জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্বের অধিকার বাতিল করতে পারবেন ট্রাম্প?
Published: 21st, January 2025 GMT
দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ডোনাল্ড ট্রাম্প একের পর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আদেশটি হলো নাগরিকত্ব সংক্রান্ত।
বিগত প্রায় ১৫০ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া শিশুরা ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব’ পেয়ে আসছেন। কিন্তু সোমবার (২০ জানুয়ারি) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেই অধিকারকে বাতিল করার জন্য নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ জারির ফলে অবৈধভাবে বা শিক্ষা-পর্যটনসহ সাময়িক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসে সন্তান জন্ম দিলে শিশু মার্কিন নাগরিকত্ব পাবে না। তবে বাবা-মায়ের কেউ আমেরিকান নাগরিক হলে সন্তান জন্মের পরই মার্কিন নাগরিক বলে স্বীকৃতি পাবে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন বলছে, ট্রাম্প যদিও জন্মগত নাগরিকত্বের সংজ্ঞা সম্বলিত নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, কিন্তু এর বিস্তারিত তথ্য এখনো অস্পষ্ট।
জন্মগত নাগরিকত্ব মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী থেকে উদ্ভূত, যেখানে বলা হয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী সকল ব্যক্তিই ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক’।
ট্রাম্প যদিও এই চর্চা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন কিন্তু তার এই প্রচেষ্টা ব্যাপক আইনি বাধার সম্মুখীন হবে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ও অন্যান্য সংস্থাগুলো এরইমধ্যে নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
‘জন্মগত নাগরিকত্ব’ কী?
মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর প্রথম বাক্যটি ‘জন্মগত নাগরিকত্ব’ নীতিটি প্রতিষ্ঠা করে: ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা নাগরিকত্বপ্রাপ্ত সকল ব্যক্তি এবং এর এখতিয়ারের অধীন যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা যে রাজ্যে বাস করেন সেই রাজ্যের নাগরিক।’
অভিবাসন বিরোধীদের মতে, “এই নীতি অবৈধ অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্রের দিকে টেনে আনে। গর্ভবতী নারীদের সন্তান জন্মদানের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করতে উৎসাহিত করে। এটি এমন একটি আইন, যাকে অবমাননাকরভাবে ‘জন্ম পর্যটন’ বা ‘নোঙ্গর শিশুর জন্ম’ বলা হয়।
এর শুরু কীভাবে হয়েছিল?
যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৮৬৮ সালে সংবিধানের ১৪তম সংশোধনী গৃহীত হয়। ১৩তম সংশোধনীতে ১৮৬৫ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করা হয়। ১৪তম সংশোধনীতে মুক্ত, আমেরিকান বংশোদ্ভূত সাবেক দাসদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটির নিষ্পত্তি করে।
১৮৫৭ সালে ড্রেড স্কট বনাম স্যান্ডফোর্ডের মতো মামলাগুলোর রায়ে সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আফ্রিকান আমেরিকানরা কখনই মার্কিন নাগরিক হতে পারবে না। ১৪তম সংশোধনী এটিকে অগ্রাহ্য করে।
১৮৯৮ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চিত করে যে, জন্মগত নাগরিকত্ব অভিবাসীদের সন্তানদের জন্য প্রযোজ্য।
ওং ছিলেন ২৪ বছর বয়সী চীনা অভিবাসীদের সন্তান, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু চীন সফর থেকে ফিরে আসার পর তাকে পুনরায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ওং সফলভাবে যুক্তি দিয়েছিলেন যে, যেহেতু তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাই তার বাবা-মায়ের অভিবাসন অবস্থা ১৪তম সংশোধনীর প্রয়োগকে প্রভাবিত করে না।
মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিগ্রেশন হিস্ট্রি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এরিকা লি লিখেছেন, “ওং কিম আর্কের মামলার রায়ে নিশ্চিত করা হয় জাতি বা পিতামাতার অভিবাসন অবস্থা নির্বিশেষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী সকল ব্যক্তি নাগরিকত্বের দ্বারা প্রদত্ত সব অধিকারের অধিকারী। আদালত তখন থেকে এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেনি।”
ট্রাম্প কি এটি বাতিল করতে পারেন?
