সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ঢেলে সাজানোর আহ্বান নাগরিক কমিটির
Published: 14th, January 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকার অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪-এর খসড়ার সমালোচনা করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। কমিটি বলেছে, পূর্বসূরি আইনগুলোর পুরোনো-ঔপনিবেশিক যুগের ধারণা উত্তরাধিকার সূত্রে এই খসড়ায় গ্রহণ করা হয়েছে। খসড়া নিয়ে থাকা উদ্বেগের সমাধান না হলে ক্ষমতার অপব্যবহার ও মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় অধ্যাদেশটি ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছে কমিটি।
গতকাল সোমবার রাতে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিনের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়। গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদন দেয়।
বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল ও সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে নাগরিক কমিটি। তবে কমিটি বলেছে, অনুমোদিত সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়ার ব্যাপ্তি, উদ্দেশ্য ও অপব্যবহারের আশঙ্কা নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এটি তার পূর্বসূরি আইনগুলো থেকে পুরোনো ও ঔপনিবেশিক যুগের ধারণাগুলোকে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করেছে।
নাগরিক কমিটি বলেছে, খসড়ায় ‘ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধ’ ও ‘অশ্লীল’-এর মতো শব্দের অন্তর্ভুক্তি ঔপনিবেশিক যুগের দণ্ডবিধি ১৮৬০ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। এই শব্দগুলো বিস্তৃত ও ব্যক্তিপর্যায়ের ব্যাখ্যার সুযোগ দেবে। ধারার অপব্যবহারের পথ সুগম করবে। খসড়ায় ব্যবহৃত, ‘শৈল্পিক’ বা ‘শিক্ষাগত মূল্য’–সম্পর্কিত অস্পষ্ট ভাষা কার্টুনিস্ট, শিল্পী ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করা অধিকারকর্মীদের জন্য বড় হুমকি তৈরি করবে, যা সৃজনশীলতা, ভিন্নমত প্রকাশ ও গঠনমূলক সমালোচনাকে দমন করতে পারে।
অধ্যাদেশের খসড়ার ৮ ধারায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) আধেয় (কনটেন্ট) ব্লকের ক্ষমতা দেওয়ার সমালোচনা করেছেন নাগরিক কমিটি। তারা বলেছে, বহু বছরের সমালোচনার পরও বিটিআরসির দায়িত্বের সঙ্গে একত্র করে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা সংস্থার মহাপরিচালককে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তিনি ‘অখণ্ডতা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ন’ হওয়ার মতো অস্পষ্ট ভিত্তিতে বিষয়বস্তু ব্লক বা অপসারণের অনুরোধ করতে পারেন। এ শব্দগুলোর কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকায়, তা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত এবং সম্ভাব্য অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া অধ্যাদেশটি তথ্য ব্লক বা অপসারণ করার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নাগরিক কমিটি বলেছে, অধ্যাদেশের খসড়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সন্দেহের ভিত্তিতে পরোয়ানা ছাড়া যেকোনো স্থানে প্রবেশ, তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহারকারীর কাছ থেকে ট্রানজিট ডেটাসহ যেকোনো তথ্য চাওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই বিধানগুলো সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন করে। আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করে। অতীতে এ ধরনের আইনের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে।
নাগরিক কমিটি আরও বলেছে, কম্পিউটার–সংক্রান্ত অপরাধ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোকে মতপ্রকাশসংক্রান্ত অপরাধের সঙ্গে এক করার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি অনলাইন–জগতের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা আইনের উদ্দেশ্যকে দুর্বল ও অস্পষ্ট করে তোলে।
খসড়াটি পুনর্বিবেচনা করে একটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনার মাধ্যমে আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে নাগরিক কমিটি। তারা বলেছে, অধ্যাদেশ প্রণয়নে নিযুক্ত পরামর্শকদের পরিচয় ও যোগ্যতা প্রকাশ করা উচিত, যাতে জনসাধারণের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
নাগরিক কমিটি বলেছে, সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীন কোনো মামলাকে বাতিল বা নিষ্পত্তি করেনি। ভুক্তভোগীরা আজও ভোগান্তি পোহাচ্ছেন।
নাগরিক কমিটি বলেছে, পূর্বের আইন ও এই খসড়ার উদ্বেগগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সেন্সরশিপের সংস্কৃতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এটি জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে সম্মান করতে ব্যর্থ হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্তাবিত রাজস্ব নীতি বিভাগে সচিব হিসেবে শুল্ক ও কর কর্মকর্তা পদায়নের দাবি
উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশের চূড়ান্ত খসড়ার কিছু অংশে আপত্তি জানিয়ে মতামত দিয়েছে ঢাকার বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন। প্রস্তাবিত রাজস্ব নীতি বিভাগে লোকবল নিয়োগের শর্ত নিয়ে তাদের এই আপত্তি। গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা এই আপত্তি জানিয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি সাতটি বিষয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের সভায় রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদিত হয়।
গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন অধ্যাদেশের যেসব বিষয়ে নিজেদের মতামত দিয়েছে, সেগুলো হলো—এক, বিসিএস (কর) অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য হতে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব নিয়োগের মতামত প্রদান করেছিল। কিন্তু খসড়ার অনুচ্ছেদে (৪২৩) ‘উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব নিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। এতে রাজস্ব নীতি প্রণয়নে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি মর্মে প্রতীয়মান। রাজস্ব নীতি প্রণয়নে কর রাজস্ব আহরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রাজস্ব নীতি বিভাগের শীর্ষ পদে পদায়ন করা হলে রাজস্ব বিভাগকে পৃথক করার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
দুই, রাজস্ব নীতি বিভাগের মৌলিক পদগুলো বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডার থেকে পূরণের প্রস্তাব করা হলেও খসড়ায় আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা, আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা থেকে পূরণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের রাজস্ব নীতি বিভাগে সুনির্দিষ্টভাবে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি।
তিন, খসড়ার অনুচ্ছেদ ৯-এ রাজস্ব নীতি বিভাগে জনবল পদায়নের সুপারিশের লক্ষ্যে একটি কমিটির কথা উল্লেখ থাকলেও ধারা ৪(৪)–এ এমন কোনো কমিটির উল্লেখ নেই। উক্ত কমিটির গঠন উল্লেখ করা প্রয়োজন।
চার, খসড়ায় রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ যুক্ত করা হয়েছে। এ বিধান রাখায় নীতি বিভাগকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যক্রম তদারকির সুযোগ থেকে যায়। এক বিভাগের কার্যক্রম সমমর্যাদাসম্পন্ন অপর বিভাগ কর্তৃক পরিবীক্ষণের বিধান রাখা হলে তা আইনের দৃষ্টিতেও সাংঘর্ষিক বিবেচিত হয়।
পাঁচ, খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৩)–এ বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে রাজস্ব আহরণে ন্যূনতম ২০ বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পালাক্রমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিব হিসেবে নিয়োগ প্রদান—এই ধারা পরিবর্তনে রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে কর-রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত করবে।
ছয়, খসড়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পদস্থ রয়েছেন, যা তাঁদের নির্ধারিত পদ।
সাত, সরকার গঠিত রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন অন্য সংস্কার কমিশনের মতো জনসমক্ষে প্রকাশ করা সমীচীন বলে বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
এর আগে ২৬ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) অনুষ্ঠিত হয়। অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে সভায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাকাএভ) নির্বাহী কমিটির একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিল।