পশ্চিমাদের উচিত সিরিয়াকে নিজের মতো এগোতে দেওয়া
Published: 13th, January 2025 GMT
৩ জানুয়ারি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক ও ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল ব্যারোট সিরিয়ার অন্তর্বর্তী নেতা আহমেদ আল-শারার সঙ্গে দেখা করতে দামেস্কে যান। আরব বিশ্বের অন্যতম সহিংসতাপ্রিয় সরকার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বাথিস্ট একনায়কত্বের আকস্মিক পতনের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে এই সফর হলো।
সিরিয়া-ইউরোপ সম্পর্কের আলোচ্য সূচিতে অগণিত বিষয় রয়েছে। আলোচনা অন্তত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, যুদ্ধোত্তর ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন, শরণার্থী সংকট ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ নেই। তবুও বেয়ারবকের সঙ্গে হাতে হাত মেলানোর পরিবর্তে মুসলিম ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী আল-শারার মাথা নাড়িয়ে অভিবাদন জানানোর বিষয়কেই পশ্চিমা মিডিয়া বড় খবর হিসেবে বেছে নিয়েছে। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের পণ্ডিতরা এই ঘটনাকে ‘কেলেঙ্কারি’ ও ‘অপমানজনক’ বলে চিহ্নিত করেছেন।
পলিটিকোর এক সম্পাদকীয় এতদূর পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছে, করমর্দন তথা হাতে হাত লাগানো খুব বড় বিষয় না হলেও, সেটাই একজন মুসলিম নেতা আসলে কতটা ‘মধ্যপন্থি’ তার ‘লিটমাস টেস্ট’ হতে পারে। অন্তর্ভুক্তির নামে পলিটিকোর এ লেখাটি ধর্মীয় রীতি যাই বলুক, আল-শারার মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিম পুরুষ নেতাদের নারীদের সঙ্গে নির্বিশেষে হাত মেলাতে বাধ্য করা উচিত বলে মত দিয়েছে। অন্যথায়, এটি পশ্চিমের ‘অশনিসংকেত’ হিসেবে দেখা উচিত। পুরোনো প্রবাদে বলা হতো– ‘রোমে থাকাকালীন রোমানদের মতো থাকুন’। বর্তমানে তা হয়েছে– ‘সিরিয়ায় থাকাকালীন জার্মান ও ফরাসিদের মতো আচরণ করুন।’ একজন সিরীয় আমেরিকান হিসেবে যার বাবা সিরিয়া থেকে ৪৬ বছরের জন্য নির্বাসিত হয়েছিল এবং যার পারিবারিক বন্ধুরা আল-আসাদ সরকার দ্বারা নির্যাতিত এবং নিহত হয়েছে, আমি সেই আরব নেতৃত্বের জন্য তৈরি পশ্চিমা ‘লিটমাস টেস্ট’-এর মধ্যে স্ববিরোধ ও আক্রমণাত্মক কিছু খুঁজে পেয়েছি।
মিডিয়ার এ ক্ষোভ কোথায় ছিল, যখন ব্রিটিশ রাজকীয় প্রিন্স এডওয়ার্ড ব্যাখ্যা করেছিলেন, তিনি সাধারণ ব্রিটিশদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে অশারীরিক যোগাযোগ পছন্দ করেন? ব্যক্তিগত অগ্রাধিকার বলে কোনো কিছুকে উদার হয়ে বিবেচনা করা এবং ধর্মীয় বিষয় হলে তার বিরুদ্ধে রাগ দেখানো কি আমাদের উচিত?
এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, পশ্চিমা মিডিয়া মুসলিম আরব নেতাদের ‘মধ্যপন্থি’ সার্টিফিকেট দিতে নতুন লিটমাস টেস্ট ঠিক করতে গিয়ে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। গত কয়েক দশক ধরেই তারা তা করছে। নৃতাত্ত্বিক লিলা আবু-লুঘোদ তাঁর ‘মুসলিম মহিলাদের কি সুরক্ষা প্রয়োজন’ বইতে যুক্তি দিয়েছেন, পশ্চিমের একটি ধারণা হলো, ‘উদার সংস্কৃতির একটা সাংস্কৃতিক আদর্শ থাকবে এবং এটি সর্বজনীন মানদণ্ড হিসেবে থাকা উচিত, যার দ্বারা সমাজগুলোর অবস্থান বিচার করা যায়। আর যারা এই দরজার বাইরে পড়বে, তারা বর্বর বলে চিহ্নিত হবে।’ ‘চরম’ হিসেবে মুসলিম ধর্মীয় রীতিনীতিকে চরিত্রায়ণ একটি আধিপত্যবাদী বয়ানের লক্ষণ, যার দ্বারা পশ্চিমা নিয়মকে সর্বজনীনতার মুখোশ পরানো হয়। যারা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ ও লালন করেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ হলো, পশ্চিমা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ততটা প্রভাবশালী নয়, যতটা তারা কল্পনা করতে চান। মুসলিম ও আরবদেরও কর্তাসত্তা রয়েছে। এটি হলো পশ্চিমের প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা অস্বীকার করার পরও তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ পালন করার কর্তাসত্তা।
সিরিয়াবাসীকে ৬১ বছর ধরে কর্তৃত্ববাদী বাথিস্ট শাসনের অধীনে নৃশংস দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে আল-শারার পোশাক বা ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারের মতো তুচ্ছ বিষয়গুলোর ওপর মিডিয়ার অতিরিক্ত জোর দেওয়া নতুন কিছু নয়।
নতুন নেতৃত্বের মূল্যায়নে সিরিয়াবাসীর নিজস্ব ‘লিটমাস টেস্ট’ রয়েছে। যেমন গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা জোরদার করা, বেসামরিক অবকাঠামো পুনরুদ্ধার ও উন্নত করা, সিরিয়ানদের একত্রিত করা ও সাংবিধানিক অধিকারের সুরক্ষা দেওয়া; সরকারের পুরুষ সদস্যরা নারীদের সঙ্গে হাত মেলাবেন কিনা তা নয়। সবচেয়ে জরুরি হলো, সিরীয়বাসী তাদের নতুন নেতৃত্বে দেশকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। পশ্চিমা মিডিয়া যদি সিরিয়াকে সঠিক পেতে চায়, তবে তাদের নিজেদের চেহারা দেখতে হবে। আর স্বীকৃতি দিতে হবে, কীভাবে তাদের বক্তৃতা ও ধ্যান-ধারণা কয়েক দশকের আধিপত্যবাদী পক্ষপাত দ্বারা রূপান্তরিত হয়েছে। আরব নেতাদের ওপর পশ্চিমা ‘লিটমাস টেস্ট’ চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে সিরিয়াবাসীকে জিজ্ঞেস করা উচিত, তারা তাদের নেতৃত্বে কী চায়।
হাদিয়া মুবারক: কুইন্স ইউনিভার্সিটি অব শার্লটের ধর্মবিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে প্রপাগান্ডার সয়লাব
ট
১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন তৎকালিন বাকশাল সরকার চারটি পত্রিকা সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। এতে হাজারো সাংবাদিক রাতারাতি বেকার হয়ে দুঃসহ জীবনে পতিত হন। জনগন সঠিক তথ্য ও বস্তুনিষ্ঠ খবর জানা থেকে বঞ্চিত হয়। গোটা দেশে যেন অন্ধকার নেমে আসে। জবরদস্তিমূলকভাবে তখন সাংবাদিক ও অন্যান্য পেশাজীবীদেরকে বাকশালে যোগদানে বাধ্য করা হয়।
অনেক সাংবাদিক সেদিন জীবন-জীবিকার ভয়ে বাকশালের ফরম পূরণ করেন। তাই সংবাদমাধ্যম ও বাক-স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত। আজ দিবস আর কালো নেই। তথ্য প্রবাহের যুগে এখন মন খূলে লেখা যায়, প্রচার করা যায়। বিশেষ করে গেলো বছরের ৫ আগষ্টে ফ্যাসিবাদের পতনের পর গনমাধ্যমে অনেকটা স্বাধীনতা বেড়েছে। গণভবনের তেল তেলা তোষামদি প্রশ্ন এখন আর চলে না। বলা চলে গণমাধ্যম বিগত ১৬ বছরের চাইতে এখন বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। তবে একটা প্রশ্ন রয়েই গেছে তা হলো পেশাদার কিছু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে । এসব মামলা বেশির ভাগই আক্রোশের কারনে হয়েছে। বাদীকে না জানিয়ে একটা মহল মামলায় সাংবাদিকের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটা নিন্দনীয়। একজন সাংবাদিক মানুষ খুনের মামলার আসামী এটা মেনে নেয়া দুস্কর ।
৫ আগষ্টে আগে যারা তোষামদি করতো , সঠিক সংবাদ লিখতে কিংবা প্রচার করতো পারতো না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দোহাই দিয়ে যারা গনমাধ্যমের কন্ঠ রোধ করে রেখেছিল তাদের ভয়ে আতংকে থাকতো। তাদের অনেকে এখন গনমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে মিথ্যা প্রপ্রাগান্ডা চড়াচ্ছে। গনহত্যাার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি একটা দলের প্রতি বিশেষ দরদ দেখিয়ে মিথ্যা তথ্য চড়াচ্ছে। অনেকে তাদের ফেসবুকে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। যাচাই বাছাই ছাড়া মিথ্যা তথ্য শেয়ার করছে। তাদের এখনই থামা দরকার। সত্য প্রকাশ করা একজন সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব । এ পেশাগত দায়িত্বের কেউ অপব্যবহার করলে মুলত তিনিই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। একসময় তার মিথ্যা সংবাদ পরিবেশের কারনে কেউ তার পাশে আর থাকবেন না। তাকে পেশাদার সাংবাদিক নয়, একজন দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আস্তুাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন।
পেছনের কথায় ফিরে আসি, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন সংবাদ পত্রের কালো দিবস পেরিয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার অভাবনীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর সাংবাদিকদের লেখার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করেন।
জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সব কালাকানুন শিথিল করে দেশের সব জায়গা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশে উৎসাহ প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, প্রকাশিত সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা সরকারেরই দায়িত্ব বলেই তিনি মনে করতেন। তিনি রাজশাহী থেকে ‘দৈনিক বার্তা’ নামে একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এ পত্রিকা ঘিরে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটে। বহু সাংবাদিকের কর্মসংস্থান হয়।ডিক্লারেশনের শর্ত শিথিল করার কারণে সে সময় ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয়, জেলা এমনকি থানা পর্যায় থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশ হতে থাকে। এসব পত্রিকা টিকিয়ে রাখতে জিয়াউর রহমান সরকারি বিজ্ঞাপন বণ্টননীতিও শিথিল করেন। বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বণ্টন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন। একই সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের ৬০ ভাগ ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় এবং বাকি ৪০ ভাগ মফস্বল থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। এর ফলে সারা দেশে সংবাদপত্র প্রকাশনায় নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই প্রথম টার্গেট করে সংবাদমাধ্যমকে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেও একই পথে হাঁটে দলটি। গত প্রায় ১৫ বছরে আমার দেশ, দিনকাল, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, সিএসবিসহ জনপ্রিয় সংবাদপত্র, বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে কয়েক হাজার সাংবাদিককে বেকারত্বের মুখে ঠেলে দিয়েছিল । ৬০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে। একের পর এক কালাকানুন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। কথায় সাংবাদিক গ্রেফতার তখন নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সাংবাদিক পরিচয়ে একদল চাটুকার আওয়ামীলীগের দু:শাসনের মদদ দিয়ে জাতির উপর জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়েছিল। ছাত্রজনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ পতনে মানুষ যেমন স্বস্তি ফিরে পেয়েছে তেমনি গণমাধ্যম ফিরেছে অবাধ স্বাধীনতায়।
লেখক : সাবেক প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)