কৃষিপণ্যের চাহিদা কমার শঙ্কা, উদ্বিগ্ন চাষিরা
Published: 24th, January 2025 GMT
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে সরকারের এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এ অবস্থায় কয়েক দিন পর ওষুধ, মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ কিছু পণ্য ও সেবায় বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বেশ কিছু পণ্যে ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার হয়নি। এ খাতের আচার, বিস্কুট, কেক, চাটনি, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের ওপর ভ্যাট ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। দাম বাড়লে ক্রেতারা এসব পণ্য কম কিনবেন অথবা কিনবেন না। এতে করে কৃষিপণ্যের চাহিদা কমার শঙ্কা রয়েছে। চাহিদা কমলে কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ইতোমধ্যে এ খাতের রপ্তানি ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। তারা মনে করেন, কৃষককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। তা না হলে এদেশের সাধারণ কৃষকদের পাশাপাশি বর্ধনশীল কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার অভাবে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশে বহুল উৎপাদিত একটি ফসল টমেটো। প্রাণ গ্রুপ ২০০২ সাল থেকে টমেটো থেকে নানা ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরি করে আসছে। প্রাণ সবসময় পণ্যের গুণগত মানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। পণ্যের গুণগত মান অনেকাংশে নির্ভর করে মানসম্মত কাঁচামালের ওপর। বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে ২০১০ সালে টমেটোর চুক্তিভিত্তিক চাষ শুরু করে প্রাণ।
প্রাণ গ্রুপের প্রায় এক লাখ চুক্তিভিত্তিক কৃষক রয়েছে যাদের কাছ থেকে টমেটো, আম, বাদাম, দুধ, ডাল, কাসাভাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। রাজশাহী, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, খুলনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এবং ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রাণের চুক্তিভিত্তিক কৃষকরা টমেটো উৎপাদন করে থাকেন। এবার সারাদেশে প্রাণের সাড়ে ১০ হাজার কৃষক প্রায় ২ হাজার ৮০০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। চলতি বছর টমেটো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার টন। গত বছর ১০ হাজার কৃষক প্রায় ২ হাজার ৫০০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করে এবং টমেটো সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার টন।
প্রাণের টমেটো চাষে কৃষকের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। গত কয়েক বছরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর কোম্পানিটির চুক্তিভিত্তিক কৃষক বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ হারে। এর পেছনের বড় কারণ হলো উপযুক্ত সময়ে ন্যায্যমূল্যে টমেটো সংগ্রহ এবং অধিক ফলনের জন্য কৃষকদের সহায়তা। এ ক্ষেত্রে প্রাণ কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ প্রদান, জমি চাষে প্রশিক্ষণ ও সঠিক সময়ে কীটনাশক প্রয়োগসহ প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করে আসছে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সহযোগিতায় ‘প্রাণ অ্যাসিউরড স্কিমের আওতায়’ প্রাণ পাঁচ হাজার টমেটো চাষিকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে।
অনেক সময় ন্যায্য দামে টমেটো বিক্রি করতে না পেরে কৃষকরা তা ফেলে দিতে বাধ্য হতেন অথবা পচে যেত। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকার কৃষকদের এমন পরিস্থিতিতে প্রতিবছরই পড়তে হয়। প্রাণের চাষিদের এখন উৎপন্ন টমেটো বাজারজাত করার ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। এ কারণে রাজশাহী অঞ্চলের কৃষকরা প্রাণের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে টমেটো চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন এবং এই এলাকার পণ্যটি উৎপাদন আগের তুলনায় বেড়েছে। ফলে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। চুক্তিভিত্তিক চাষিরা প্রতি বিঘায় ৫ থেকে ৬ টন ফলন পেয়ে থাকেন। এসব টমেটো তারা চলমান বাজার মূল্যে কয়েক ধাপে বিক্রি করেন। এতে বিঘাপ্রতি তাদের টমেটো বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। বিঘাপ্রতি মুনাফা আসে অন্তত ৩০ হাজার টাকা।
কৃষকদের কাছ থেকে টমেটো কেনার পর প্রাণের কারখানায় প্রথমে সেগুলো বাছাই করা হয়। এরপর স্বয়ংক্রিয় মেশিনে এগুলোকে নেওয়া হয় ওয়াশিং প্লান্টে। সেখানে কয়েক দফায় ওয়াশ করার পর টমেটো চলে যায় ক্রাশিং প্লান্টে। সেখানে টমেটো পেস্ট তৈরি হওয়ার পর সেগুলো অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।
এরপর প্রয়োজন অনুযায়ী পেস্ট থেকে টমেটো সস ও কেচাপ তৈরি করা হয়। অ্যাসেপটিক পদ্ধতিতে সংরক্ষিত পেস্ট দুই বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। টমেটো থেকে উৎপাদিত সস-কেচাপ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রচুর চাহিদা রয়েছে। দেশে বর্তমানে সস, কেচাপ ও টমেটো পেস্টের বাজার বার্ষিক ৬০০ কোটি টাকা। এ বাজার বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সম্প্রতি ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে এসব পণ্যের চাহিদা কমতে পারে। এ ছাড়া এর প্রভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে প্রচুর শ্রমিকের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসবে।
রাজশাহীর বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক (বিআইপি) ও নাটোরের প্রাণ এগ্রো কারখানাতে টমেটো সংগ্রহ ও পাল্পিং করে থাকে প্রাণ গ্রুপ। এ দুটি কারখানায় ১৫ জানুয়ারি থেকে টমেটো সংগ্রহ ও পাল্পিং কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এটি চলবে টমেটোর সরবরাহ থাকা পর্যন্ত। প্রাণের দুটি কারখানায় সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৫০০ শ্রমিক। এ ছাড়া টমেটোর সরবরাহসহ বিভিন্ন ধাপে নিয়োজিত– এমন পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি লোকের।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ষকদ র ক ষকর উৎপ দ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে অবরোধের হুঁশিয়ারি আপ বাংলাদেশের
জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে গণজমায়েত থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।
‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের দাবি’ শীর্ষক গণজমায়েতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আপ বাংলাদেশের নেতা–কর্মীরা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারি না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু আহতদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখেছি, যারা জুলাইয়ের নেতৃত্বে ছিল, জুলাইয়ের পরে তাদের পকেট ভারী হয়েছে। আমি বলতে চাই, আপনাদের এই পকেটের হিসাব দিতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে আলী আহসান বলেন, ‘আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারবেন কি পারবেন না, তা জানান; না পারলে আমরা আছি। যারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম, বাংলাদেশের (সেই) ২০ কোটি জনগণ জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে।’
আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র না হয়, তাহলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ শুরু হবে। এ সরকারের কোনো হুমকি আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।’
গণজমায়েতে অংশ নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বলেন, আপ বাংলাদেশের নেতারা এখনো কোনো প্রটোকল ছাড়া রাস্তাঘাটে হাঁটেন। কিন্তু তাঁরা যেদিন প্রটোকল নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলা শুরু করবেন।
জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির আহ্বান জানিয়ে শরীফ ওসমান বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় জুলাই শহীদেরা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁদেরকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আজকের মধ্যে সরকার দিনক্ষণ না জানালে আগামী ৩ তারিখ (আগস্ট) ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে কফিন মিছিল নিয়ে সচিবালয় অবরোধ করা হবে।
বিগত এক বছর থেকে একটি দুর্বল সরকার দেশ চালাচ্ছে উল্লেখ করে আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ঘোষণাপত্রের জন্য আমাদের আবারও গণজমায়েত করতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘আমরা যে মৌলিক সংস্কার চেয়েছিলাম, এখনো তার কিছুই হয়নি। এখনো শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। আমি উপদেষ্টাদের উদ্দেশে বলতে চাই, অবিলম্বে জুলাই সনদ ঘোষণা করুন। আপনাদের কাছে আমাদের চাওয়া–পাওয়া খুব বেশি নেই।’
গণজমায়েতে র্যাপ গান পরিবেশন করেন আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য আহনাফ তাহমিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন জুলাই শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা আবদুর রহমান। গণজমায়েতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আপ বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত, প্রধান সংগঠক নাঈম আহমেদ, মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা প্রমুখ।