কোনো উপসর্গ না থাকলেও ৪০ পেরোলে কেন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা প্রয়োজন
Published: 10th, February 2025 GMT
কোনো উপসর্গ না থাকলেও ৪০ বছর বয়স পেরোনোর পর প্রত্যেক ব্যক্তিরই প্রতিবছর একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। আবার চল্লিশের আগে যে ডায়াবেটিস হবে না, এমনটাও কিন্তু নয়। তাই ৪০ বছরকে মোটামুটিভাবে একটা সীমা ধরে নিলেও সাধারণ কোনো উপসর্গ, যা বারবার দেখা দেয়, সেসবের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত সব বয়সীদেরই। এমনটাই বলছিলেন স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের মেডিসিন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট ডা.
তাসনোভা মাহিন।
বারবার ক্ষুধা পাওয়া, বারবার প্রস্রাব লাগা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ যে ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে, তা অনেকে জানেন। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রায়ই চুলকানি হতে পারে। ত্বকের যেকোনো জায়গাই চুলকাতে পারে। এমনকি মূত্রনালির আশপাশেও হতে পারে এই অস্বস্তিকর অনুভূতি।
আরও পড়ুনডায়াবেটিস হঠাৎ বেড়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, কীভাবে জানেন০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ডায়াবেটিসে কেন চুলকানি হয়ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই বারবার জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে তাঁদের। ত্বকে জীবাণুর সংক্রমণ হওয়ার কারণে চুলকানি হতে পারে। আবার ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বকে সংক্রমণ ছাড়াও অন্যান্য রোগ হতে পারে। এসব রোগেও চুলকানি হয়।
ডায়াবেটিসে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব স্নায়ুর মাধ্যমে আমরা ত্বক থেকে আসা অনুভূতি উপলব্ধি করি, সেসবের ক্ষতি হলে কিন্তু চুলকানির কোনো দৃশ্যমান কারণ না থাকা সত্ত্বেও রোগীর চুলকানির মতো অনুভূতি হতে পারে।
তা ছাড়া বারবার প্রস্রাব হওয়ার কারণে রোগী পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। এ রকম অবস্থায় ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ে। শুষ্ক ত্বকও প্রায়ই চুলকাতে পারে। নারীদের ডায়াবেটিস হলে যোনিতে ছত্রাক সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। সংক্রমণ হলে দেহের এই অংশে চুলকানি হয়।
আরও পড়ুনপ্রাক্-ডায়াবেটিস কী, কাদের ঝুঁকি বেশি১৭ নভেম্বর ২০২৩কী করবেনপ্রায়ই চুলকানির সমস্যায় ভুগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তিনি প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চুলকানির কারণ নির্ণয় করবেন। মনে রাখা প্রয়োজন, ডায়াবেটিস হয়েছে কি না, তা কিন্তু কেবল আঙুলের রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করলেই নিশ্চিত হওয়া যায় না। শিরা থেকে রক্ত নিয়ে একাধিক পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। আর ডায়াবেটিস ছাড়াও বিভিন্ন রোগে শরীর চুলকায়। যেমন লিভারের কিছু সমস্যা কিংবা চর্মরোগ হলে শরীর চুলকাতে পারে। বুঝতেই পারছেন, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আপনি এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন না।
আরও পড়ুনডায়াবেটিস থেকে সুরক্ষার মূলমন্ত্র ১৫ নভেম্বর ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ক রমণ উপসর গ পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।
অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।
আরো পড়ুন:
১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের
দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।
গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা।
তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”
অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।
ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।
সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।
অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”
রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।
তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
ঢাকা/মেহেদী