বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির খসড়া ঘোষণাপত্র ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। গত ১৬ জানুয়ারি ‘জুলাই ঘোষণা’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সর্বদলীয় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আগে একটি খসড়া জুলাই ঘোষণা দলগুলোকে পাঠানো হয়। এ দুটি ঘোষণাপত্রের প্রধান কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রসঙ্গে
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কাঁচামাল এবং পুঁজি সংগ্রহের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। যার প্রথম প্রকাশ ঘটে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় হয়। এর পর বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন এবং ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় পায়। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এসব গণআন্দোলনের স্বাভাবিক পরিণতি। এই মুক্তিযুদ্ধে জাতির একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ রাজাকার, আলবদর বাহিনী যেমন ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে, তেমন লাখো-কোটি জনগণ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু এই গৌরব আওয়ামী লীগ একা আত্মসাৎ করতে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গঠিত হলো, তা প্রথম দিন থেকেই শোষণ, জুলুম, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকে পা বাড়াল। সর্বশেষ ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানকে কবরস্থ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত একের পর এক ক্যু, পাল্টা ক্যু চলতে থাকে এবং সর্বশেষ নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত এ দুটি সরকারই দেশকে কোনো স্থায়িত্ব দিতে পারেনি। উপরন্তু সংবিধানে একের পর এক সংশোধনী এনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব এবং একের পর এক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছে। সর্বশেষ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-বাকস্বাধীনতা হরণকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। জুলাই ঘোষণার মধ্যে ইতিহাসের বর্ণনায় এই উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো বাদ পড়েছে। 

বাহাত্তরের সংবিধান প্রসঙ্গে 
জুলাই ঘোষণাপত্রে তারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকেই বাংলাদেশের সংবিধানের যথার্থ ভিত্তি হিসেবে ধরছেন। অথচ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে সব রকম প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁর হাতে বিপুল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার– এই শব্দগুলোতে লাখো কোটি জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় আওয়ামী লীগ সেগুলোকে বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। এই সংবিধান প্রণয়নের আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে মুজিববাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন এখন এসেছে যে, এই সংবিধানের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হলো মুজিববাদ। তবে জেনে রাখা উচিত, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী স্বাধীনতা, এক মানুষ-এক ভোট– এসব প্রগতিশীল ধারণা নিয়ে এসেছিল। এর পর থেকে সব বুর্জোয়া রাষ্ট্রই তাদের সংবিধানকে এই ধারণাগুলোর ওপর দাঁড় করায়। ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল সন্তোষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয়– ‘.

..সংবিধান হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক।’ ফলে আওয়ামী লীগ মুজিববাদ বলে যা দাবি করেছে, তা অন্তঃসারশূন্য।    
বাহাত্তরের সংবিধানের প্রগতিশীল ইতিবাচক দিকগুলোকে অক্ষত রেখে মূলত কাঠামোগত দিকটি সংস্কার করা উচিত। একই সঙ্গে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজ– এই ছয়টি মৌলিক অধিকারকে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে সংযুক্ত করা উচিত এবং মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে রচিত অধিকারগুলোকে আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য করা উচিত। 

ঘোষণাপত্র দুটির মধ্যে পার্থক্য
সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সরকার গঠন, ‘ডিকলোনাইজড ট্রুথ অ্যান্ড হিলিং কমিশন’-এর প্রস্তাবনা, সেনাশাসন-রাষ্ট্রীয় পুঁজি-বৃহৎ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রস্তাবনা– এসব ছাত্রদের দেওয়া ঘোষণায় থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সরকারের দেওয়া খসড়া ঘোষণায় নেই। 

গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে
আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব জাগরণ এই গণঅভ্যুত্থান। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এই আন্দোলনে। আহত হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই গণঅভ্যুত্থান থেকে ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের স্লোগান উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতন মানেই ফ্যাসিবাদের পতন নয়। ফ্যাসিবাদ কোনো দল আনে না। ফ্যাসিবাদ আনে একটি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নত কিংবা অনুন্নত সব দেশেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যায়। ফলে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিলোপ ঘটেনি; ফ্যাসিবাদ পিছু হটেছে মাত্র। 
১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এর পর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আবার ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা। তাই সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন, সর্বোপরি নাগরিক সমাজের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা উচিত।

মাসুদ রানা: সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরাম, বাসদ (মার্ক্সবাদী)

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক সরক র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

‘বিচার প্রক্রিয়া ও সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে’

অন্তবর্তী সরকারের শিল্প, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সবাইকে ধৈর্য ধরে বিচার প্রক্রিয়া, সংস্কার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সারাদেশ এখন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার অপেক্ষায় রয়েছে।”

বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) জাহাঙ্গীরনগর বিবিদ্যালয়ে নির্মিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ‘অদম্য ২৪’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে, অদম্য ২৪ উদ্বোধন করেন তিনি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্মিত জুলাইয়ের ভিডিও ও ফটো ডকুমেন্টারি উপভোগ করেন।

আরো পড়ুন:

জবির পরিত্যক্ত ডাস্টবিনগুলো সংস্কার করল ছাত্রদল

রাকসু থেকে জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে যারা

আদিলুর রহমান খান বলেন, “১ বছর আগে বাংলাদেশে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্যই পারে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যেতে। বিচার প্রশ্নে বলতে চাই কোনো অবস্থাতেই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া সরকার বিচারের ক্ষেত্রে দুর্বলতা স্কোপ রাখবে না। খুব দ্রুতই বেশ কয়েকটি বিচারের কাজ দৃশ্যমান হবে।”

তিনি আরো বলেন, “তরুণ ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি এবং দেশকে বাঁচানোর জন্য জীবন দিয়েছেন। ছাত্র-জনতার মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে। সেই ঐক্য ধরে রাখতে হবে।” এছাড়া স্মৃতিস্তম্ভ ‘অদম্য-২৪’ বিভাজন ভুলে একাত্ম হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন।

সমাপনী বক্তব্যে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, “সংঘবদ্ধ আন্দোলনে ৫ আগস্ট আমরা বিজয় অর্জন করেছি। এর মানে এই নয় যে, অন্য যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে আর স্বর আপনারা শুনবেন না। আপনারা দেখবেন, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থীরা সচেতন এবং কথা বলার ব্যাপারে উন্মুক্ত।”

তিনি বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, এই স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে আবার স্মরণ করিয়ে দিলাম, আমরা যদি বাংলাদেশে কোনো অশান্তি দেখি, বৈষম্য দেখি, পরাজয়ের কালো মেঘ দেখি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদম্য সংগ্রামীরা আবারো তাদের সেই কার্যক্রম শুরু করবে। গোটা বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিবে, আবার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে।

অনুষ্ঠানে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, উপ -উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রব, প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলমসহ জাহাঙ্গীরনগরের সঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যরাও বক্তব্য দেন।

ঢাকা/আহসান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাঁধন-সাবার ভার্চুয়াল দ্বন্দ্বে যোগ দিলেন অরুণা বিশ্বাস
  • নেতা-কর্মীদের মতের মূল্য না দিলেও জি এম কাদের স্ত্রীর মতামত প্রাধান্য দেন: আনিসুল ইসলাম
  • ‘বিচার প্রক্রিয়া ও সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে’
  • তিতুমীর কলেজে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী
  • মিয়ানমারে ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষণা জান্তা সরকারের, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সরাসরি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পক্ষে
  • হাসিনাকে ১০ বার ফাঁসিতে ঝোলালেও তার অপরাধ কমবে না: নাহিদ 
  • ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
  • এমন কিছু করবেন না যাতে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়: মির্জা ফখরুল
  • নরসিংদীতে আজ এনসিপির পদযাত্রা