খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কেন বিতর্ক
Published: 11th, November 2025 GMT
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপ্রাপ্তি নিয়ে কিছু আলোচনা দেখা যাচ্ছে। সেগুলো কেন এবং কী উদ্দেশ্যে, সেটা নিয়েও হচ্ছে বিস্তর বলাবলি। হতেই পারে, ব্যক্তি খালেদা জিয়া বলে কথা। তাদের কথায় যুক্তির অভাব নেই—তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত, প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি হন, প্রকাশ্যে আসেন না, দলীয় প্রধানের দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পুত্র তারেক রহমানের কাছে অর্পণ করেছেন, তাঁর নির্বাচন করার দরকার কি? যুক্তি হিসেবে নেহায়েত মন্দ নয়।
পাল্টা যুক্তি হিসেবে সোজাসাপটা বলা যায়—‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একজন বাংলাদেশি হিসেবে তাঁর গণতান্ত্রিক নাগরিক অধিকার, অন্যরা বলার কে?’ এমনটা বললে পাল্টা যুক্তি একটা দাঁড়ায় বটে, এরপরেও কোনো ‘কিন্তু’ থেকে যায় কী না প্রশ্ন থেকে যায়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনার রোষানলে পড়ে খালেদা জিয়া বাড়িছাড়া হয়েছেন, নির্জন কারাবাস ভোগ করেছেন, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সব লিখিত-অলিখিত ভাষণের প্রধান আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন তিনি। খালেদা জিয়ার মৃত্যুসংবাদের প্রতীক্ষায় শেখ হাসিনা তাঁর ‘অস্থিরতা’ কখনোই গোপন করেননি।
যাক, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া দীর্ঘ বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান। এরপর কাতারের আমিরের পাঠানো এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনে গমন-প্রত্যাবর্তন আর তাঁর সঙ্গে বিমানবন্দরে যাওয়া-আসার পথে ভক্ত-সমর্থকদের জনস্রোত নিঃসন্দেহে পতিত শক্তির অন্তর জ্বালাই বাড়িয়েছে। এতটা যাও-বা সহ্যের মধ্যে ছিল, নির্বাচনে তাঁর অংশগ্রহণের খবরে তাঁদের প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা সাধারণের কাছে অস্পষ্ট থাকেনি মোটেও।
আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার নিজের মতো করেই প্রত্যাবর্তন০৭ মে ২০২৫নির্বাচনের ইতিহাস কী বলে১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ অনুমোদিত পাঁচটি আসনে নির্বাচন করেছিলেন—বগুড়ার দুটি আসন (৬, ৭), ঢাকার একটি আসন (ঢাকা-৯), ফেনী-১, চট্টগ্রাম-৮ থেকে—জয়ী হয়েছিলেন পাঁচটিতেই। বলাবাহুল্য, সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা তিনটি আসনে নির্বাচন করেছিলেন এবং ঢাকায় তখনকার উদীয়মান নেতা সাদেক হোসেন খোকার কাছে প্রায় ২০ হাজার ভোটে ও ততোধিক অপরিচিত মেজর (অব.
১৯৯৬-এর নির্বাচনেও খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন—বগুড়া (৬, ৭), ফেনী-১ লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১ থেকে। বলাবাহুল্য, তিনি পাঁচটি আসনেই বিজয়ী হয়েছিলেন বিপুল ভোটে। ২০০১-এর নির্বাচনেও খালেদা জিয়া বগুড়া-(৬, ৭), খুলনা-২, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২—এই পাঁচ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব কটিতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন, যেখানে শেখ হাসিনা চার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন রংপুর-৬, নড়াইলের ২টি আসন ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে। বলাবাহুল্য, এবারেও তাঁর সফলতার হার ৫০ শতাংশ ছাড়ায়নি। অর্থাৎ একান্তই অপরিচিত রংপুরের নূর মোহাম্মদ মণ্ডল ও নড়াইলের শহিদুল আলমের কাছে তাঁকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।
২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন একজনের জন্য সর্বোচ্চ তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নির্ধারণ করলে খালেদা জিয়া সেবার বগুড়া (৬, ৭) ও ফেনী-১ আসন থেকে নির্বাচন করে শতভাগ সফলতা অর্জন করেছিলেন। এমনকি ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচনেও খালেদা জিয়া প্রার্থিতার আবেদন করেছিলেন; কিন্তু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার রেকর্ডকে থামিয়ে দিতে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে খালেদা জিয়াই একমাত্র উদাহরণ, যিনি এযাবৎ চারটি সংসদীয় নির্বাচনে ১৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শতভাগ সফলতা পেয়েছেন। বিপরীতে শেখ হাসিনার বিজয়ের রেকর্ড তাঁকে যতটা সমৃদ্ধ করেছে, তার চেয়েও বেশি বিব্রত করেছে পরাজয়ের গ্লানি।
আরও পড়ুনখালেদা জিয়ার ভাষণ যে পার্থক্য দেখাল০৬ মার্চ ২০২৫সামনের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা‘এবারের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা কেন’—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। অনেকেই বলবেন, দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত খালেদা জিয়া যেখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের জায়গা ছেড়েছেন অনেক আগেই, জনসমক্ষে তাঁর সর্বশেষ আবির্ভাবও বেশ অতীত এখন। তারপরও তাঁর নির্বাচনে প্রার্থিতা এবং একটা-দুটো নয় তিন-তিনটি আসনে, কারণটা কী? একটা প্রশ্ন করা যাক, খালেদা জিয়া কি এখন একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ? নাকি তার চেয়ে বেশি অন্য আর কিছু? এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব কোনো পরিকল্পিত ঘটনা তো ছিল না!
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদত বরণের পরও তিনি ছিলেন অন্তঃপুরে, রাজনীতির মাঠ থেকে যোজন দূরত্বে। বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হলেন; কিন্তু তাঁকে হটিয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন, একেবারে ছক কষে। দেশ স্বৈরাচারের কবলে পড়ল। শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়; দেশের রাজনীতিতে তখন ঘোর অমানিশা। ‘রাজনীতিতে শেষ কথা নেই’—এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে এরশাদ তখন দলছুটের রাজনীতিকে প্রায় ‘শিল্পের’ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ঠিক তখনই সবার চাপে খালেদা জিয়ার আবির্ভাব—অতি সাধারণ অভিষেক।
আরও পড়ুনখালেদা এখনো যেভাবে বিএনপির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক১৩ জানুয়ারি ২০২৫অকাল বৈধব্যের শোক আর বেদনা সহনীয় হওয়ার আগেই প্রায় এক দশকের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেন। এল ১৯৯১-এর জাতীয় নির্বাচন। অতীতে যিনি কখনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগই পাননি, তিনি শুধু সংসদ সদস্যই নন, প্রথম নির্বাচনেই হলেন প্রধানমন্ত্রী, দেশের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। তিন দলীয় জোটের অলিখিত রূপরেখা বাস্তবায়ন করলেন অঙ্গীকার রক্ষার সততা থেকে। দেশ রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে রূপান্তরিত হলো সংসদীয় গণতন্ত্রে। ১৯৯৬-তে স্থাপন করলেন আরেকটি অসাধারণ কীর্তি। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সংবিধানে যুক্ত করলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।
২০০১-২০০৬ সালের সরকারের মেয়াদকাল শেষে এক-এগারোর সরকারের হঠকারিতায় হলেন কারারুদ্ধ। তারপরের ঘটনা আমাদের কারও অজানা নয়। আওয়ামী শাসনের চরম শিকার হলেন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে। হারালেন কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমানকে। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমান হলেন দেশছাড়া। আর তিনি রইলেন মাটি কামড়ে এই বাংলাদেশে। দেশ থেকে গণতন্ত্র হলো নির্বাসিত, ২০১৪-র ভোটারবিহীন নির্বাচনে জনরায় প্রত্যাখ্যাত হলো, ২০১৮ সালে হাসিনার কারাগারে হলেন অন্তরিন। পরিত্যক্ত বিশাল নির্জন কারাগারে থেকেই দেখলেন আঠারোর নৈশভোট। অসুস্থতা নিয়ে নীরবে হজম করলেন কটাক্ষ—‘এই শুনি যায় যায়’, ‘এই শুনি মরে মরে’।
দেশের মানুষের জন্য সর্বস্ব নিবেদন করা সুস্থ একটা মানুষ কারাগার থেকে ফিরলেন লিভারের দুরারোগ্য অসুস্থতা নিয়ে। আজ জাতির সামনে সুযোগ সেই অপমান আর কটাক্ষের সমুচিত জবাব দেওয়ার এবং সেটি হতে পারে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই। আজ সুযোগ এসেছে তাঁকে সম্মানিত করার। তিনি কতটা অসুস্থ, সেটা আজ মানুষের কাছে বিচার্য নয়, নির্বাচনে তিনি গণসংযোগ করবেন কি না, জনসংযোগ করবেন কি না—সেটা নিয়েও মাথাব্যথা নেই কারও; বগুড়া, দিনাজপুর আর ফেনীর মানুষই শুধু নয়, এই তিন প্রতীকী আসনই আজ যেন সারা বাংলাদেশ।
অতীতের ফলাফলের হিসাব থেকে আমরা তো জানিই যে তাঁর পরাজয়ের কোনো রেকর্ড নেই। এবারেও সেটার ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা যখন শূন্য, তখন প্রাপ্য এই সম্মান থেকে কেন তাঁকে বঞ্চিত করব আমরা?
অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল
ই–মেইল: [email protected]
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষ ট রপত কর ছ ল ন র র জন ত রহম ন সরক র করল ন
এছাড়াও পড়ুন:
জীবনের একটা বড় শখ ছিল ভর্তি পরীক্ষা দেব: তাসনিয়া ফারিণ
আমার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম ছোট জেলা—মেহেরপুরে। এরপর কক্সবাজার, পাবনা, অনেক জায়গায় থাকা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি তখন, একদিন বারান্দায় বসে বসে পত্রিকা ওলটাচ্ছি। শেয়ারবাজারের পাতায় একটা ছোট বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল—হলিক্রস স্কুলের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি। দেখে মায়ের কাছে গিয়ে বায়না ধরি, জীবনে প্রথমবারের মতো ভর্তি পরীক্ষা দিতে চাই।
মানুষের জীবনে কত অদ্ভুত শখই তো থাকে। আমারও সে রকমই একটা শখ ছিল—ভর্তি পরীক্ষা দেব। বায়না ধরার পর মা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। আমি পরীক্ষা দিই। সৌভাগ্যবশত, সুযোগ হয় হলিক্রস স্কুলে।
সেটা ছিল আমার জীবনের প্রথম সফলতা। সফলতার স্বাদ পাওয়ার পর আমার জীবনের প্রথম ‘রিয়েলিটি চেক’টাও পাই। কারণ, (পরের পথটা) যতটা সহজ মনে হয়েছিল, ততটা নয়। ঢাকায় আসার পর নিজেকে মনে হচ্ছিল স্মল ফিশ ইন আ বিগ পন্ড (বড় পুকুরের ছোট মাছ)।
অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিণ