অবৈধ ইটভাটার জন্য সড়কের পাশে জমি ও নদীর পাড় কেটে মাটি পাচার করা হচ্ছে। আবার সড়কের ইছামতী নদী থেকে দেদার বালু উত্তোলন চলছে। এ কারণে রাঙামাটির কাউখালী-রানীরহাট সড়কটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক্সক্যাভেটর দিয়ে রাত-দিন সমানতালে নদীর পাড় কাটা এবং মেশিন দিয়ে বালু তোলার ফলে ভারী যান চলাচলের কারণে যে কোনো মুহূর্তে রাস্তা ধসে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া নদী থেকে বালু উত্তোলন, রাস্তার পাড় ও নদীর পাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে একটি চক্র। এ চক্রটি বেশ কিছুদিন ধরে মাটি কেটে ট্রাকে করে প্রকাশ্যে বিক্রি করছে, যা দেখার যেন কেউ নেই।
জানা গেছে, রাঙামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা হচ্ছে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। এই দুই সীমান্তবর্তী উপজেলার মাঝখান দিয়ে কাউখালী উপজেলা সদর থেকে রাঙ্গুনিয়ার রানীরহাট পর্যন্ত একটি সড়ক করা হয়েছে; যা কাউখালী-রানীরহাট সড়ক হিসেবে পরিচিত। মূলত এ সড়কটি চট্টগ্রাম-রাঙামাটির সড়কে গিয়ে পড়েছে; যা এ সড়কটি কাউখালী উপজেলাবাসীর যোগাযোগের অন্যতম সড়ক। প্রতিদিন এ সড়ক দিয়ে শত শত যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু কাউখালী-রানীরহাট সড়কের বহরাতল থেকে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের কাউখালী রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে মাটি কাটায় বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যে কোনো মহূর্তে সড়কটি বিচ্ছিন্নের আশঙ্কা রয়েছে। অভিয়োগ রয়েছে, এলাকার সিংহভাগই পাশের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা প্রশাসনের আওতায় থাকায় কাউখালী উপজেলা প্রশাসন থেকে বারবার মৌখিক ও লিখিতভাবে জানানো হলেও অদৃশ্য কারণে মাটি এবং বালু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না হয়নি।
অপরদিকে, ইছামতি নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের কারণে কাউখালী উপজেলা সদরের কাউখালী কেন্দ্রীয় কবরস্থান, কাউখালী বাজার কবরস্থান, বগাবিলি উচ্চ বিদ্যালয় এলাকার সম্মুখভাগসহ আশপাশের বহু এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে নদীর নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করার জন্য প্রতি বছর নামমাত্র মূল্যে ইজারা প্রদান করা হলেও, প্রতি বছর শতকোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এলাকাবাসীর। এলাকা নির্দিষ্ট করে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেওয়া হলেও প্রভাবশালীরা এসব তোয়াক্কা করছে না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
সরেজমিন পরিদর্শন দেখা গেছে, কাউখালী উপজেলার পাশের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের বহরাতল থেকে কাউখালী রাস্তার মাথা এলাকা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের পাড়, নদীর পাড় কেটে মাটি ও ইছামতী নদী থেকে বালু উত্তোলন করে পাচার করছে একটি চক্র। এসব মাটির অধিকাংশ যাচ্ছে স্থানীয় ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটায়। আধুনিক এক্সক্যাভেটর দিয়ে সড়কের পাশে জমির মাটি কাটায় কাউখালী-রানীরহাট সড়কটি যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে যেতে পারে। আগামী বর্ষা মৌসুম শুরু হলে এ সড়ক আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে স্থানীয়দের আশঙ্কা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বহরাতল থেকে শুরু হয়ে রাস্তা ও নদীর পাড় কাটা এবং ইছামতি নদী থেকে বালু উত্তোলনের মহাযজ্ঞ চলছে। সড়কের পাশে বালুর স্তূপ এবং এর পাশেই মাটি কেটে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা বানানো হয়েছে। সেখান থেকে খালের দিকে নজর দিলেই দেখা যায় বিশাল এলাকাজুড়ে এক্সক্যাভেটরের সাহায্যে নদীর পাড় কাটার গভীর চিহ্ন। একটি চক্র বেশ কিছুদিন ধরে মাটি কেটে ট্রাকে করে প্রকাশ্যে পাচার করছে। এতে রাস্তার পাশে এবং খালের পাড়ে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়েছে। ভারী এক্সক্যাভেটরের সাহায্যে মাটি কাটতে কাটতে একেবারে সড়কের পাশে চলে এসেছে। আগে আশপাশের নদীপাড়ে লতা, আলুসহ নানা ফসলের আবাদ হলেও, এই স্থানে মাটি কাটার ফলে তা সম্ভব হচ্ছে না। গভীর করে মাটি কাটায় ক্ষেত ভেঙে পড়ছে খাদে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ভৌগলিকভাবে রাঙ্গুনীয়া উপজেলার শেষ সীমান্ত হওয়ায় এ স্থানে প্রশাসনের তদারকি কম। ফলে দিনের পর দিন এই অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে একটি চক্রটি। শুধু এ স্থানেই নয়, ইছামতী নদীর আরও বিভিন্ন পয়েন্টে একইভাবে বালু উত্তোলন করে এবং পাড়ের মাটি কেটে পাচার করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, একটি প্রভাবশালী মহল ইতিপূর্বে নদীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলন করতো। এবার এখন পাড়ের মাটিও কেটে বিক্রি করছে ইটভাটায়। গত ৫ আগস্টের পর আগের চক্রটি নেই, নতুন চক্র গড়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্থা (ইউএনও) কাজী আতিকুর রহমান বলেন, ‘কাউখালী-রানীরহাট সড়কের দুই পাশের মাটি কাটা, ইছামতি নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে কাউখালীর বিস্তীর্ণ এলাকায় ভাঙন হচছে। পাশাপাশি কাউখালী-রানীরহাট সড়ক ঝুকিপূণ হয়ে উঠেছে। বিষয়টি রাঙ্গুনিয়ার ইউএনওকে মৌখিক ও লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে ওই এলাকাটি রাঙ্গুনীয়া উপজেলার আওতায় পড়েছে, তাই সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রাঙ্গুনীয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘কাউখালী-রানীরহাট সড়ক, ইছামতী নদীর পাড়ের মাটি কাটা এবং বালু উত্তোলনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরেজমিনে পরিদর্শন করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সড়ক র প শ প চ র কর উপজ ল র এ সড়ক
এছাড়াও পড়ুন:
আজও আঁধার কাটেনি কোচদের
বন্যহাতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে কোচ সম্প্রদায়। তাদের কেউ কেউ দিনমজুরি, বন থেকে লাকড়ি সংগ্রহ, বাঁশ দিয়ে ডোল, ধারাই ও চাটাই তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। আবার কেউ নিজেদের লাগানো কাসাবা খেয়ে বেঁচে থাকেন। অভাব-অনটনে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করলেও তাদের দিকে বিশেষ নজর নেই কারও। অবহেলিত এ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক পরিবারের বসবাস নালিতাবাড়ী উপজেলার খলচান্দা গ্রামে। সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩০০।
বারমারী বাজার থেকে তিন কিলোমিটার পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে খলচান্দা গ্রামে যেতে হয়। প্রায় ১০০ গজ উত্তরে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া। স্বাধীনতার আগে মাত্র চার ঘর কোচ এই গ্রামে বাস করত। এর পর বংশবৃদ্ধি এবং ১৯৭৬ সালে চৌকিদার টিলা গ্রামে বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন ও পরে ভূমিহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প করায় আন্ধারুপাড়া গ্রাম থেকে বেশ কিছু পরিবার এখানে এসে বসতি গড়ে। এই গ্রামের বর্তমান পরিবার সংখ্যা প্রায় ৫২ ঘর। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ এ গ্রামে যেতে চান না। টিলায় ঘেরা গ্রামে দিনদিন জনসংখ্যা বাড়লেও তাদের ভাগ্যের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাসিন্দারা জানান, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা চেল্লাখালী নদী দিয়ে এক সময় ভারত থেকে ভেসে আসত অসংখ্য বড় মূল্যবান গাছ। সে গাছ নদী থেকে তুলে এনে বিক্রি করে এবং পাহাড়ের সমতল জমিতে ধান চাষ করে ভালোই চলত খলচন্দা গ্রামের কোচদের সংসার। এসব দৃশ্য এখন শুধুই স্মৃতি। তাদের মূল পেশা কৃষিকাজ হলেও পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় জমি সংকট এবং কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকেই সেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিনমজুর, কেউবা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে নানা পেশায় যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া ঘরে বসে থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকেই।
গ্রামটিতে কোনো পাকা সড়ক নেই। যাতায়াতের সড়কটি বেহাল। শুষ্ক মৌসুমে সড়ক ধুলোময় হয়ে থাকে। বর্ষায় চলাচল সম্পূর্ণ অনুপযোগী হয়ে যায়। এ ছাড়া গ্রামে একটি মাত্র প্রাকপ্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষার হার নাজুক। স্বাস্থ্যসেবার অবস্থাও একই। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পায় না কোচ পরিবারগুলো। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে বারোমারি খ্রিষ্টান পল্লীর দাতব্য হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে হয়। মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার দেখাতে বা চিকিৎসা নিতে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলা সদরে অথবা ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলা সদর হাসপাতালে যেতে হয়। স্বাধীনতার এত বছর পরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছায়নি খলচান্দা গ্রামে। আজও আঁধার কাটেনি কোচদের– এমনটিই বলছেন স্থানীয়রা।
খলচান্দা গ্রামের মায়াদেবী কোচ বলেন, ‘আমগর সড়কটা দিয়ে শান্তি মতো যাওন যায় না। আধা মাইল দূর থাইকা দুই বেলা পানি আইনা চলি। এতে আমগর বিরাট কষ্ট অয়। মেঘ (বৃষ্টি) অইলে সড়কা দিয়া হাঁটন যায় না। সরকার যদি আমগরে গ্রামে বেশ কয়ডা টিউবওয়েলের ব্যবস্থা কইরা দিত, বিরাট উপকার অইত।’
বৃদ্ধ রুক্কিনী কোচ জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের সমেশ্চুরা গ্রামে। দেশ স্বাধীনের আগে এই গ্রামে বিয়ে হয় তাঁর। এক সময় পাহাড় আর জঙ্গলে ভরা ছিল। পাহাড় থেকে মরা কাঠ সংগ্রহ আর গাছ থেকে বিভিন্ন ফল পেড়ে খেতেন তারা। অনেক পশুপাখিও ছিল, কিন্তু এখন এই পাহাড়ে আর আগের মতো গাছও নেই, তাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
গ্রামের রমেশ কোচ ও পরমেশ্বর কোচের ভাষ্য, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত তাদের গ্রামের মাত্র তিনজন কোচ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এর মধ্যে বিজিবিতে কর্মরত একজন অনেক আগে মারা গেছেন। অভাব-অনটন আর যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় এই গ্রামের কোচ উপজাতিরা শিক্ষায় এগোতে পারছেন না।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, মাঝে মধ্যেই বন্যহাতি হানা দেয় এই গ্রামে। গাছের কাঁঠাল ও ক্ষেতের ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে। এ সময় হাতির পাল কাঁঠাল, ক্ষেতের ধান খেয়ে ও পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। বাড়িঘরও ভেঙে তছনছ করে ফেলে। তখন এই অসহায় কোচদের টিন পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, ডাকচিৎকার ও হৈহুল্লোড় করে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। তাদের ভালো-মন্দের খবর কেউ রাখে না। জনপ্রতিনিধিরা শুধু নির্বাচনের সময় ভোট চাইতে আসেন। তাদের পদচারণায় কোচপল্লী তখন মুখর হলেও নির্বাচনের পর তাদের খবর রাখে না কেউ।
স্থানীয় চেয়ারম্যান হাজী জামাল উদ্দিন বলেন, খলচান্দার কোচপাড়া যাওয়ার রাস্তাটার জন্যই অনেক পিছিয়ে আছে কোচ সম্প্রদায়ের লোকগুলো। বিশেষ করে অনিরাপদ রাস্তার জন্য শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত তারা। রাস্তা ও স্কুলের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
এ ছাড়া পর্যায়ক্রমে তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে।