জরুরি পরিষেবা নেই কষ্টেরও শেষ নেই
Published: 20th, January 2025 GMT
ভূমি, পোস্ট অফিসসহ অধিকাংশ জরুরি সরকারি পরিষেবা নেই। একমাত্র পাকা সড়কটিও জরাজীর্ণ। চিকিৎসার জন্য একটি ইউপি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও নেই জনবল। ন্যূনতম নাগরিক সেবা না থাকায় ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চরসাদিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।
পদ্মা নদীর তীরঘেঁষে ১৯৯৮ সালে গঠিত চরসাদিপুর ইউনিয়ন। সেখানে ৯টি গ্রামে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের জন্য রয়েছে একটি ইউপি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চারটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা ও চারটি বেসরকারি কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ এবং জেলা শহর থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে। উত্তর ও পশ্চিমে রয়েছে পাবনার হেমায়েতপুর ও দৌগাছি ইউনিয়ন।
পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে জেলা ও উপজেলা শহরে চলাচল করেন চরসাদিপুরের বাসিন্দারা। নদীর কারণে নেই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ইঞ্জিনচালিত নৌকা। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীর অধিকাংশ জুড়ে চর জাগে। তখন ইজিবাইক, মোটরসাইকেল এবং হেঁটে যাতায়াত করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এক যুগ ধরে সংস্কারের অভাবে চলাচলের একমাত্র পাকা সড়কটিও খানাখন্দে ভরা। লেনদেন ও সঞ্চয়ের জন্য অন্যান্য ইউনিয়নে সরকারি- বেসরকারি একাধিক ব্যাংক থাকলেও চরসাদিপুরে নেই একটিও। দুর্গম এলাকা হলেও নেই পুলিশ ক্যাম্প।
গত রোববার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত পদ্মা নদীর চার কিলোমিটারজুড়ে চর জেগেছে। মানুষ দুই কিলোমিটার নদী নৌকায় এবং চরে ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ও হেঁটে চলাচল করছেন। ফসলের মাঠে গড়ে উঠেছে অংসখ্য ইটভাটা। ভাটায় আইন ভেঙে পোড়ানে হচ্ছে কাঠ। কৃষিজমি ও নদীর তীর থেকে কাটা হচ্ছে মাটি ও বালু। ইউনিয়নে যোগাযোগের একমাত্র পাকা সড়কটিও খানাখন্দে ভরা। এতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মানুষ।
৩৫ বছর ধরে নদীতে মাঝির কাজ করেন আলাই শেখ। তিনি বলেন, চরসাদিপুরের
মানুষ বর্ষা মৌসুমে শুধু নৌকা এবং শুষ্ক মৌসুমে নৌকা ও বিভিন্ন যানবাহনে নদী পার হয়ে চলাচল করে। এতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
‘শুনি সরকার কতকিছু বরাদ্দ দেয়, কিছুই চরবাসী পায় না। সব থাকে যায় নদীর ওপারে। কোনো সেবাই পার হয় না নদী। ৩০ হাজার মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়েছে এক পদ্মা।’ আক্ষেপ করে বলছিলেন সাদিপুর বাজারের পল্লি চিকিৎসক শহিদুল আলম।
ইজিবাইক চালক কোমল হোসেন জানান, সাদিপুরের একমাত্র পাকা সড়কটি ইটভাটার গাড়ির দখলে। খানাখন্দে ভরা সড়কে প্রায়ই গাড়ি উল্টে যায়। সড়কটি দ্রুত সংস্কারের দাবি জানান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র নদীর ওপারে হওয়ায় সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না শিক্ষার্থীরা। ভাড়া বাসায় থেকে পরীক্ষা দেওয়া ব্যয়বহুল। সে জন্য অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে অনেক শিক্ষার্থী পাবনার স্কুলে চলে যায়।
চরসাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো.
চরসাদিপুরবাসীর দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে ইউএনও এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, পদ্মার দুর্গম চরে অবস্থিত ইউনিয়নটি। নানামুখী সুবিধা থেকে বঞ্চিত সেখানকার মানুষ। জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টি লিখিতভাবে জানালে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: একম ত র প ক র একম ত র র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আজও আঁধার কাটেনি কোচদের
বন্যহাতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি, বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাঁশ দিয়ে ডোল, ধারাই ও চাটাই তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। আবার কেউ নিজেদের লাগানো কাসাবা খেয়ে বেঁচে থাকেন। অভাব-অনটনে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করলেও তাদের দিকে বিশেষ নজর নেই কারও। অবহেলিত এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামে। সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০।
বারমারী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে খলচান্দা গ্রামে যেতে হয়। প্রায় ১০০ গজ উত্তরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। স্বাধীনতার আগে মাত্র চার ঘর কোচ এই গ্রামে বাস করত। এর পর বংশবৃদ্ধি এবং ১৯৭৬ সালে চৌকিদার টিলা গ্রামে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন ও পরে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় আন্ধারুপাড়া গ্রাম থেকে বেশ কিছু পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে। এই গ্রামের বর্তমান পরিবার সংখ্যা প্রায় ৫২ ঘর। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ এ গ্রামে যেতে চান না। টিলায় ঘেরা গ্রামে দিনদিন জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চেল্লাখালী নদী দিয়ে এক সময় ভারত থেকে ভেসে আসত অসংখ্য বড় মূল্যবান গাছ। সে গাছ নদী থেকে তুলে এনে বিক্রি করে এবং পাহাড়ের সমতল জমিতে ধান চাষ করে ভালোই চলত খলচন্দা গ্রামের কোচদের সংসার। এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় জমি সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই সেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুর, কেউবা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
গ্রামটিতে কোনো পাকা সড়ক নেই। যাতায়াতের সড়কটি বেহাল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক ধুলোময় হয়ে থাকে। বর্ষায় চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রামে একটি মাত্র প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার হার নাজুক। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পায় না কোচ পরিবারগুলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারোমারি খ্রিষ্টান পল্লীর দাতব্য হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা নিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি খলচান্দা গ্রামে। আজও আঁধার কাটেনি কোচদের– এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা।
খলচান্দা গ্রামের মায়াদেবী কোচ বলেন, ‘আমগর সড়কটা দিয়ে শান্তি মতো যাওন যায় না। আধা মাইল দূর থাইকা দুই বেলা পানি আইনা চলি। এতে আমগর বিরাট কষ্ট অয়। মেঘ (বৃষ্টি) অইলে সড়কা দিয়া হাঁটন যায় না। সরকার যদি আমগরে গ্রামে বেশ কয়ডা টিউবওয়েলের ব্যবস্থা কইরা দিত, বিরাট উপকার অইত।’
বৃদ্ধ রুক্কিনী কোচ জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে এই গ্রামে বিয়ে হয় তাঁর। এক সময় পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিল। পাহাড় থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ আর গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতেন তারা। অনেক পশুপাখিও ছিল, কিন্তু এখন এই পাহাড়ে আর আগের মতো গাছও নেই, তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের রমেশ কোচ ও পরমেশ্বর কোচের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের মাত্র তিনজন কোচ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজিবিতে কর্মরত একজন অনেক আগে মারা গেছেন। অভাব-অনটন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এই গ্রামের কোচ উপজাতিরা শিক্ষায় এগোতে পারছেন না।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি হানা দেয় এই গ্রামে। গাছের কাঁঠাল ও ক্ষেতের ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় হাতির পাল কাঁঠাল, ক্ষেতের ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। বাড়িঘরও ভেঙে তছনছ করে ফেলে। তখন এই অসহায় কোচদের টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ডাকচিৎকার ও হৈহুল্লোড় করে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের ভালো-মন্দের খবর কেউ রাখে না। জনপ্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন। তাদের পদচারণায় কোচপল্লী তখন মুখর হলেও নির্বাচনের পর তাদের খবর রাখে না কেউ।
স্থানীয় চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, খলচান্দার কোচপাড়া যাওয়ার রাস্তাটার জন্যই অনেক পিছিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকগুলো। বিশেষ করে অনিরাপদ রাস্তার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তারা। রাস্তা ও স্কুলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।