বেশিরভাগ আইন বিশেষজ্ঞ একমত যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জন্মগত নাগরিকত্বের অবসান করতে পারবেন না।
মার্কিন সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ ও ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন স্কুলের অধ্যাপক সাইকৃষ্ণ প্রকাশ বিবিসিকে বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) এমন কিছু করছেন যা অনেক মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলবে, তবে শেষ পর্যন্ত এটি আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এটি এমন কিছু নয় যা তিনি (ট্রাম্প) নিজে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।”
সাইকৃষ্ণ প্রকাশের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতীয় সংস্থাগুলোকে নাগরিকত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য আরো সংকীর্ণভাবে নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু এটি নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এমন যে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে আইনি চ্যালেঞ্জের সূত্রপাত করবে।
এর ফলে দীর্ঘ আদালতের লড়াই শেষ পর্যন্ত মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে শেষ হতে পারে।
সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে জন্মগত নাগরিকত্ব বাতিল করা যেতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেট উভয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট এবং যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব ত ল কর র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি বছর বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বেড়েছে, জরিপে অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা
চলতি বছরে মন্দার ঝুঁকি অনেকটাই বেড়ে গেছে বলে জরিপে দেখা গেছে। ৫০টি দেশের অর্থনীতিবিদ এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতির কারণে ব্যবসায়িক পরিবেশের অবনতি হয়েছে।
চলতি বছরে বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ১৬৭ জন বিশ্লেষকের মধ্যে ১০১ জন ‘উচ্চ’ বা ‘খুব উচ্চ’ ঝুঁকির কথা বলেছেন। ৬৬ জন বলেছেন ঝুঁকি ‘কম’, যার মধ্যে চারজন বলেছেন ‘অত্যন্ত কম’।
জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে (যদিও ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে) ব্যবসায়িক আস্থা নষ্ট হয়েছে; সৃষ্টি করেছে অস্থিরতা। ফলে চলতি বছর মন্দার ঝুঁকি অনেকটা বেড়েছে। মাত্র তিন মাস আগেও এই অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশ শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। শুধু তা–ই নয়, তাঁরা বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা থাকবে।
কিন্তু ট্রাম্পের বিশ্ববাণিজ্য ‘নতুনভাবে গঠনের’ উদ্যোগ, বিশেষ করে সব আমদানির ওপর শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত, অর্থনীতিতে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে বাজার মূলধন কমেছে ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। ডলারসহ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদগুলোয় বিনিয়োগকারীদের আস্থা নড়বড়ে হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩০০ জনের বেশি অর্থনীতিবিদের মধ্যে কেউই বলেননি, ট্রাম্পের শুল্কনীতির ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ৯২ শতাংশ অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ব্যবসায়ীদের মনোবলে এই শুল্কনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মাত্র ৮ শতাংশ নিরপেক্ষ মত দিয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই ভারত ও অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির প্রতিনিধি।
জরিপে ২০২৫ সালের জন্য বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে। জানুয়ারি মাসের জরিপে এই অর্থনীতিবিদেরাই বলেছিলেন, প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ শতাংশ। এবার তা ২ দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অবশ্য একটু বেশি—তারা ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮টি অর্থনীতির মধ্যে ২৮টি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে আনা হয়েছে।
২০২৬ সালের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসও আশাব্যঞ্জক নয়। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে যে অর্থনৈতিক মন্দার আবহ তৈরি হয়েছে, তা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ১৬৭ অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১০১ জন (৬০ শতাংশ) অবশ্য বলেছেন, চলতি বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি বেশি বা খুব বেশি। মাত্র ৬৬ জন এটিকে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন।
চীন ও রাশিয়ার অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা মনে করছেন, চীনের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ; রাশিয়ার হতে পারে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে মেক্সিকো ও কানাডার প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে দশমিক ২ ও ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে, গত কয়েক মাসের মধ্যে যা সবচেয়ে বড় অবনতি।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান স্টেট স্ট্রিটের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার প্রধান কৌশলবিদ টিমোথি গ্রাফ বলেন, এই পরিবেশে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আশাবাদী হওয়া কঠিন। আজকের মধ্যে সব শুল্ক তুলে নেওয়া হলেও ট্রাম্পের নীতির কারণে দ্বিপক্ষীয়, বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা চুক্তিতে বিশ্বাসযোগ্যতার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা কঠিন।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্বজুড়ে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল, নীতি সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন উচ্চ শুল্কের কারণে নতুন করে মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ও বেকারত্ব বাড়লে স্ট্যাগফ্লেশন (উচ্চ মূল্যস্ফীতি+বেকারত্ব নিম্ন প্রবৃদ্ধি) সৃষ্টি হতে পারে। সেই আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে বলেই মনে করেন গ্রাফ।
জরিপে আরও দেখা গেছে, ২৯টি প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে ১৯টি ব্যাংক চলতি বছর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আগামী বছরের জন্য এ সংখ্যা কিছুটা কমে ১৫-তে নামবে বলে পূর্বাভাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই বাণিজ্যনীতির অভিঘাত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নয়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ফলে ভবিষ্যতেও চাপ অব্যাহত থাকবে। এখন দেখার বিষয়, বিশ্বনেতারা কীভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন, অর্থাৎ কীভাবে স্থিতিশীল বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করতে পারেন।