচে তার চেয়েও তিন গুণ। ডালে ডালে ঝুলে থাকে কাঁঠালের মতো ফল। চট্টগ্রাম, সিলেট ও পার্বত্য অঞ্চলের আপনজালা গাছ চাপালিশ। নতুন ঘর বানানোর চাপালিশের কাঠ দেবতার নামে উৎসর্গ করা হয়। এর গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে বন দেবীর পূজা করেন গারো ও চাকমারা। অথচ এই অসাধারণ গাছ নাই হয়ে গেল প্রায়। রাঙামাটির ডিসির বাংলোতে ৩৫০ বছর ধরে একটি চাপালিশ বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। এ রকম অজস্র গাছ আছে, শুধু বাণিজ্যলক্ষ্মীর নজর পায়নি বলে তারা আপনজালাই রয়ে গেল।
গাছের চারা তৈরির প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। তাই না চাইলেও সহজে যেগুলো পাওয়া যায়, মানুষ সেগুলোই রোপণ করে। আমি বাংলাদেশের প্রায় সব কটি উদ্যান ও নার্সারিতে খোঁজ নিয়ে কোথাও কর্পূরের চারা পাইনি। চাপালিশ পেয়েছি শুধু গাজীপুরের কাশিমপুর উদ্যানে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্যান এটি। এই উদ্যানের যুগ্ম পরিচালককে এই চারাগুলো চেয়ে তালিকা দিয়েছিলাম: বৈলাম, গর্জন, ঢাকিজাম, তেলসুর, বান্দরহোলা, গুটগুটিয়া, গান্ধীগজারি, নাগলিঙ্গম, কাঠবাজনা, তিতপাই, খুদে বড়লা, জামালগোটা, মণিরাজ, রাজ অশোক ও বঁইচি। এগুলোর মধ্যে শুধু বান্দরহোলা মানে সোনালু ও মণিরাজই কেবল আছে। তাহলে বাকিগুলোর কী অবস্থা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, যে গাছ ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়, সেই গাছ রক্ষা করার দায় সরকারি নার্সারিরই তো।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি নার্সারি কি শুধু বাণিজ্যের জন্য
বাড়িতে লাগানো ছোট শালগাছগুলোর নতুন পাতা দেখেই বুঝলাম সাঁওতালদের পূজার সময় আসছে। গাছের ফুল ও পাতাই ষড়্ঋতুর পরিচয়। ঢাকার পাশেই বিশাল শালবন। সেই ঢাকা শহরের সড়ক বিভাজকে শাল লাগানো হয় না। ঢাকার ৩০০ ফিট এলাকায় সড়ক বিভাজকে এত গাছ লাগানো হয়েছে, তবু সেখানে শাল নেই। শাল নাহয় ধীরে বাড়ে, চাপালিশ তো লাগানো যেত।
গাছ দুভাবে বেড়ে ওঠে—নিজে থেকে গজিয়ে ওঠা গাছগুলো আপনজালা। আরেকটি হচ্ছে বাণিজ্যিক পদ্ধতি। নার্সারিতে প্যাকেট করে চারা তৈরি। নার্সারির মাধ্যমে একই জাতের অনেকগুলো চারা একসঙ্গে সংগ্রহ করা যায় বলে শিকড় কাটা পড়ে না, তাই চারা মরে না। ফলে ব্রিটিশরা আগ্রাসী জাতের গাছগুলো পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে এবং আপনজালা স্থানীয় গাছের জাত বিলুপ্ত হয়েছে।
যাঁরা বাণিজ্যিক গাছ লাগাতে চান, তাঁরা ব্যক্তিমালিকানার নার্সারি থেকে সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু সরকারি নার্সারিগুলোর তো গাছের জাত রক্ষার দায় আছে। সব গাছ তো আর আপনজালা হবে না। সরকারি নার্সারিগুলোয় কেন মেহগনি, আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, রেইনট্রি পাওয়া যায়? কারণ, ৫ হাজার চারা উৎপাদনের কথা বলে ২০ হাজার চারা উৎপাদন করা যায়। এতে বাকি ১৫ হাজার খোলাবাজারে বিক্রি করে দুর্নীতির সুযোগ থাকে। এখানেও বাজারই নিয়ন্ত্রক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, যে গাছ ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়, সেই গাছ রক্ষা করার দায় সরকারি নার্সারিরই তো।দুই.
শালগাছ মধুপুর, দিনাজপুর, গারো পাহাড় ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিবাসী–অধ্যুষিত এলাকায় আমরা দেখতে পাই। কেন? সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডারা শালবনকে দেবতার নিবাস বা মা দেবী বলে মানে। এই বনকে ঘিরে ‘বনদেবী’ বা ‘জাহের থানে’ পূজা হয়।
সাঁওতালদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব ‘কারাম পূজা’। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে এই পূজা হয়। গাছের ডাল গ্রামের মাঝখানে পুঁতে দিয়ে পূজা শুরু হয়। এরপর মেয়েরা গান গেয়ে নাচে, ছেলেরা ঢাকঢোল বাজায়। সাঁওতাল, ওঁরাও ও মুন্ডা সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোয় এই গাছ পাওয়া যায়। যে গাছের নামে এত কিছু, তার নাম কারামগাছ। কারাম দেবতা ভাইবোনের বন্ধন, ফসলের সমৃদ্ধি ও সমাজের ঐক্যের প্রতীক। অথচ এ গাছও বিরল হয়ে পড়েছে।
হিন্দুরা অশ্বত্থগাছকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের আবাস বলে মনে করে। বট, নিম, আমলকী ও তুলসীও বিশেষভাবে পূজনীয়। মুন্ডা ও সাঁওতালরা আমগাছকে এত পবিত্র জানে, যুবকদের যুবতীকে বিয়ের আগে একটি আমগাছকে বিয়ে করতে হয়। তাদের সব অনুষ্ঠানেই আমের পাতা ও ডাল ব্যবহৃত হয়। সিলেটের মাধবপুরে চা–পাতা তুলতে যাওয়ার আগে নারী শ্রমিকেরা জবাগাছের তলে নিবেদন করেন। বন্য পশুদের আক্রমণ এড়িয়ে নিরাপদে বাড়ি ফেরার আশায় তঁাদের এই নিবেদন।
চাপালিশগাছ রেইনট্রির মতোই বিশাল হয়। বাঁচে তার চেয়েও তিন গুণ। ডালে ডালে ঝুলে থাকে কাঁঠালের মতো ফল। চট্টগ্রাম, সিলেট ও পার্বত্য অঞ্চলের আপনজালা গাছ চাপালিশ। নতুন ঘর বানানোর চাপালিশের কাঠ দেবতার নামে উৎসর্গ করা হয়। এর গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে বন দেবীর পূজা করেন গারো ও চাকমারা। অথচ এই অসাধারণ গাছ নাই হয়ে গেল প্রায়। রাঙামাটির ডিসির বাংলোতে ৩৫০ বছর ধরে একটি চাপালিশ বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। এ রকম অজস্র গাছ আছে, শুধু বাণিজ্যলক্ষ্মীর নজর পায়নি বলে তারা আপনজালাই রয়ে গেল।
গাছের চারা তৈরির প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। তাই না চাইলেও সহজে যেগুলো পাওয়া যায়, মানুষ সেগুলোই রোপণ করে। আমি বাংলাদেশের প্রায় সব কটি উদ্যান ও নার্সারিতে খোঁজ নিয়ে কোথাও কর্পূরের চারা পাইনি। চাপালিশ পেয়েছি শুধু গাজীপুরের কাশিমপুর উদ্যানে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্যান এটি। এই উদ্যানের যুগ্ম পরিচালককে এই চারাগুলো চেয়ে তালিকা দিয়েছিলাম: বৈলাম, গর্জন, ঢাকিজাম, তেলসুর, বান্দরহোলা, গুটগুটিয়া, গান্ধীগজারি, নাগলিঙ্গম, কাঠবাজনা, তিতপাই, খুদে বড়লা, জামালগোটা, মণিরাজ, রাজ অশোক ও বঁইচি। এগুলোর মধ্যে শুধু বান্দরহোলা মানে সোনালু ও মণিরাজই কেবল আছে। তাহলে বাকিগুলোর কী অবস্থা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, যে গাছ ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে নাড়া দেয়, সেই গাছ রক্ষা করার দায় সরকারি নার্সারিরই তো।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
[email protected]